ওলীদের কাশফ ও কারামত (মাজালিসে গাযযালী - ১৫)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

15 পঞ্চদশ মজলিস


ওলীদের কাশফ ও কারামত

বিশে রবিউল আউয়াল, শনিবার। কাবা শরীফের ফযীলত সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।

হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হযরত ইবরাহীম (আঃ) কাবা গৃহ নির্মাণ করার পর আল্লাহ তাআলা আদেশ করিলেন, হে বন্ধু! কাবা গৃহ যিয়ারত করার জন্য আমার বান্দাদিগকে আহ্বান করুন।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) আরয করিলেন, হে আল্লাহ! আপনার বান্দাগণ আমার আহ্বান কি করিয়া শুনিবে?

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, আহ্বান করা আপনার কর্তব্য। কিভাবে আপনার আহ্বান তাহাদের কর্ণগোচর হইবে সে ব্যবস্থা আমি করিব।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) কোবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করিয়া বলিলেন-

হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ আমাকে কাবা নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়াছেন। আমি তাহা নির্মাণ করিয়াছি। তারপর তোমাদিগকে আহ্বান করার নির্দেশ দিয়াছেন। তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দাও এবং কাবার যিয়ারত কর। আল্লাহ তোমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।


যাহারা বাপের ঔরসে ও মায়ের পেটে ছিল, আল্লাহ স্বীয় কুদরত দ্বারা এই আহ্বান তাহাদের কানে পৌছাইয়া দিলেন। ঐদিন যেব্যক্তি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর আহ্বান শুনিয়া একবার লাব্বায়েক বলিয়াছিল সে একবার হজ্জ আদায় করিয়াছে, যে দুই বা ততোধিকবার লাব্বায়েক বলিয়াছে সে দুই বা ততোধিকবারই হজ্জ করিয়াছে বা করিবে। আর যে লাব্বায়েক বলে নাই সে হজ্জ করিতে পারিবে না।

কাবা যিয়ারত করার পুণ্য যেকোন সময়ই ছিল এবং থাকিবে। যাহারা এই আহ্বানে সাড়া দিয়াছে তাহারাই হজ্জ করার ভাগ্যে ভাগ্যবান হইবে।

তাহার পর বলিলেন, হজ্জ ও অন্যান্য সময়কার তাওয়াফ শেষ করিয়া লোক যখন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করার জন্য যাইত, তখন সেখানে এক বৃদ্ধা খোঁড়া মহিলাকে দেখিতে পাইত। বৃদ্ধা মহিলার কাজ ছিল, যাহারা সায়ী করিত তাহাদের কাপড়-চোপড় নিজের দায়িত্বে রাখা।

একবার এক ভারতীয় হজ্জ করিতে গিয়। সেই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখিয়া বলিল, তুমি তো অমুক স্থানে থাক: আমি তোমাকে চিনি।

মহিলা বলিল, আমি অন্য কোথাও থাকি না। সারা বৎসর এখানে থাকিয়া লোকদিগকে সায়ী করিতে সাহায্য করি।

ইহার পর মাখদুম জাঁহা বলিলেন-

যেব্যক্তি "আমি হাযির! হে আল্লাহ আমি হাযির। তোমার কোন শরীফ নাই। আমি হাযির। সমস্ত প্রশংসা এবং নেয়ামত তোমারই। তোমারই রাজত্ব। তোমার কোন অংশীদার নাই" বলে, ইহা সেই আহ্বানেরই জবাব।

যাহারা কাবার যিয়ারত করে তাহারা ঐ আহ্বান শুনিয়াছিল এবং কবুল করিয়াছিল।

তারপর বলিলেন, আরববাসী দুইটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথম- প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, কোন মতেই ওয়াদার খেলাফ না করা। দ্বিতীয় মেহমানদারী করা। মেহমান' যাহার বাড়ীতে উপস্থিত হউক না কেন, কোন মতেই তাহাকে অন্যের মেহমান হইতে দেয় না।

তাহারা দাস-দাসীদিগকে নির্দেশ দিয়া রাখে, আমার অনুপস্থিতিতে কোন মেহমান আসিলে সে যেন ফিরিয়া না যায় এবং কোনমতেই যেন তাহার অনাদর করা না হয়।

বর্ণিত আছে, একবার হযরত খিযির (আঃ)-এর সাথে হযরত মূসা (আঃ)-এর সাক্ষাত হয়। উভয়ে এক সাথে কোন এক গ্রামে গিয়া উপস্থিত হন। উভয়ে ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাওয়ার মত কোন বস্তু তাঁহাদের সাথে না থাকায় তাঁহারা গ্রামবাসীর নিকট খাবার চাহিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহাদিগকে আহার্য দিতে রাযী হইল না।

এই কথা আরবময় প্রচার হইয়া গেল যে, অমুক গ্রামে আল্লাহর দুই জন নবী গিয়াছিলেন এবং ক্ষুধায় কাতর হইয়া গ্রামবাসীর নিকট খাদ্য চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহাদের কথায় কান দেয় নাই। তাঁহারা ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই রাত কাটান এবং পর দিন সেখান হইতে চলিয়া যান।

