ওলীদের কাশফ ও কারামত (মাজালিসে গাযযালী- ১)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
১ - প্রথম মজলিস

ওলীদের কাশফ ও কারামত– ১
ছাব্বিশে সফর, বৃহস্পতিবার। পবিত্র দরবারে বহু আলেম-ওলামা এবং আল্লাহর বিশিষ্ট বান্দাদের উপস্থিতিতে ওলীদের কাশফ ও কারামত সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল । হুজ্জাতুল ইসলাম ইমাম গায্যালী (রঃ) বলিলেন-
ভাইসব ! শায়খের কলবের শক্তি এবং পবিত্রতা এই পরিমাণ হইতে হইবে যে, যখন কোন লোক তাহার নিকট আল্লাহর ওয়াস্তে বায়আত গ্রহণ করিতে আসে তখন প্রথমেই শায়খ তাহার বাতেনী দৃষ্টি দ্বারা বায়আত গ্রহণে আগত ব্যক্তির বক্ষদেশে পৃথিবীর প্রতি যেই মায়া-মোহ রহিয়াছে উহা দূর করিয়া দিবেন, যেন তাহার মাঝে হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ-লালসা, দুনিয়ার প্রতি আসক্তি এবং মায়া-মোহ কোন কিছুই অবশিষ্ট না থাকে। এই প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর তাহাকে বায়আত করিবেন এবং আল্লাহপ্রাপ্তির পথে আনিয়া দাঁড় করাইবেন।
এই শক্তি যখন শায়খের মধ্যে থাকিবে না তখন অবশ্যই মনে করিবে, এই পীর ও মুরীদ উভয়েই গোমরাহীর জঙ্গলে উদ্দেশ্যহীনভাবে দিশাহারা হইয়া ঘুরাফেরা করিবে। কোন মতেই তাহারা মনযিলে মকসুদে পৌছিতে সক্ষম হইবে না।

তিনি বলিলেন, একবার এক বুযুর্গ দেশ পর্যটনে বাহির হইলেন। বহু দেশ ঘুরাফেরা করার পর তিনি বদখশান আসিয়া পৌঁছেন। এই বুযুর্গ বলেন, এখানে 'আসিয়া আমি এক বুযুর্গের খানকায় উপস্থিত হই। এই বুযুর্গ এমনই আল্লাহ ওয়ালা এবং খোদাভীরু ছিলেন যে, তা বর্ণনাতীত। আমি তাঁহাকে সালাম করিলাম। তিনি হাসিমুখে সালামের উত্তর দিয়া তাঁহার পাশেই আমাকে বসাইলেন । আমি তাঁহার খেদমতে কিছু দিন থাকার মনস্থ করিলাম ।
তিনি প্রতিদিন রোযা রাখিতেন। ইফতারের সময় হইলে গায়েব হইতে তাঁহার নিকট দুইখানি রুটি আসিত। তিনি একখানি দ্বারা ইফতার করিতেন এবং অন্য রুটিখানি আমাকে দিতেন। একদিন এই বুযুর্গ শহরের শাসনকর্তাকে দরবারে ডাকিয়া আনিয়া বলিলেন, আমার জন্য দুইটি খানকা তৈয়ার কর । শাসনকর্তা খানকা তৈয়ার করিয়া দরবেশকে সংবাদ দিলেন। দরবেশ শাসনকর্তাকে প্রত্যহ একটি গোলাম কিনিয়া দিতে বলিলেন। শাসনকর্তা প্রতিদিন বাজার হইতে একজন করিয়া গোলাম ক্রয় করিয়া আনিয়া তাঁহাকে দিতেন। বুযুর্গ ক্রীতদাসের হাত ধরিয়া খানকায় লইয়া যাইতেন এবং সাজ্জাদায় বসাইয়া বলিতেন, আমি তোমাকে আল্লাহর নিকট সোপর্দ করিলাম। এইভাবে খানকাদ্বয় আবাদ হইয়া গেল।
তাহাদের মর্যাদা এমনই উন্নত মানের হইল যে, তাহারা অনায়াসে পানির উপর দিয়া চলিয়া যাইতে পারিতেন। যাহাকে যেই কথা বলিয়া দিতেন তাহা কার্যে পরিণত হইত। এই অবস্থা দেখিয়া আমার বিস্ময়ের আর অবধি রহিল না। আমার অবস্থা দেখিয়া উক্ত বুযুর্গ বলিলেন, ভাই ! ইহাতে বিস্ময়ের কি আছে? সাজ্জাদার অধিকারী তো ঐ ব্যক্তি, যে কোন ব্যক্তির হাত ধরিয়া তাহাকে সাজ্জাদার অধিকারী বানাইয়া দিতে পারে। যাহার মধ্যে এই শক্তি নাই সে আবার কিসের পীর? বরং সে তো সুলুকধারীদের মধ্যে মিথ্যাবাদী।

