সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য
তৃতীয় রবিউল আউয়াল, বুধবার। হযরত পীর ও মুরশিদ (ইমাম গাজ্জালী রহঃ) জামে মসজিদে বহু লোকের সমাবেশে উপবিষ্ট ছিলেন। এই জনতার মধ্য হইতে এক ব্যক্তি দাঁড়াইয়া বলিলেন, আমার ইচ্ছা আমি হুযুরের দাসদের একজন হিসাবে পরিগণিত হই। কয়েকবার তিনি এই কথা বলার পর পীর ও মুরশিদ তাহাকে বায়আত করিলেন। অতঃপর সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য সম্বন্ধে কথাবার্তা আরম্ভ হইল। এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রত্যেক লোকের জন্যই কি সৌভাগ্য অথবা দুর্ভাগ্য লিখিত হইয়াছে।
মাখদুম জাঁহা উত্তর দিলেন, প্রত্যেক ব্যক্তির সৌভাগ্য তাহার মায়ের গর্ভে থাকাকালীন অবস্থায় নির্ধারিত করা হইয়াছে। যতক্ষণ পর্যন্ত সেই সৌভাগ্য তাহার পক্ষে না বর্তায় ততক্ষণ পর্যন্ত সে শান্তি পায় না। যাহার ভাগ্যে দুর্ভাগ্য লিখিত রহিয়াছে তাহা মায়ের উদরে থাকা অবস্থায়ই লিখিত হইয়াছে। এই হতভাগ্যের দুর্ভাগ্য আলেমদের এলম এবং চিকিৎসকদের চিকিৎসায় কখনও দূর হইতে পারে না।
হুযুর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন : মায়ের উদরে থাকাকালীন যাহাকে ভাগ্যবান করা হইয়াছে সে-ই ভাগ্যবান। পক্ষান্তরে মায়ের উদরে যাহাকে দুর্ভাগা লেখা হইয়াছে সে-ই দুর্ভাগা।
আল্লাহ যাহাকে ইচ্ছা সৌভাগ্যশালী এবং যাহাকে ইচ্ছা দুর্ভাগা করিয়া রাখিয়াছেন। যেমন, আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন, “আমি তোমাদের কিসমত তোমাদের মধ্যে বণ্টন করিয়া রাখিয়াছি।"
যে পরিমাণ নেকী যেব্যক্তির জন্য নির্ধারণ করা হইয়াছে উহা তাহার দ্বারা কার্যকরী হয় এবং উহা করার জন্য সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ থাকে। তাহার প্রতিটি কাজ ও কথায় নেকী প্রকাশ পায়; সমস্ত অন্যায়-অত্যাচার তাহার নিকট হইতে দূর হইয়া যায়। সে তাহার সৌভাগ্যের প্রতিদান দিতে থাকে। অর্থাৎ পুণ্যের কাজে আত্মনিয়োগ করে।
তারপর বলিলেন, আবার এমনও দেখা গিয়াছে যে, বহু লোক নিজেকে পাপী এবং দুর্ভাগ্য বলিয়া মনে করে। ইহা জানা সত্ত্বেও দৃঢ়তার সাথে ভাল হওয়ার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যায় যেন সে তাহার লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিতে পারে। অর্থাৎ, সে আল্লাহর নিকট গ্রহণযোগ্য হওয়ার মানসে কোন কামেল পীরের নিকট আত্মসমর্পণ করে। ইহার প্রতি ইঙ্গিত করিয়াই বলা হইয়াছে :
অক্ষম পিঁপড়া কাবায় পৌঁছার চিন্তায় বিভোর। পরিশেষে সে কবুতরের পায়ে জড়াইয়া পড়িল। ফলে সে উহার লক্ষ্যস্থল কাবায় গিয়া পৌছিল।
অতঃপর বলিলেন, আল্লাহ তাআলা অনাদিকালেই বান্দার এই সৌভাগ্য ও দুর্ভাগ্য নির্ধারণ করিয়া রাখিয়াছেন। আর ইহাও কেহ দৃঢ়তার সাথে বলিতে পারে না, কে নেকবখত আর কে বদবখত। তবে পুণ্যের কাজ করা, সৎ পথে চলা নেকবখতার এবং শরীয়তের বিরোধিতা করা, পাপে আত্মনিয়োগ করা বদবখতীর লক্ষণ
তারপর বলিলেন, এমন বহু লোক আছে, পবিত্র মক্কা শরীফে বসবাস করা সত্ত্বেও কোন দিন তাহারা কাবার যিয়ারত করে নাই বা কোন বৎসর হজ্জও করে নাই। কারণ, এই পবিত্র কাজ করা তাহাদের ভাগ্যে লিখিত নাই। তাই তাহারা এই কাজ করার চিন্তাও করে না। ইহারা কাবার মান-মর্যাদা কি অবগত হইতে পারে? হে কাবা ! তুমি আমার নিকটবর্তী ! অথচ আমি তোমার প্রতি উদাসীন। সত্য বলিতে কি, এই জাতীয় মক্কাবাসী কাবার মর্যাদা কি বুঝিবে?
