কোরআনের ফযীলত (মাজালিসে গাযযালী - ১২)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

12 দ্বাদশ মজলিস 


কোরআনের ফযীলত

সতের রবিউল আউয়াল, বুধবার। কোরআনের মুকাত্তায়াত শব্দ সম্বন্ধে আলোচনা হইতেছিল। এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, ইমাম যাহেদীর তাফসীরে উল্লেখ রহিয়াছে, কোরআন তেলাওয়াতকারীদের সম্বন্ধে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, কোরআনের প্রতিটি শব্দ তেলাওয়াত করার জন্য দশটি করিয়া নেকী বা পুণ্য লিখিত হইয়া থাকে, দশটি পাপ ক্ষমা করা হয় এবং দশটি মর্যাদার স্তর উন্নীত করা হয়।


হাদীসের শেষে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু আমি বলিতেছি না যে, لم। একটি শব্দ। বরং আলিফের পরিবর্তে দশ, লামের পরিবর্তে দশ এবং মীমের পরিবর্তে দশটি পুণ্য দান করা হইয়া থাকে। অতএব, ইহাকে একটি শব্দ বলিও না। ইহার কারণ কি?

আমাদের পীর ও মুরশিদ বলিলেন, আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে একটি রহস্য বিদ্যমান রহিয়াছে, তাই উহাকে শব্দ বলা যায় না। যদি শব্দ বলা হয় তবে মুকাত্তায়াতের দ্বারা আরম্ভের পূর্ণতা শেষ হইয়া যায়। কারণ, যদি শব্দ বলি তবে উহার বর্ণ জানা আছে এবং মুকাত্তায়াতে সংযুক্ত বর্ণ এবং অর্থ- উভয়ের দিক হইতেই যেমন মুকাতায়াত্তাতের অর্থ জানা নাই তেমন উহার বর্ণও জানা নাই। এই কারণেই মুকাত্তায়াতকে শব্দ বলা যায় না।


তিনি যে বলিয়াছেন, আলিফের পরিবর্তে দশ, লামের পরিবর্তে দশ এবং মীমে পরিবর্তে দশ পুণ্য পাওয়া যাইবে, এই বর্ণনা মুকাত্তায়াতের শব্দ সম্বন্ধে নহে; বরং ইহা পাঠ করার পুণ্য।


তারপর সেই বন্ধু বলিলেন, অন্য আর এক কিতাবে বর্ণিত আছে, মুকাত্তায়াত কয়েক প্রকার। কোনটি তিন, কোনটি দুই আবার কোনটি একবর্ণ বিশিষ্ট। এই বর্ণনা দ্বারা তো ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, মুকাত্তায়াত শব্দ।


হযরত পীর সাহেব বলিলেন, ইহা আল্লাহর হেকমত বর্ণনা করার জন্য বলা হইয়াছে। তিন বর্ণ, দুই বর্ণ এবং এক বর্ণের মধ্যেও যে আল্লাহর হেকমত রহিয়াছে, ইহাতে তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন।


ইহার পর কোরআন ও তাওরাতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলিলেন, তাওরাত হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়। তাহা এত বিরাটাকার ছিল যে, আশি উটের বোঝার পরিমাণ ছিল। শরীয়তের বিষবস্তু তাওরাতে পূর্ণ ব্যাখ্যার সাথে খোলাখুলিভাবে বর্ণিত ছিল। তাই সেই যুগে এজতেহাদের কোন প্রয়োজন ছিল না। এই কিতাব মূসা (আঃ)-এর সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল।


হযরত মূসা (আঃ)-এর ইনতেকালের পর বখতে নাস্স্সারে আবির্ভাব ঘটে। বখতে নাসার বায়তুল মোকাদ্দাস্ ধ্বংস করিয়া তাওরাত জ্বালাইয়া ফেলে। তাওরাত জ্বালাইয়া দেওয়ায় বনী ইসরাঈলগণ হয়রান-পেরেশান হইয়া পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলদের প্রতি অতি মেহেরবান ছিলেন। তিনি তাহাদের মধ্যে হযরত ওযায়ের (আঃ)-কে পয়দা করেন। হযরত ওযায়ের (আঃ) বনী ইসরাঈলদিগকে বলিলেন, তাওরাত আমার কণ্ঠস্থ আছে, আমি বলি তোমরা লিখিয়া লও। এই কথা শুনিয়া তাহারা খুবই সন্তুষ্ট হইল। তাহারা হযরত ওযায়েরের নিকট হইতে তাওরাত লিখিয়া লইল। তাহা সত্তর উটের বোঝার সমপরিমাণ হইল।


দশ বোঝা কম হওয়ার ফলে বনী ইসরাঈলদের মনে খটকা দেখা দিল এবং শয়তান তাহাদিগকে প্ররোচিত করিতে লাগিল যে, এই লিখিত তাওরাত মূল তাওরাতের ন্যায় কিনা? উভয়ের সাথে মিল আছে কিনা? এই সন্দেহের বশীভূত হইয়া তাহারা আসল তাওরাতের সন্ধানে রহিল।


বহু দিন পর তাহারা এক বৃদ্ধার সন্ধান পাইল। সেই বৃদ্ধা তাহাদিগকে বলিল, হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় একখণ্ড তাওরাত মাটির তলায় প্রোথিত করিয়া রাখা হইয়াছিল, কোথায় রাখা হইয়াছিল আমি তাহা জানি। যদি আমি তাহা বাহির করিয়া দিতে পারি তবে তোমরা আমাকে কি পুরস্কার দিবে?


লোকে নানা প্রকার উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। বৃদ্ধা স্থান দেখাইয়া দিল। মাটি খোদাইর পর সত্যই প্রোথিত তাওরাত পাওয়া গেল। সকলেই তাহাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৃদ্ধাকে নানা প্রকার উপঢৌকন দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া দিল। অতঃপর তাহার সাথে হযরত ওযায়ের (আঃ)-এর তাওরাত মিলাইয়া দেখা হইল, কোথাও কোন প্রকার গরমিল নাই। আসল কপির সাথে হুবহু মিল রহিয়াছে।

ইহার ফলে বনী ইসরাঈলদের ঈমানে খটকা দেখা দিল। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, যে কিতাব সত্তর উটের বোঝার সমান তাহা কণ্ঠস্থ করিয়া রাখা একজন মানুষের পক্ষে কিভাবে সম্ভবপর হইতে পারে। তাই ওযায়ের কখনও মানব সন্তান নহে ; বরং তিনি আল্লাহর পুত্র। এই কুধারণায় পতিত হইয়া তাহারা বেঈমান হইয়া গেল।


তাওরাত, যবুর, ইনজীল এবং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থে যাহা কিছু আছে তাহার সংক্ষিপ্তসারই আল্লাহ তাআলা কোরআনে বর্ণনা করিয়াছেন। এই সংক্ষিপ্ততার জন্যই আল্লাহ তাআলা কোরআনকে ছুহুফ বলিয়াছেন।


No comments:

__