অতঃপর হুজ্জাতুল ইসলাম এরশাদ করিলেন, পুরুষের পৌরুষ বা পূর্ণতা চারিটি বস্তু দ্বারা সাধিত হয়। যথা- কম নিদ্রা যাওয়া, কম আহার করা, কম কথা বলা এবং লোকের সাথে অপারগতায় মেলামেশা করা।

তিনি (ইমাম গাজ্জালী) বলিলেন, গজনীতে একজন অবিবাহিত দরবেশ ছিলেন। সমস্ত দিন তিনি যাহা কিছু পাইতেন রাত পর্যন্ত তাহা দান করিয়া দিতেন। একটি কপর্দকও নিজের জন্য রাখিতেন না। আবার রাতে কিছু পাইলে দিনে তাহা দান করিয়া দিতেন। ছোট হউক বা বড়, দরবেশ হউক বা ধনী, যেকোন লোকই তাঁহার নিকট আসিত, কেহই খালি হাতে যাইত না। যদি কোন ব্যক্তি বস্ত্রহীন অবস্থায় আসিত তিনি তাঁহার পরিধেয় ভাল কাপড় খুলিয়া তাহাকে দান করিতেন। এই দরবেশ খুবই দানশীল এবং মুক্তহস্ত ছিলেন। আমি বহু দিন তাঁহার সাথে অবস্থান করি।

একদিন এই দরবেশ আমাকে বলিলেন, আমি একাদিক্রমে চল্লিশ বৎসর কৃচ্ছ্র সাধনা করিয়া আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতে ডুবিয়া রহিয়াছি। কিন্তু এই দীর্ঘ সময়ে আমি আমার মধ্যে এমন কোন নূর এবং উন্নতি দেখিতে পাই নাই যাহা চারিটি বিষয় অবলম্বন করার পর দেখিতে পাইয়াছি। অর্থাৎ, (১) কম খাওয়া, (২) কম কথা বলা, (৩) কম নিদ্রা যাওয়া, এবং (৪) লোকের সাথে কম মেলামেশা করা। 

এই নিয়ম মুখ্য ব্রত হিসাবে গ্রহণ করার পর আমি আকাশের দিকে তাকাইলে আল্লাহর আরশ পর্যন্ত দেখিতে পাই। ইহাতে কোন কিছুই আমার দৃষ্টিপথে অন্তরায় হইয়া দাঁড়ায় না। আবার যখন মাটির দিকে দৃষ্টিপাত করি, তখন সপ্ততল যমীনে যাহা কিছু আছে উহার সব কিছুই আমি দেখিতে পাই। 

অতঃপর বলিলেন, হে দরবেশগণ ! যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা কম না খাইবে, কম কথা না বলিবে, কম নিদ্রা না যাইবে এবং লোকের সাথে কম মেলামেশা না করিবে ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের কেহই দরবেশীর রত্নভাণ্ডার আয়ত্ত করিতে পারিবে না।

