ঊনত্রিশে সফর, রবিবার। উপস্থিত মুরীদ ও ভক্তদের উদ্দেশে হুজ্জাতুল ইসলাম পীরে কামেল হযরত ইমাম গায্যালী (রহঃ) এরশাদ করিলেন, যাহারা আপাদমস্তক মহব্বতে ডুবিয়া থাকেন তাহারাই সালেক। এমন কোন মুহূর্ত খালি যায় না যেই মুহূর্তে মহব্বতের জগত হইতে তাহাদের উপর প্রেমের বারিধারা বর্ধিত না হয়। আর যাহার উপর আলমে আসরার (রহস্যজগত) হইতে প্রতিক্ষণে হাজার অবস্থার সৃষ্টি হয় আর তিনি মত্ততার জগতে এমনভাবে বিভোর থাকেন যে, তাঁহার বুকের উপর যদি আঠার হাজার আলম চাপাইয়া দেওয়া হয় তবুও তিনি উহার খবর রাখেন না; এমন ব্যক্তিকেই আরেফ বলা হয়।
অতঃপর বলিলেন, আমি একবার সমরকন্দে এমন একজন বুযুর্গকে দেখি যিনি বিস্ময়ের জগতে ডুবিয়া রহিয়াছেন। আমি লোকের নিকট জিজ্ঞাসা করিলাম, কত বৎসর যাবত তিনি এই অবস্থায় আছেন? তাহারা বলিল, বিশ বৎসর যাবত আমরা তাঁহাকে একই অবস্থায় দেখিতেছি। যাহা হউক, আমি বেশ কিছুদিন তাঁহার নিকট রহিলাম। এক সময় আমি তাঁহাকে আলমে ছোহওতে অর্থাৎ হুশের অবস্থায় পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কতদিন যাবত আপনি এই অবস্থায় আছেন? কেহ আপনার নিকট আসা যাওয়া করিলে আপনি অবগত হইতে পারেন কিনা ?
তিনি বলিলেন, ওহে নাদান ! দরবেশ যখন প্রেম জগতে নিমজ্জিত থাকেন এবং তাহার উপর রহস্যের জোতি প্রকাশ পাইতে থাকে তখন তাহার কোন কিছুর খবরই থাকে না। এই অবস্থায় যদি তাহাকে টুকরা টুকরা করিয়াও ফেলা হয় তবু তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন না।
দরবেশগণ ! এই পথ তো জীবনবাজি লাগানোর পথ। যে এই পথে পা রাখিয়াছে সে জীবন লইয়া ফিরিতে পারে নাই। হযরত ইয়াহ্ইয়া (আঃ)-এর গলায় যখন শত্রুগণ ছুরি চালাইতে আরম্ভ করে, তখন তিনি ফরিয়াদ করার মনস্থ করেন প্রত্যাদেশ আসিল
“ইয়াহ্ইয়া ! তুমি যদি একটুও আহ উহ কর তবে আমার বন্ধুদের তালিকা হইতে তোমার নাম কাটিয়া দেওয়া হইবে।” তেমনি যখন হযরত যাকারিয়া (আঃ)-এর মাথায় করাত চলা আরম্ভ করিল, তখন তিনি ফরিয়াদ করিতে মনস্থ করেন। এনন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করিয়া বলিলেন, আল্লাহ বলিয়াছেন, “এই সময় যদি তোমার মুখ হইতে দুঃখ-যাতনাসূচক কোন একটি শব্দও বাহির হয়, তবে পয়গম্বরদের দপ্তর হইতে তোমার নাম খারিজ করিয়া দেওয়া হইবে।”
অতঃপর তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলিলেন, যে কেহ মহব্বতের দাবী করত বালা-মসিবতে পড়িয়া আল্লাহর দরবারে সহনশক্তি দাবী করে, সে সত্যিকারের প্রেমিক নহে। বরং সে তাহার দাবীতে মিথ্যাবাদী।
বন্ধুর পক্ষ হইতে যতই বিপদাপদই আসুক না কেন, তাহাতে যে ধৈর্যধারণ করে এবং বারংবার শুকরিয়া আদায় করে সে-ই যথার্থ বন্ধু। বন্ধুর দাবীতে সে সত্যবাদী এবং সাথে সাথে এই কথাও বলে যে, এই বাহানায় তিনি আমাকে স্মরণ করিয়াছেন। হযরত রাবেয়া বসরীর উপর যেদিন কোন বিপদাপদ হইত সেদিন তিনি আনন্দ গদগদ কণ্ঠে বলিতেন আজ আমার মাহবুব এই দুর্বলাকে স্মরণ করিয়াছেন। আর যেদিন তিনি বিপদমুক্ত থাকিতেন সেদিন খুব কাঁদিতেন আর বলিতেন, আজ আমি এমন কি অন্যায় করিলাম যেজন্য আমার বন্ধু আমাকে স্মরণ করেন নাই।
বন্ধুগণ ! সলুকুপন্থী হইল ঐ ব্যক্তি যে প্রেম-মহব্বতের দাবী করে, আর যে প্রেমিক হওয়ার দাবী করে এবং বন্ধুর দেওয়া দুঃখ-কষ্ট আনন্দের সাথে গ্রহণ না করে, সে আহলে মারেফাতের নিকট মিথ্যাবাদী।
