সৃষ্টি রহস্য (মাজালিসে গাযযালী- ২)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২ - দ্বিতীয় মজলিস 
সৃষ্টি রহস্য-

সাতাশে সফর, শুক্রবার। আমি দরবার শরীফে উপস্থিত হইয়া আরয করিলাম, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি  ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, আল্লাহ তাঁহার সৃষ্টিকে অন্ধকারে সৃষ্টি করিয়া পরে স্বীয় নূর দ্বারা আলোকিত করেন। ইহার অর্থ বুঝিতে পারিলাম না।


হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, যাবতীয় কিছুর সৃষ্টি অন্ধকারে হইয়াছিল। পরে আল্লাহর নূরে সেইসব আলোকিত হয়; প্রত্যেকে স্বীয় ক্ষমতানুযায়ী সেই নূরের জ্যোতি গ্রহণ করিয়া আলোকোজ্জ্বল হয়। সৃষ্টিতে যে নূর আছে তাহা আল্লাহর নূর হইতে বিচ্ছিন্ন নহে। যেমন সূর্যোদয় হইলে রাতের অন্ধকার দূর হইয়া আলোকোজ্জ্বল দিন প্রকাশ পায়। কিন্তু এই আলো আংশিক ও খণ্ডিত নহে। এমনও নহে যে, অন্ধকার বাড়িয়া যায় অথবা অন্ধকার আলোময় হইয়া যায়, অথবা স্বয়ং সূর্যের আলোর ঘাটতি হয়। অন্ধকার এক বস্তু, আলো অন্য বস্তু; বরং একটি অন্যটির বিপরীত। আবার সূর্যোদয়ের পর চাঁদের আলো চলিয়া যায়। কোন কোন তারকা চন্দ্রের আলোর প্রভাবে স্তিমিত হইয়া পড়ে। ইহার পর বলিলেন, যেমন হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, পুণ্যশীলদের পুণ্য আল্লাহর নৈকট্য লাভকারীদের জন্য পাপস্বরূপ। পাপ এবং পুণ্য সম্পূর্ণরূপে বিপরীতধর্মী। তাই পুণ্য কিভাবে পাপে পরিণত হয় ?

উত্তর এই যে, পুণ্যবানদের পুণ্য নৈকট্য লাভকারীদের পাপ এই অর্থে যে, পুণ্যবানদের পুণ্য বড় এবং নৈকট্য লাভকারীদের পুণ্য উহার চেয়েও অধিক শ্রেষ্ঠ। নৈকট্য লাভকারীগণ যখন মর্যাদায় শ্রেষ্ঠ, তখন তাহাদের পক্ষে তাহাদের মর্যাদার দিক হইতে সাইয়্যেআহকে পাপ বলা হইয়াছে। যদিও তাহাদের পদমর্যাদায় স্বয়ং হাসান অর্থাৎ সুন্দর। কিন্তু অধিক সুন্দরের দিক হইতে কম মর্যাদাসম্পন্ন। এদিকে ইঙ্গিত করিয়াই হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, পুণ্যবানদের পুণ্য নৈকট্য লাভকারীদের জন্য পাপস্বরূপ। আল্লাহ অধিক জ্ঞাত।


ইহার পর এরশাদ করিলেন, হযরত আদম (আঃ) এই ভুলই করিয়াছিলেন। কারণ, তিনি শ্রেষ্ঠ হইতেও শ্রেষ্ঠতর। সেই কাহিনী হইল, আল্লাহ তাআলা আদম (আঃ)-কে নির্দেশ দিলেন, হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে আরামে 'বসবাস কর এবং বেহেশতের নেয়ামত যাহা ইচ্ছা পানাহার কর। কিন্তু ঐ বৃক্ষের নিকট যাইও না। (যদি যাও) তবে উভয়ে নাফরমান বলিয়া পরিগণিত হইবে।

একমাত্র গম ব্যতীত বেহেশতের যাবতীয় কিছু হযরত আদম ও হাওয়া (আঃ)-এর জন্য আল্লাহ মোবাহ বা বৈধ করিয়া দিয়াছিলেন। হযরত আদম (আঃ) যখন বেহেশতে প্রবেশ করেন, তখন নিষিদ্ধ বৃক্ষটি তাঁহার যতটা ভাল মনে হইল, অন্য কোন নেয়ামতই ততটা পছন্দ হইল না। নিষিদ্ধ গাছের প্রতি দৃষ্টি পড়িতেই তাহা তাঁহার নিকট খুব ভাল মনে হইতে লাগিল।

হাদীস শরীফে আছে, মানব চরিত্রের বৈশিষ্ট্য হইল, যে বস্তু হইতে মানুষকে বিরত থাকিতে বলা হয় উহার প্রতিই তাহার আসক্তি বেশী থাকে, উহার প্রতিই সে বেশী আকৃষ্ট হয়৷


হযরত আদম (আঃ) স্বীয় এজতেহাদ ও শয়তানের প্ররোচনায় পড়িয়া সেই নিষিদ্ধ বস্তুই ভক্ষণ করিলেন। যে গাছের ফল খাইতে নিষেধ করা হইয়াছিল । অবশ্য ঠিক ঐ গাছের ফল খান নাই। কারণ, বেহেশতে ঐ একই জাতীয় গাছ বহু প্রকারের ছিল