প্রকৃত দরবেশ তো তাহারাই যাহারা নিদ্রা হারাম করিয়া দিয়াছেন ; কথা বলা পরিত্যাগ করিয়া বোবায় পরিণত হইয়াছেন, লতাপাতা চিবাইয়া জীবন রক্ষা করেন এবং লোকসঙ্গকে হলাহলতুল্য মনে করেন। এই গুণাবলী অর্জন করার পরই আল্লাহর সান্নিধ্য লাভের মর্তবায় উপনীত হওয়া যায় ।

স্মরণ রাখিও, ভাল পেশাক পরিধান করিলে লোকে তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিবে, জনসমাজ তাহাকে সম্মান করিবে, এই আশায় যে উৎকৃষ্ট পোশাক পরিধান করে সে সুলুকের পথের মিথ্যাবাদী। 

যে দরবেশ প্রবৃত্তির তাড়নায় পেট ভরিয়া খায়, আলস্য নিদ্রায় গা ভাসাইয়া দেয় এবং অযথা লোকের সাথে মেলামেশা পছন্দ করে, সে তো দরবেশ নামের কলঙ্ক ।

তিনি (ইমাম গাজ্জালী রহঃ) এরশাদ করিলেন, একবার আমি নদী পথে ভ্রমণ করিতেছিলাম। এই সময় এমন একজন দরবেশের সাথে আমার সাক্ষাত হইল, অত্যধিক বিয়াযত-মুজাহাদা করার দরুন তাঁহার দেহের চামড়া হাড়ের সাথে মিলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু নিয়ম ছিল, চাশতের নামায আদায় করার পর তাঁহার সম্মুখে দস্তরখানা বিছানো হইত এবং প্রায় হাজার মণ পরিমাণ খাদ্যদ্রব্য তাহাতে রাখা হইত। যে কেহ তাঁহার নিকট আসিত সে-ই খাইত। অথচ তিনি রোযা রাখিতেন। চাশত হইতে যোহর পর্যন্ত এইভাবে পানাহার চলিত এবং বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান করিতেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি কিছুই তাঁহার নিকট রাখিতেন না।
ইহার পরও বলিতেন, যাহার যাহা কিছুর প্রয়োজন আমার নিকট আস। অতঃপর কেহ তাঁহার নিকট আসিলে জায়নামাযের নিচে হাত দিতেন, যাহা কিছু হাতে আসিত তাহাই দান করিতেন। ইফতারের সময় আলমে গায়েব হইতে চারিটি খুরমা আসিত। আমাকে দুইটি দিতেন এবং নিজে দুইটি দ্বারা ইফতার করিতেন। তিনি আমাকে বলিতেন, কম কথা বলা, কম খাওয়া, কম নিদ্রা যাওয়া এবং নির্জনতা অবলম্বন করা ব্যতীত কেহই দরবেশের মর্যাদা লাভ করিতে পারে না।

হযরত ঈসা (আঃ) সম্বন্ধেও তিনি এই জাতীয় একটি কাহিনীতে এরশাদ করিলেন যে, যালেমদের হাত হইতে উদ্ধার করিয়া যখন হযরত ঈসা (আ.)-কে চতুর্থ আসমানে নেওয়া হইল, তখন মহান আল্লাহ তা'আলা  নির্দেশ দিলেন, তাহাকে ঐখানেই রাখ। এখনও তাহার নিকট পার্থিব সুখ-সম্পদের বস্তু রহিয়াছে।
হযরত ঈসা (আ.) এই বাণী শুনিয়া বিস্মিত হইলেন এবং লক্ষ্য করিতে লাগিলেন, পার্থিব সুখ-সম্পদের কোন বস্তু তাঁহার নিকট এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে। দেখিলেন, একটি সুই এবং এক পেয়ালা চর্বি রহিয়াছে। তিনি আরয করিলেন, হে পরওয়ারদেগারে আলম ! এখন আমি ইহা কি করিব?
এরশাদ হইল, তুমিই তোমার পায়ে কুঠারাঘাত হানিয়াছ। তুমি কি উহা পৃথিবীতেই ফেলিয়া আসিতে পার নাই? সুতরাং আর সম্মুখে অগ্রসর হইতে পারিবে না, ঐখানেই অবস্থান কর।

