বেহেশতের উত্তম খাদ্য (মাজালিসে গাযযালী - ৭)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
7 সপ্তম মজলিশ

বেহেশতের উত্তম খাদ্য-

দশম রবিউল আউয়াল, বুধবার। আমি পবিত্র দরবারে উপস্থিত ছিলাম। খাদ্যদ্রব্য আনা হইল। এক ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করিল, বেহেশতের উত্তম আহার্য বস্তু কি হইবে?
এরশাদ করিলেন, বেহেশতের উত্তম আহার্য বস্তু হইল গোশত। তাহার প্রতি গ্রাসে সত্তর প্রকার স্বাদ বিদ্যমান থাকিবে। একটি স্বাদের সাথে অন্যটির কোন প্রকার সামঞ্জস্য থাকিবে না। কিন্তু বেহেশতের গোশত এই পৃথিবীর গোশতের ন্যায় নহে। কারণ পৃথিবীর গোশত নশ্বর আর বেহেশতের গোশত কখনও শেষ হইবে না। সুতরাং উভয়ের মধ্যে অনেক পার্থক্য। তাহা যতই খাওয়া হউক না কেন, শেষ কখনও হইবে না।যেমন- পৃথিবীতে এক নেয়ামত পবিত্র কোরআন। এই কোরআন যতই তেলাওয়াত করা যায়, যতই বর্ণনা করা এবং শুনা যায়, তাহার স্বাদ কখনও শেষ হয় না বা কোন প্রকার তারতম্য হয় না।


এই সম্বন্ধে একটি কাহিনী বর্ণনা করিলেন যে, হযরত জোনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)-এর সাথে এক ইহুদীর খুব ভালবাসা ছিল। একদিন ইহুদী তাঁহার নিকট আগমন করিল এবং কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর ফিরিয়া যাওয়ার জন্য উঠিল। হযরত জিজ্ঞাসা করিলেন, কোথায় যাইতেছ?

ইহুদী বলিল, আজ আমাদের একটি সমাবেশ আছে। সকল ইহুদীই সেখানে উপস্থিত হইবে। আমিও সেখানে যাইব।

হযরত জোনায়েদ (রঃ) বলিলেন, আমাকেও তোমার সাথে লইয়া চল।

ইহুদী বলিল, জনাব! আপনি সেখানে যাইতে পারিবেন না। কারণ, সেখানে কোন মুসলমানকে দেখিলে সাথে সাথেই ইহুদীরা তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিবে।

হযরত জোনায়েদ বলিলেন, আমি তোমাদের বেশ-ভূষায়ই যাইব। মোটকথা, হযরত জোনায়েদ তাহার সাথে সেখানে উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, একটি উঁচু আসন তৈয়ার করা হইয়াছে। কিছুক্ষণ পর একজন অতি দুর্বল বৃদ্ধকে সেই আসনে আনিয়া বসান হইল। এই বৃদ্ধ প্রতি বৎসর এখানে বসিয়া উপস্থিত জনতাকে একটি মাত্র উপদেশ দিতেন। তাহারা সকলে তাহার সেই উপদেশ পালন করিত।

কিন্তু এইবার দুর্বল বৃদ্ধ চুপ করিয়া বসিয়া রহিল, একটি কথাও বলিল না। তাহার ভক্তগণও চুপ করিয়া তাহার কথা শুনিবার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল। যখন কোন কথাই বৃদ্ধের মুখ দিয়া বাহির হইল না, তখন ভক্তদের মধ্য হইতে কেহ তাহার নিকট গিয়া বলিল, আপনি আজ কিছু বলিতেছেন না কেন? আমরা সকলেই যে আপনার বাণী শুনার জন্য অধীরভাবে অপেক্ষমাণ। বৃদ্ধ বলিল, এই মজলিসে একজন মুসলমান আছেন, তাই আমি কোন কথা বলিতে পারিতেছি না।

ইহুদীগণ এই কথা শুনিয়া অগ্নিশর্মা হইয়া বলিল, কে সেই মুসলমান! কোথায় সে! বলুন, এখনই আমরা তাহাকে হত্যা করিব। বৃদ্ধ বলিল, না, হত্যা নহে। বরং তোমরা যদি ওয়াদা কর তাঁহাকে হত্যা করিবে না, তবেই আমি তাঁহার সন্ধান দিব। সকল ইহুদী একবাক্যে হত্যা না করার প্রতিশ্রুতি দিলে বৃদ্ধ বলিল, ঐ ব্যক্তি। তাঁহাকে আমার নিকট লইয়া আস।

হযরত জোনায়েদ (রহঃ)-কে বৃদ্ধের নিকট লইয়া আসা হইল। বৃদ্ধ বলিল, আপনি কেন এখানে আসিয়াছেন?