তিনি যখন ঐ গাছের ফল খাওয়ার মনস্থ করিলেন, তখন ভাবিলেন, আমাকে বিশেষ একটি গাছের ফল খাইতে নিষেধ করা হইয়াছে। কিন্তু ঐ জাতীয় অন্যান্য গাছের ফলও যে খাইতে পারিব না, এমন নির্দেশ তো দেওয়া হয় নাই। সুতরাং তিনি সেই ফল ভক্ষণ করিলেন।

তিনি যে এজতেহাদ বা গবেষণা করিলেন, ইহাই ভুল করিলেন। তাঁহার উচিত ছিল সতর্ক থাকা এবং জিবরাঈল (আঃ)-এর আসার অপেক্ষায় থাকা যে, তিনি এই সম্বন্ধে আল্লাহর কোন নির্দেশ আমাকে দেন কিনা ? তদুপরি ইহা খাওয়ার এমন কি প্রয়োজনই বা ছিল ? খাওয়ার মত বস্তুর কোন অভাবই তো বেহেশতে ছিল না। সুতরাং ওযর আপত্তি পেশ করার মত কোন কিছুই তাঁহার ছিল না।

যখন তিনি নিজের রায় মোতাবেক এবং শয়তানের প্ররোচনায় উহা ভক্ষণ করিলেন, তখন তাঁহার যে শ্রেষ্ঠ মর্যাদা ছিল উহা কমিয়া গেল। আদম (আঃ) আল্লাহর ইচ্ছা বুঝিতে অক্ষম হইল। শাস্তিস্বরূপ মাথার তাজ ও দেহের আবরণ খুলিয়া লওয়া সর্বসাধারণের জন্য শরীরের যে অংশ আবৃত্ত করিয়া রাখার নির্দেশ রহিয়াছে, হজরত আদম (আঃ) শরীরের সেই অংশ কখনও দেখেন নাই । তাঁহার নাভির নিচে এক প্রকার নূর ছিল । কখনও নাভির নিচে দৃষ্টিপাত করিলে সেই নূর নাভির নিম্নাংশ দেখায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিত। যখন সেই নূরানী পর্দা উঠাইয়া লওয়া হইল তখন তিনি দেহের নিম্নাংশ দেখিতে পাইলেন এবং লজ্জা ও ভয় পাইতে লাগিলেন যে, হয়ত ফেরেশতাগণ আমার এই অনাবৃত দেহাংশ দেখিয়া ফেলিবেন। তখন তিনি ভয় ও লজ্জায় বেহেশতময় দৌড়াদৌড়ি আরম্ভ করিলেন এবং লজ্জা ঢাকার জন্য এই গাছ সেই গাছের নিকট পাতা ভিক্ষা চাহিতে লাগিলেন। আল্লাহ তখন এরশাদ করিলেন, হে আদম! তুমি আমার দৃষ্টি হইতে পলায়ন ক্ষরিয়া ফিরিতেছ ? আদম (আঃ) আরয করিলেন, প্রভু ! কখনও না। বরং আমি কোন্ শরমে আপনাকে মুখ দেখাইব?

আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, বেহেশত হইতে বাহির হইয়া যাও। তিনি যখন বেহেশত দ্বারে পৌঁছিলেন, তখন তাঁহার লজ্জা নিবারণ করার জন্য ফলের গাছ পাতা দান করিল। মোট কথা, হযরত আদম (আঃ)-কে সরন্দ্বীপ এবং হযরত হাওয়া (আঃ)-কে জেদ্দায় নামাইয়া দেওয়া হইল।


ইমাম যাহেদ (রঃ) বলেন, সরন্দ্বীপ এবং জেদ্দার মধ্যে দূরত্ব চৌদ্দ শত মাইল। অতঃপর এই দুনিয়াই হইল তাঁহাদের আবাসভূমি। আল্লাহ তাআলা বলেন, পৃথিবী তোমাদের বাসস্থান। এক নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোমাদের জন্য পৃথিবীতে উপকার নিহিত রহিয়াছে। অতঃপর পৃথিবীর রীতিনীতি মোতাবেক কাজ আরম্ভ। 

পার্থিব রাজা-বাদশাহদের নিয়ম হইল, যখন কোন বাদশাহর কর্মচারী অন্যায় করে তখন তাহাকে সম্মুখ হইতে দূর করিয়া দিয়া বন্দী খানায় পাঠাইয়া দেন। তাই যখন হযরত আদম (আঃ) ভুল করিলেন, তখন আল্লাহ তাঁহাকে শাস্তি দেওয়ার মানসে কয়েদখানাস্বরূপ পৃথিবীতে পাঠাইয়া দিলেন।


এই পৃথিবী মো’মেনদের জন্য বন্দীশালা এবং কাফেরদের জন্য জান্নাত। এদিকে ইঙ্গিত করিয়াই কোন বুযুর্গ বলিয়াছেন-

দৈত্য-দানব ও শয়তানের জন্য এই পৃথিবী আবাসগৃহ। দোস্ত ও মোমেনদের জন্য বন্দীখানা। মোমেনদের জন্য পৃথিবীর এই সমস্ত বস্তু রাখিয়াছেন যাহাতে তাহারা দুনিয়ার প্রয়োজন মনে না করে। দুনিয়ার নেয়ামতকেও যেন অগ্রাহ্য করিয়া চলে। আল্লাহ যেন তোমাদিগকে এই সমস্ত চিন্তা-ভাবনা হইতে নিরাপদ রাখেন।

--------------

No comments:

__