অতঃপর ময়দানে গায়েব অর্থাৎ অদৃশ্যলোকের কথা উঠিলে পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, যেব্যক্তি পূর্ণতার স্তরে পৌঁছিয়া অকপট অবস্থায় দীর্ঘ দিন সেখানে আছেন তাহাকে অদৃশ্য হইতে আহ্বান করা হয়। ওসমান নামক আমার এক বন্ধু এবং পীর ভাই ছিলেন। তিনি যখন আধ্যাত্মিকতার চরম শিখরে পৌঁছেন তখন এক অদৃশ্য লোক তাঁহার সাথে সাক্ষাত করিয়াছিলেন। একদিন তিনি তাঁহার বন্ধু-বান্ধবের সমাবেশে বসা ছিলেন। আমিও সেখানে ছিলাম। আমরা সকলে শুনিতে পাইলাম কে যেন বলিলেন, হে শায়খ ওসমান। এদিকে আস। আওয়ায় পাওয়ার সাথে সাথে তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং যেদিক হইতে আওয়ায আসিতেছিল সেদিকে রওয়ানা হইলেন। মুহূর্তের মধ্যে তিনি আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে চলিয়া গেলেন। ইহার পর আমরা তাঁহার আর কোন সন্ধান পাই নাই।
একবার আমি এবং আমার এক বন্ধু কাবার তাওয়াফ করিতেছিলাম। শায়খ ওসমান নামক একজন বুযুর্গের সন্ধান পাইয়া আমরা তাঁহার পিছনে পিছনে চলিলাম। তিনি যেদিকে যাইতেছিলেন আমরাও সেদিকে যাইতেছিলাম। তিনি আমাদের উদ্দেশ্য বুঝিতে পারিলেন এবং আমাদের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, আমার পিছনে পিছনে আসিলে কি হইবে ? বরং আমি যাহা কিছু করি তোমরাও তাহা কর । আমরা জিজ্ঞাসা করিলাম, হযরত আপনি কি করেন ?
তিনি বলিলেন, আমি প্রত্যেক দিন হাজার বার কোরআন খতম করি।
আমাদের মনে খটকা লাগিল যে, ইহা কিভাবে সম্ভব হইতে পারে। তিনি আমাদের মনের অবস্থা বুঝিতে পারিয়া মাথা উঁচু করিয়া বলিলেন, হাঁ, অক্ষরে অক্ষরে তেলাওয়াত করিয়াই হাজার বার কোরআন খতম করি। আমরা বুঝিতে পারিলাম, যাহা মানুষের বোধগম্যের বাহিরে তাহাই কারামত। হাজার বার কোরআন খতম করা এই বুযুর্গের খাস কারামত ছিল।
অতঃপর মজলিসের আদব সম্বন্ধে আলোচনা আরম্ভ হওয়ায় এরশাদ করিলেন, মজলিসের যেখানে স্থান পাইবে সেখানেই বসিবে এবং উহাই তোমার বসার স্থান। একবার হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরাম দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া বসা ছিলেন। এমন সময় সেখানে তিন ব্যক্তি উপস্থিত হইলেন। একজন সেই মজলিসে স্থান পাইয়া বসিলেন। দ্বিতীয়জন স্থান না পাইয়া পিছনে বসিলেন। তৃতীয়জন স্থান না পাইয়া চলিয়া গেলেন। এক মুহূর্ত অতিবাহিত না হইতেই হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করিয়া বলিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন, যেব্যক্তি আসিয়া বৃত্তের মধ্যে স্থান পাইয়া বসিয়াছে আমি তাহাকে আমার আশ্রয়ে স্থান দিয়াছি। আর যে স্থান না পাইয়া লজ্জার সাথে বৃত্তের বাহিরে বসিয়াছে আমিও তাহার নিকট লজ্জিত। পরকালে তাহার কোন অসুবিধা হইবে না। আর যেব্যক্তি স্থান না পাইয়া মুখ ফিরাইয়া চলিয়া গেল, আমিও তাহার দিক হইতে রহমতের মুখ ফিরাইয়া লইলাম।
সুতরাং মজলিসে উপস্থিত হইয়া যেখানে স্থান পাইবে সেখানেই বসিবে । বৃত্তের মধ্যে স্থান না পাইলে পিছনে বসিবে। কেননা, উহাই অগন্তুকের বসার স্থান। সব সময় বৃত্তের মধ্যে বসার চেষ্টা করিবে না।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে দিন-রাত কখন হয় কিছুই বলিতে পারি না। তোমার জন্য আল্লাহ আজ আমাকে এই বাস্তব জগতে ফিরাইয়া দিয়াছেন।
বন্ধু, তুমি ফিরিয়া যাও ! আল্লাহ এই কষ্টের প্রতিদান অবশ্যই তোমাকে দান করিবেন। স্মরণ রাখিও, তুমি যখন এই পথে পা রাখিয়াছ, তখন পৃথিবী ও পার্থিব বস্তুর প্রতি কখনও আকৃষ্ট হইও না, লোক সংস্রব পরিহার করিয়া চলিও। তুমি যাহা কিছু উপার্জন করিবে বা উপঢৌকন হিসাবে পাইবে, উহা কখনও সঞ্চয় করিয়া রাখিবে না; দান করিয়া দিবে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হইলে কষ্ট পাইবে। এই কথা বলিয়াই তিনি আবার বিস্ময়ের জগতে ডুবিয়া গেলেন ।
-----------
No comments:
Post a Comment