অথচ এই হযরত ঈসা (আ.) জীবনে বিবাহ করেন নাই, রৌদ্র-বৃষ্টি হইতে আত্মরক্ষা করার জন্য ঘর-বাড়ী তৈয়ার করেন নাই। বিশ্রাম করার প্রয়োজন হইলে একখণ্ড পাথর, ইট বা অন্য কিছু মাথার নিচে দিয়া ক্ষণিকের জন্য বিশ্রাম করিয়া লইতেন।

বর্ণিত আছে, হযরত ঈসা (আ.) মাথার চুল ও দাড়ি আঁচড়ানোর জন্য একখানা চিরুনি এবং একটি পানপাত্র সর্বক্ষণ সাথে রাখিতেন। একদিন নদীর তীর দিয়া যাওয়ার সময় দেখিতে পাইলেন, এক ব্যক্তি অঞ্জলি ভরিয়া পানি পান করিতেছে। তিনি ভাবিলেন, তাই তো ! অঞ্জলি ভরিয়াই যখন পানি পান করা যায় তখন আর পানপাত্র কেন? সাথে সাথেই তিনি পানপাত্র দূরে ফেলিয়া দিলেন। 
আর একদিন দেখিলেন, এক ব্যক্তি হাতের আঙ্গুল দ্বারা মাতার চুল ও দাড়ি বিন্যাস করিতেছে। সেই দিন হইতে তিনি চিরুনিও আর সাথে রাখিলেন না।

হে দরবেশগণ ! এখানে চিন্তা করিয়া দেখার বিষয় যে, হযরত ঈসা (আ."") ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তু সাথে রাখার জন্য সম্মুখে অগ্রসর হওয়ার অনুমতি পাইলেন না ; বরং চতুর্থ আসমানেই থাকিতে হইল। সেই ক্ষেত্রে যাহারা পার্থিব বিষয়বস্তুর সহিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত, তাহারা কিভাবে বন্ধুর দরবারে পৌঁছার আশা পোষণ করিতে পারে।
দরবেশের কর্তব্য সর্বক্ষণ বিস্ময়াপন্ন থাকা। কেননা, তিনি প্রতিদিন এক স্থান হইতে অন্য স্থানে এবং এক দেশ হইতে অন্য দেশে গমন করেন। এইভাবে তিনি একটির পর একটি উন্নতির সোপান অতিক্রম করিয়া যান।

এক দরবেশ সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, তিনি সব সময় চিন্তা-ভাবনা করিতেন এবং বিস্ময়াপন্ন হইয়া থাকিতেন। লোকে তাঁহাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিতেন, আমার প্রতিটি পলক এমন এক দেশের উপর পড়ে যাহা প্রথমটি হইতে শত গুণে বড়। প্রতিটি দেশই প্রথমটি হইতে অধিক রহস্যময়। সুতরাং এই রহস্য স্বচক্ষে দেখিয়াই আমি বিস্ময়াভিভূত হইয়া 
পড়ি।
এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার চক্ষুদ্বয় অশ্রুসিক্ত হইয়া পড়িল। কিছুক্ষণ নিচের দিকে মাথা রাখিয়া আবার বলিলেন, বিস্ময়াভিভূত আহলে সুলুক বলেন, দরবেশ তাহাকে বলা হয় যিনি প্রতিদিন হাজার হাজার দেশ অতিক্রম করিয়া যান এবং তাহাতেই নিমগ্ন থাকেন। যেই দরবেশ আলমে গায়েব হইতে কোন সংবাদ পায় না সে দরবেশ নহে।

