শামস তাবরিজি রহঃ
শামস তাবরিজি রহঃ প্রকৃত না শামস আল দিন মোহাম্মাদ। শামস তাবরিজি ছিলেন একজন ইরানি সুফি সাধক। ইসলামের অন্তনির্হিত রুপ এবং ইসলামের অন্তর্গত আধ্যাত্মিকতা নিয়ে যে ধারায় আলোচনা করা হয়ে থাকে, তাই সুফিবাদ। সুফিবাদ হলো এমন একটি ধারা যেখানে মানুষের আত্মা স্বর্গীয় সত্ত্বার সাথে মিলনে ব্যাকুল, পাগল এবং আত্মহারা হয়ে থাকে। তিনি ১১৮৫ সালে ইরানের প্রসিদ্ধ শহর, যা বর্তমানে পূর্ব আজারবাইজানের রাজধানী, তাবরিজে জন্ম গ্রহন করেন। তা ছাড়াও তিনি জালালউদ্দিন রুমির অন্তরঙ্গ বন্ধু ছিলেন। জানা যায়, তিনি প্রখ্যাত সুফিসাধক জালালউদ্দিন রুমিকে চল্লিশ দিন শিক্ষা দিয়েছিলেন। তিনি মানুষকে সপ্নের ব্যাখ্যা দিতেন। যার কারনেই তাকে সুফি উপাধিতে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাঁর পিতার নাম ছিলো ইমাম আলা আলদিন, তিনি ছিলেন একজন ইমাম।
তখনকার সময়ে তাবরেজ শহরের খ্যাতি ছিল এ জন্য যে সে সময়ে ইমাম গাজ্জালী, নাজিম উদ্দিন কোবরা সহ অসখ্য সুফি সাধকগণ সেখানে তাদের জীবনের অনেক সময় অবস্থান করেছিলেন । সেখানেই শামসের শৈশব কাটে । এবং সেখানেই তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় । শামস ছিলেন শাফি মাজহাবের অনুসারী।
তিনি সবসময় চটের ছালা পড়ে পাগল বেশে আল্লাহর প্রেমে মত্ত হয়ে ঘুরে বেড়াতেন যাতে লোকে তাকে চিনতে না পারে।
রুমির সাথে যখন শামসেত তাবরিজির পরিচয় হয় তখন তাবরিজির বয়স ষাটের কোঠায়। তাবরিজি একধরনের সমাজ-বিরোধী এবং জেদি মানুষ ছিলেন। তবে বিস্ময়করভাবে তাবরিজি ছিলেন খুবই শক্তিশালী এক আধ্যাত্মিক পুরুষ। তাঁকে লোকে ‘পাখি’ বলে ডাকতেন। তাঁকে নিয়ে মানুষের ছিল বিপুল কৌতূহল। রহস্যঘেরা ছিল তাবরিজির জীবন। এর বড় কারণ, তিনি এক জায়গায় বেশিক্ষণ থাকতেন না। খুব দ্রুত জায়গা বদল করে অন্যত্র চলে যেতেন। তবে তাবরিজি সবসময় একজন প্রভাবশালী সাগরেদ খুঁজতেন। ভাবতেন তাঁর একজন যোগ্য উত্তরসূরি প্রয়োজন। শেষ পর্যন্ত রুমির মধ্যেই সেই গুণ খুঁজে পেলেন তাবরিজি।
যখন রুমির একুশ বছর, তাবরিজি তখন তাঁর শিষ্য হওয়ার ব্যাপারে প্রাথমিকভাবে জানান। পরে ভেবে দেখলেন, বয়সটা মোটেও তাঁর সাগরেদ হওয়ার জন্য উপযুক্ত নয়। তিনি আরো ষোল বছর অপেক্ষা করলেন।
তাবরিজির সাথে যে নিবিড় এবং গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে তা-ই রুমিকে তাঁর পূর্ণ শিষ্য হওয়ার ব্যাপারে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করে। একসময় রুমি তাঁর জন্মভূমিতে গুরুকে নিয়ে আসেন। এরপর এক নতুন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে তাঁদের।
তাবরিজি ভূমিহীন দরিদ্র ছিলেন। তার ওপর ছিলেন মারাত্মকভাবে সমাজ-বিরোধী। এতটাই মেজাজি ছিলেন যে, শিশুদের কাছে তাবরিজি রীতিমতো আতঙ্ক ছিল। এতকিছুর পরও বেশ স্ববিরোধীভাবে গড়ে ওঠা তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক শক্তিমত্তা ছিল অসাধারণ। কিন্তু তাঁর কাছে রুমি কেন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল এটি এক বড় প্রশ্ন! এই প্রশ্নের জবাব সবাই জানেনা এবং সবাই বুজবেওনা। কারণ সবাই তো সেই জ্ঞানের পেয়ালায় চুমুক দিতে পারেনি।