দুনিয়ায় বহু লোক অধিক আগ্রহের সাথে কাবার যিয়ারত করার জন্য রওয়ানা হন। এই সমস্ত আগ্রহী লোকদের মধ্যে কেহ কেহ মক্কা শরীফে পৌঁছিয়া কাবার দর্শন লাভ করত ধন্য হন। আবার কেহ বা পথিমধ্যেই ইনতেকাল করেন। যাহারা পথিমধ্যে ইনতেকাল করেন, প্রতি বৎসর তাহাদের নামে একটি করিয়া কবুল হজ্জ লিখিত হইয়া থাকে।
হে কাবার অধিপতি ! আমাকেও ঐ সমস্ত লোকের মত পথিক মনে করিয়া গ্রহণ করার যোগ্যতা দান করুন। আমি হজ্জ করি নাই বটে, কিন্তু ঐ পথে চলিয়াছি।
অতঃপর বলিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর যুগে মদীনা শরীফে চারিশত মোনাফেক ছিল। সাহাবায়ে কেরাম অনেক কাজ সুসম্পন্ন করিতেই তাহাদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হইতেন। এই কারণে তাঁহারা দুঃখিত এবং মনঃক্ষুণ্ণ থাকিতেন।
দ্বীনে মুহাম্মদী প্রচার করার মানসে যখনই সাহাবাগণ কাফেরদের সাথে জিহাদ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করিতেন, তখনই এই সমস্ত মোনাফেক গোপনে কাফেরদিগকে সংবাদ পরিবেশন করিত। সাহাবায়ে কেরাম যখন এই অবস্থা বুঝিতে পারিলেন, তখন পশ্চিম দিকে যুদ্ধ করার হইলে পূর্ব দিকে রওয়ানা হইতেন। দুই তিন মনযিল পূর্ব দিকে চলার পর আবার গন্তব্যস্থল পশ্চিম দিকে রওয়ানা হইতেন। সাহাবায়ে কেরামের এই অবস্থা দেখিয়া মোনাফেকরা হতভম্ব হইয়া যাইত এবং যথার্থ খবর পরিবেশন করিতে সক্ষম হইত না।
বাদশাহের জন্য এরূপ জঙ্গী চাল সুন্নত। সাহাবায়ে কেরাম যে কাজ করার মনস্থ করিতেন, মোনাফেকরা সেই কাজের ক্ষতি সাধন করার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া যাইত। সাহাবায়ে কেরামের কাজ এই কারণেই কাফেরদের নিকট আর গোপন থাকিত না। অথচ এই মোনাফেকরা প্রকাশ্যে জামাআতের সাথে নামায পড়িত, রমযানের রোযা রাখিত আর প্রত্যেকেই বলিত; আমি একজন মুসলমান। পবিত্র কোরআন ইহাদের সম্বন্ধে বলে : মোমেনদের সাথে সাক্ষাত হইলে তাহারা বলে আমরাও মোমেন। আর যখন শয়তানের নেতার সাথে মিলিত হয়, তখন বলে, আমরা তো মুসলমানদের সাথে ঠাট্টা করি।
কোরআনে ইহাদের সম্বন্ধে কঠোর আযাবের কথা উল্লেখ করা হইয়াছে। আল্লাহ তাআলা বলেন :
“নিশ্চয় মোনাফেক সম্প্রদায় অগ্নির শেষ স্তরে থাকিবে।”
আর এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, মানুষের মধ্যে যেমন নেকবখত ও বদবখত আছে, তেমনি মাটিও বদবখত ও নেকবখত হয় নাকি?
হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, মাটিও নেকবখত এবং বদবখত হয়। যে মাটি উর্বর, সে মাটির গাছ প্রচুর পরিমাণে ফসল দেয়, যে মাটি প্রচুর পরিমাণে ফলস দেয় সেই মাটি নেকবখত। আর যে মাটি অনুর্বর, ফসল দেয় না, উহা বদবখত। নেকবখত ও বদবখত সমস্ত সৃষ্টির মধ্যেই আছে।
মোটকথা, আল্লাহ যাহাকে নেকবখত বা ভাগ্যবান করিয়াছেন সে শয়তানের ফাঁদে পড়িয়া কখনও দুর্ভাগা হইতে পারে না। আর যাহাকে আল্লাহ দুর্ভাগা করিয়াছেন সে দুনিয়ায় ওলীদের চেষ্টায়ও ভাগ্যবান হইতে পারে না।
No comments:
Post a Comment