অতঃপর বলিলেন, আল্লাহর কোন কোন ওলী প্রেমাধিক্য এবং মত্ততার (সুকর) অবস্থায় কিছু কিছু রহস্য প্রকাশ করিয়া দেন। আবার এমন ওলীও আছেন যাঁহারা কোন অবস্থায়ই রহস্য প্রকাশ পাইতে দেন না। অতএব এই পথে সুলুকধারীদের শক্তি-সাহস আরও প্রশস্ত হওয়া উচিত, যেন রহস্য তাঁহার মধ্যেই সীমিত থাকে। কারণ, মাহবুবের রহস্যে যে পূর্ণতাপ্রাপ্ত, সে তাহা কখনও নষ্ট হইতে দেয় না। 

বহু দিন পর্যন্ত আমি আমার মুরশিদের খেদমতে অবস্থান করিয়াছি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমি কোন দিন শুনি নাই যে, তিনি রহস্যময় কোন কথা বলিয়াছেন। আর আমি ইহাও দেখি নাই যে, তাঁহার মধ্যে যে নূরের আবির্ভাব হইয়াছে তাহা প্রকাশ করিয়াছেন। 

কামেল দরবেশের অবস্থা তো এমন যে, তিনি কোন মতেই রহস্য প্রকাশ হইতে দেন না। ফলে অন্য রহস্য সম্বন্ধে তিনি অবগত হইতে পারেন। তাই মানসূর হাল্লাজ যদি পূর্ণতা প্রাপ্ত হইতেন তবে কখনও তিনি তাঁহার বন্ধুর রহস্য লোক সমাজে প্রকাশ করিতেন না। বন্ধুর রহস্যের সামান্য কিছুটা প্রকাশ করার ফলেই তিনি প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন।

হযরত মানসূর হাল্লাজের এক বোন ছিলেন উঁচু স্তরের একজন ওলী। অর্ধ রাত অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি ঘর ছাড়িয়া বাগদাদের উন্মুক্ত মরুভূমিতে চলিয়া যাইতেন এবং একাগ্র চিত্তে বহুক্ষণ আল্লাহর এবাদত-বন্দেগীতের লিপ্ত থাকিতেন। বাড়ী ফিরার সময় হইলে আল্লাহ তাআলা ফেরেশতাদিগকে বলিতেন, আমার প্রেম মদিরার এক পেয়ালা বেহেশতী সুরা তাহাকে পান করিতে দাও। ফেরেশতাগণ পানপাত্র তাঁহার হাতে তুলিয়া দিতেন। তিনি উহা পান করিয়া গৃহে প্রত্যাবর্তন করিতেন। 
হযরত মানসূর বোনের গৃহ হইতে বাহির হইয়া যাওয়ার বিষয় অবগত হইতে পারিলেন। বোন কোথায় যায় জানার জন্য এক রাতে তাঁহার পিছনে পিছনে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেলেন। নিয়মিতভাবেই বাড়ী ফিরার পূর্বে ফেরেশতাগণ তাঁহার সম্মুখে পানপাত্র ধরিলেন। তিনি প্রেম সুধার সামান্য পরিমাণ পান করিতেই মানসূর পিছন হইতে ডাকিয়া বলিলেন, বোন! তুমি একা পান করিও না, আমাকে একটু দাও । পিছনে ফিরিয়া ভাইকে দেখিয়া তো তিনি অবাক! তিনি বলিলেন, হায় অদৃষ্ট ! আমার এতদিনের রহস্য আজ প্রকাশ পাইয়া গেল ! তারপর ভাইকে বলিলেন, তুমি ইহা পান করিও না। আমার বিশ্বাস, তুমি ইহার প্রভাব সহ্য করিতে পারিবে না। ভাই তাঁহার কথায় কর্ণপাত করিলেন না। সেই সুধা পান করিলেন। আর যায় কোথায় ! সঙ্গে সঙ্গেই তাঁহার মুখ হইতে বাহির হইয়া পড়িল, আনাল হক। আমিই সত্য। ভাইয়ের অবস্থা দর্শনে বোন দুঃখে কাঁদিয়া ফেলিলেন। বলিলেন, ওহে অপদার্থ! আমার কথা না শুনিয়া নিজেও দুর্নামগ্রস্ত হইলে আর সাথে সাথে আমাকেও হেয় করিয়া ছাড়িলে। 