প্রথমত, রুমির ব্যক্তিত্ব ছিল সাংঘাতিকরকম আকর্ষণীয়। ধীরে ধীরে তাবরিজির কাছে রুমির ব্যক্তিত্ব একটি বড়সড় ইস্যু হয়ে ওঠে। অপরদিকে তাবরিজির গতিবিধি, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, শ্রেণিগত অবস্থান, ধর্মকর্ম কোনোকিছুই চলমান সমাজের জন্য অনুকূল ছিল না। এমনকি একপর্যায়ে তাবরিজিকে তাঁর ধর্মকর্মের জন্য হত্যার হুমকিও দেওয়া হয়। তাবরিজিকে বলে দেওয়া হয়, এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে, না হয় হত্যা করা হবে। সবমিলিয়ে তাবরিজিকে নিজের এলাকায় এনে ভয়াবহ ঝুঁকির মুখোমুখি হন রুমি। তবে গভীর সংকটে পড়ে তাবরিজিকে কোনিয়ায় ফিরে যেতে হয়।
সমাজের প্রথাগত সংস্কৃতির ভয়ে দমে যাননি রুমি। কিছুটা কৌশলের আশ্রয় নিতে হয় তাঁকে। তাই সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে স্বর্ণকারের সাথে যে কৌশল নিয়েছিলেন, একই পন্থা অনুসরণ করলেন রুমি তাবরিজির ব্যাপারেও। সামাজিক সীমাবদ্ধতার তুলনায় রুমি তাঁর শক্তির ব্যাপারে পুরোপুরি সচতেন ছিলেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তাবরিজিকে তাঁর পরিবারে তাঁর সমাজে যে করেই হোক স্থান দেবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রুমি তাঁর খুবই কাছের সেময়ে কিমিয়াকে শামস তাবরিজির সাথে বিয়ে দেন।
কিমিয়ার তখন পনেরো বছর বয়স। কথিত আছে, কিমিয়ার সাথে বিয়ে হওয়ার পর জীবনে প্রথম তাবরিজি কারো প্রেমে পড়েন। তাবরিজি আরো বেশি বিস্মিত মুগ্ধ হয়ে পড়ে রুমির প্রতি। শিষ্য বানাতে গিয়ে পরিস্থিতিতে পড়ে শিষ্যের কন্যাকে বিয়ের ঘটনা তাঁর জীবনে এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে যায়। বিয়ের মাত্র কয়েক মাস পর কিমিয়া হঠাত্ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। স্ত্রী বিয়োগের বিষয়টি গভীর আঘাত হানে তাবরিজির জীবনে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে রুমি-তাবরিজির সম্পর্কের প্রায় সমাপ্তি ঘটে।
কথিত আছে, কিমিয়ার চলে যাওয়ার খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাবরিজি অদৃশ্য হয়ে যান। যেন বনের পাখি বনেই ফিরে গেল। কিন্তু তাবরিজি আদৌ রহস্যময় হয়ে গেলেন, হারিয়ে গেলেন নাকি কোনো পক্ষ তাঁকে গুপ্ত-হত্যার মাধ্যমে দুনিয়া থেকে চিরতরে অদৃশ্য করে ফেলে। এমন গুঞ্জন বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তখন। পরবর্তীকালে এ নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হয়।
তাবরিজির এভাবে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া নিয়ে বহু গল্প থাকলেও, অনেকে এর বাস্তব কারণ তলিয়ে দেখাটাকেই বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
মৃত্যু – ১২৪৮ খৈয়, ইরান
No comments:
Post a Comment