হতভাগার দল বিফল মনোরথ হইয়া তাহাদের ধন-সম্পদসহ চলিয়া গেল। কেয়ামত পর্যন্ত তাহাদের এই কলঙ্ক উজ্জ্বল হইয়া রহিয়া গেল।

তারপর বলিলেন, মক্কার কাফেরদের অত্যাচার-উৎপীড়ন যখন চরমে পৌঁছিল তখন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদিগকে হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ যখন মক্কা ত্যাগ করিয়া মদীনায় যাওয়া আরম্ভ করিলেন তখন কাফেরগণ মক্কার চারিদিকে শূলের ব্যবস্থা করিয়া রাখিল। কোন মুসলমানকে মক্কা হইতে মদীনা যাইতে দেখিলেই ধরিয়া আনিয়া শূলে বিদ্ধ করিত। এই চরম অবস্থার মধ্যেও তাঁহারা হিজরত অব্যাহত রাখিলেন। সোবহানাল্লাহ! কেমন তাঁহাদের মন বা আর কেমন মুসলমান!


সাহাবাগণ মদীনায় আগমন করার পর আর্থিক ও শারীরিক কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ইহা দেখিয়া হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) খুব চিন্তিত হইয়া পড়িলেন এবং কি করা যায় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করিতে লাগিলেন।


হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মদীনাবাসীদিগকে সমবেত করিয়া এরশাদ করিলেন, যদি তোমরা চিন্তা-ভাবনা এবং পরামর্শ করিয়া উত্তর দাও তবে আমি তোমাদের নিকট একটি কথা বলিব।


সকলে একবাক্যে আরয করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্য আমাদের পিতা-মাতা কোরবান হউক, এরশাদ করুন।

এরশাদ করিলেন, মক্কাবাসী মুসলমানদের জন্য আল্লাহ হিজরত ফরয করিয়াছেন। তাঁহারা আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থ বাড়ী-ঘর, ধন-সম্পদ ছাড়িয়া রিক্ত হস্তে এখানে আসিয়াছেন। এখন তাহাদের জীবিকানির্বাহের কোন পথ খুঁজিয়া বাহির করা দরকার।


মদীনাবাসী সভাস্থল ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিতে লাগিলেন। প্রথমে তাঁহারা বলিলেন, আমাদের যাহা কিছু আছে সবই আমাদের মুহাজির ভাইদিগকে দান করিয়া দিব। তারপর আবার বলিলেন, আমাদের জীবিকানির্বাহের জন্যও কিছু রাখা দরকার। অতঃপর সকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন যে. আমাদের সম্পত্তির অর্ধেক তাঁহাদিগকে দিব।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর তাঁহারা হাসি-খুশী মুখে দরবারে নববীতে উপস্থিত হইয়া আরয করিলেন, আমরা সকলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, আমাদের নিকট যাহা কিছু আছে উহার অর্ধেক আমাদের মুহাজির ভাইদিগকে দান করিব।

এই সিদ্ধান্তের পর আনসারগণ মুহাজিরদিগকে তাঁহাদের সম্পত্তির অর্ধেক দান করিলেন। সুতরাং স্মরণ রাখিও, তোমার অন্তর যদি অর্থ বুঝে তবে তুমি ইহার যথার্থতা বুঝিতে পারিবে যে, পৃথিবী ত্যাগ না করিলে কেহ পৃথিবীতে কৃতকার্য হইতে পারে না।

আল্লাহ তাআলা আনসারদের প্রশংসায় বলিয়াছেন: "হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর সাহায্যকারী হও। যেমন মরিয়ম পুত্র ঈসা বলিয়াছেন, আল্লাহর কাজে কে আমার সাহায্যকারী হইবে? হাওয়ারীরা বলিল,

আমরা আল্লাহর কাজে সাহায্যকারী। বনী ইসরাঈলের একটি সম্প্রদায় ঈমান আনিল

এবং আর একটি দল কাস্ত্রে হইল। আমি ঈমানদারদিগকে তাহাদের শত্রুদের

উপর সাহায্য করিয়াছি। ফলে তাহারা জয়যুক্ত হইল। ঐ সময় যেব্যক্তি এক সের গম দিয়া মুহাজিরদিগকে সাহায্য করিয়াছেন, আজ অহুদ পরিমাণ স্বর্ণ দান করিলেও সেই পরিমাণ পুণ্য সঞ্চয় হইবে না। আনসারগণ মুহাজিরদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, তাহার তুলনা কোন দিন কোন মতেই হইতে পারে না। এই পুণ্যময় ত্যাগ তাঁহারা ব্যতীত আর কেহই স্বীকার করিতে পারে নাই। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন-

লোকেরা যদি এক পথ অনুসরণ করে এবং আনসারগণ অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে আমি আনসারদের পথই অনুসরণ করিব।


No comments:

__