ইহার পর মানসূর প্রকাশ্য জনসমাজে আনাল হক, আনাল হক বলিয়া বেড়াইতে থাকেন। শরীয়তমতে তাঁহাকে শূল দণ্ডে দণ্ডিত করা হইল। শূলে চড়ানোর পূর্বে বোন তাঁহার নিকট গিয়া বলিলেন, মানসূর ! আমি না তোমাকে বলিয়াছিলাম, উহা পান করার শক্তি তোমার নাই। আমার কথায় কর্ণপাত না করিয়া আজ সর্বসাধারণ্যে বন্ধুর রহস্য প্রকাশ করিয়া দিয়া মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হইলে।
লোকে বলাবলি করিতে লাগিল, মানসূর এমন পৌরুষের অধিকারী ছিলেন যে, বন্ধুর প্রেমে স্বীয় জীবন উৎসর্গ করিলেন। কিন্তু বোন লোকের কথা শুনিয়া বলিলেন, মানসূর ছিল একজন কাপুরুষ। সে পৌরুষের অধিকারী হইলে সামান্য পরিমাণ প্রেম মদিরা পান করিয়া এমনভাবে বিপথগামী হইত না। আমি আজ বিশ বৎসর যাবত এই মদিরা পান করিয়া আসিতেছি, অথচ আমি তো কোন দিন বিপথে চলি নাই। বরং বলিয়াছি, আরও দাও।

হযরত জোনায়েদ (রহ.) যখন প্রেমবিহ্বল অবস্থায় থাকিতেন, তখন শুধু এই কথাই বলিতেন যে, প্রেমিক সম্প্রদায়ের জন্য হাজার আফসোস, তাহারা প্রেম ও বন্ধুত্বের দাবী করে, তারপর আলমে গায়েব হইতে তাহাদের উপর যে রহস্য অবতীর্ণ হয় তাহা লোক সমাজে প্রকাশ করিয়া বেড়ায়।

আমি আমার পীর ও মুরশিদের নিকট শুনিয়াছি, একজন বুযুর্গ কয়েকশত বৎসর পর্যন্ত আল্লাহর এবাদত ও মুজাহাদায় নিয়োজিত থাকেন। একদিন তাঁহার উপর প্রেম রহস্য প্রকাশ লাভ করিল। তিনি কিছুটা দুর্বল প্রকৃতির থাকায় তাহা সহ্য করিতে পারিলেন না। সাথে সাথে প্রকাশ করিয়া দিলেন। দ্বিতীয় দিন তাঁহার নিকট হইতে সেই রহস্য ছিনাইয়া লওয়া হইল। দরবেশ সেই দুঃখে ম্রিয়মাণ হইয়া পড়িলেন।গায়েবী আওয়ায হইল, ওহে দরবেশ ! তুমি যদি এই রহস্য  প্রকাশ না করিতে, তবে তোমাকে আরও অনেক কিছু দান করা হইত। সুতরাং তুমি উহার উপযুক্ত না হওয়ায় তোমার নিকট হইতে ছিনাইয়া লইয়া অন্যকে দান করা হইয়াছে।

একবার এক বুযুর্গ আর এক বুযুর্গের নিকট লিখিলেন, ঐ ব্যক্তি সম্বন্ধে আপনার কি অভিমত যে এক পেয়ালা প্রেম সুধা পান করিয়াই বলিয়া উঠে, আমি অনেক কিছু পাইয়াছি। দরবেশ উত্তরে লিখিলেন, এমন ব্যক্তি তো অত্যন্ত- দুর্বলচেতা। যেব্যক্তি সমুদ্রের পর সমুদ্র প্রেম সুধা পান করিয়াও হজম করিয়া ফেলে এবং বলে, আরও দাও, সে-ই বাহাদুর ! কিন্তু আমি তোমাদিগকে বলিতেছি তোমরা কখনও এইরূপ করিও না। কারণ, যাহারা গোপন রহস্য প্রকাশ করে তাহারা কিছুই অর্জন করিতে পারে না।

দরবেশ যতক্ষণ পর্যন্ত নির্জনতা অবলম্বন করিয়া যাবতীয় সম্পর্ক পরিত্যাগ না করে, সে কোন দিনও আল্লাহর নৈকট্য লাভ করিতে সক্ষম হয় না। সত্তর বৎসর পর হযরত বায়েজীদ (রহ.) যখন আল্লাহ নৈকট্য লাভে সমর্থ হন, তখন নির্দেশ দেওয়া হইল, তাহাকে ফিরাইয়া লইয়া যাও। কেননা, এখনও তাহার নিকট পার্থিব উপকরণ রহিয়াছে। তিনি চিন্তা করিলেন, আমার নিকট কি আছে? লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, একটি চামড়ার ছেঁড়া জামা এবং একটি ভাঙ্গা পানপাত্র। তিনি তখনই উহা ফেলিয়া দিয়া প্রতিবন্ধকতা দূর করিলেন।

ভাইসব ! এমন একজন বুযুর্গ যখন এই সামান্য বস্তুর জন্য আল্লাহর নৈকট্য লাভে সমর্থ হন নাই, তখন তোমার-আমার ঠিকানা কোথায় ? 
আমরা তো পার্থিব আসবাব-উপকরণ দ্বারা পরিবেষ্টিত হইয়া রহিয়াছি। পৃথিবীর মায়াজালে আবদ্ধ। হে দরবেশ ! দরবেশী এক বস্তু. সঞ্চয় করা অন্য বস্তু। প্রকৃত দরবেশ তো ঐ ব্যক্তি, তিনি যাহা মুখে বলেন তাহা কার্যে পরিণত হয়, একটুও এদিক সেদিক হয় না।

একবার আমি এবং আমার একজন অন্তরঙ্গ সাথী নদী পথে ভ্রমণ করার জন্য রওয়ানা হই। হঠাৎ আমরা আল্লাহর কুদরতের এমন একটি নিদর্শন দেখিতে পাই যাহা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। নদীর তীরে আমরা বসা। ক্ষুধার তাড়নায় অস্থির। একদিকে জঙ্গল অন্য দিকে নদী। কোথায় পাই খাবার বস্তু। এমন সময় একজন কাফ্রী আসিয়া আমাদের সম্মুখে দুইখানি যবের রুটি রাখিয়া চলিয়া গেল। আমরা আল্লাহর এই নেয়ামত খাওয়া আরম্ভ করিলাম। হঠাৎ আমাদের চোখে পড়িল, উটের সমান একটি বিচ্ছু দ্রুতবেগে নদীতে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া ততোধিক দ্রুত গতিতে নদীর অপর তীরের দিকে ধাবিত হইয়াছে। আমরা মনে করিলাম, নিশ্চয়ই কোন প্রয়োজনে উহা যাইতেছে। কি প্রয়োজন দেখার জনা আমরাও উঠিয়া দাঁড়াইলাম। কিন্তু কিভাবে নদী অতিক্রম করিব? আমরা আল্লাহর নিকট দোআ করিলাম। নদীর পানি দুই ভাগ হইয়া আমাদের পথ করিয়া দিল। নদী পার হইয়া দেখিলাম, একটি গাছের তলায় এক ব্যাক্তি গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত। আরও দেখিলাম, বিরাট এক অজগর তাহাকে দংশন করার জন্য গাছ হইতে নামিয়া আসিতেছে। ইত্যবসরে উট সদৃশ সেই বিছু অজগরটিকে দংশন করিল। অজগরটি সাথে সাথে মরিয়া গেল। বিচ্ছুটিও আমাদের দৃষ্টির অন্তরালে চলিয়া গেল। আমরা মনে করিলাম, এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই আল্লাহর ওলী, যাঁহাকে অজগরের দংশন হইতে রক্ষা করার জন্য আল্লাহ তাআলা এই বিচ্ছুটিকে পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমরা উক্ত ব্যক্তির নিকট গিয়া যাহা দেখিলাম তাহাতে আমাদের বিবেক-বুদ্ধি লোপ পাইয়া গেল। দেখিলাম, তাহার পাশে মদের বোতল। অতিরিক্ত মদ পান করার দরুণ সে বমি করিয়া নিস্তেজ হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। দুর্গন্ধে তাহার নিকট যাওয়া মুশকিল। আমরা চিন্তা করিতেছিলাম, আল্লাহর এই নিকৃষ্টতম জীবের অবস্থা দেখার জন্য আমরা কেন এখানে আসিলাম ! এমন সময় গায়েব হইতে আওয়ায হইল, ওহে আমার প্রিয়তম বন্ধুদ্বয় ! আমি যদি আমার নেকবখত এবং পুণ্যবানদিগকেই রক্ষণাবেক্ষণ করি তবে আমার গুনাহগার বান্দাদিগকে কে রক্ষা করিবে?
ইত্যবসরে সেই ব্যক্তি জাগ্রত হইয়া পাশে মৃত অজগর এবং আমাদিগকে দেখিয়া অবাক হইয়া তওবা করিল । পরবর্তী সময়ে এই ব্যক্তি খালি পায়ে হাঁটিয়া পনেরবার হজ্জ করিয়াছিল।

বন্ধুগণ! যখন মেহেরবানীর বাতাস প্রবাহিত হইতে থাকে, তখন শত পাপী অপরাধীজনকেও সাজ্জাদার অধিকারী করিয়া দেয়। খোদা না করুন, আবার কখনও যদি ক্রোধের হাওয়া প্রবাহিত হয়, তখন যত বড় সাজ্জাদার অধিকারীই হউক না কেন তাহাকে সাজ্জাদা হইতে বঞ্চিত করেন। সুতরাং এই পথের পথিক কখনও নির্ভয় এবং নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে না। কারণ, সে তাহার পরিণতি ভাল হইবে কিনা কিছুই বুঝিতে পারে না। অভিশপ্ত শয়তান যদি তাহার ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে জ্ঞাত থাকিত, তবে সে অবশ্যই হযরত আদম (আ.)-কে সেজদা করিত। সে তাহার পরিণতি সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল। বলিয়াই স্বীয় এবাদত-বন্দেগী, রিয়াযত-মুজাহাদার অহংকার করত নিজেকে সকলের চেয়ে গুণী-জ্ঞানী মনে করিয়াই বলিয়া ফেলিল, আমি মাটির তৈয়ারী মানুষকে সেজদা করিব না। ফলে সে নাফরমান হইল। আল্লাহর নির্দেশ পালন না করিয়া বিতাড়িত হইল। তাহার সকল এবাদত-বন্দেগী ব্যর্থতায় পর্যবসিত হইল। এতদিনের এবাদত-বন্দেগী তাহার মুখের উপর নিক্ষেপ করা হইল।
এই কথা বলিয়া তিনি অঝোর নয়নে কাঁদিতে থাকেন। উপস্থিত সকলেও তাঁহার সাথে ক্রন্দন করিতে থাকেন। কিছুক্ষণ পর তিনি মোনাজাত করিয়া সকলকে  সেই দিনের মত বিদায় দিলেন।
-------------------

No comments:

__