তিনি বলিলেন, তামাশা দেখার জন্য। 

বৃদ্ধ বলিল, আপনি যখন আসিয়াছেন তখন আমার কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিন। হযরত জোনায়েদ বলিলেন, আমি যদি তোমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি তবে তুমি ইসলাম গ্রহণ করিবে কি?

বৃদ্ধ বলিল, হাঁ! আমি ওয়াদা করিতেছি যে, আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলে আমি অবশ্যই ইসলাম গ্রহণ করিব।

হযরত জোনায়েদ (রহঃ) বলিলেন, তুমি প্রশ্নকারী। সুতরাং তুমি আসন হইতে নামিয়া আস। আমি ঐখানে বসিয়া তোমার প্রশ্নের উত্তর দিব।

বৃদ্ধ আসন হইতে নামিয়া আসিলে তিনি সেই আসনে গিয়া উপবেশন করিলেন।

বৃদ্ধ বলিল, ওহে শায়খ ! আপনাদের ধর্মের তিনটি বিষয় আমার বুঝে আসে না। আপনি যদি উহার উত্তর পৃথিবীর বিষয়বস্তুর উদাহরণ দ্বারা বুঝাইয়া দিতে পারেন তবে আমি ঈমান আনিয়া মুসলমান হইব।

হযরত জোনায়েদ বলিলেন, প্রশ্ন কর।

ইহুদী বলিল, 

(১ম) আপনারা বলিয়া থাকেন, বেহেশতে এত পানাহারের পরও পায়খানা-প্রস্রাবের প্রয়োজন হইবে না। 

(২য়) বেহেশতে এমন একটি বৃক্ষ থাকিবে যাহার শাখা-প্রশাখা বেহেশতের প্রতিটি ঘরের উপর বিস্তার লাভ করিবে এবং 

(৩য়) বেহেশতের নেয়ামত যতই খাওয়া হউক না কেন তাহার ঘাটতি হইবে না। ইহা তো অসম্ভব কথা। ইহা কিভাবে সম্ভবপর হইতে পারে? পার্থিব উদাহরণের সাথে আমার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিলে আমি ঈমান আনিব।

হযরত জোনায়েদ (রহঃ) বলিলেন, 

তোমার প্রথম প্রশ্নের উদাহরণ এই যে, সন্তান যখন মাতৃগর্ভে থাকে তখন সে পানাহার করে, কিন্তু পায়খানা-প্রস্রাবের প্রয়োজন হয় না।


দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হইল, পৃথিবীতে সূর্য একটি। কিন্তু উহার আলো সকল গৃহের উপরই পতিত হয় ভিন্ন ভিন্ন দেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সূর্যের প্রয়োজন হয় না।


তৃতীয় প্রশ্নের উত্তর হইল, কোরআন শরীফ। অগণিত লোক তাহা তেলাওয়াত করে, শ্রবণ করে এবং তাহা দ্বারা উপকৃত হয়। কিন্তু তাহার স্বাদ ও মাধুর্যে কখনও কোন পরিবর্তন আসে নাই এবং আসিবেও না।


অতঃপর হযরত জোনায়েদ (রঃ) বলিলেন, ওহে বৃদ্ধ! আমি তোমার তিনটি প্রশ্নের উত্তর দিয়াছি। এখন আমি একটি মাত্র প্রশ্ন করিতেছি, উত্তর দাও।

বৃদ্ধ বলিল, প্রশ্ন করুন, আমি উত্তর দিব।

হযরত জোনায়েদ বলিলেন, বেহেশতের দরজার উপর কি লেখা রহিয়াছে?

বৃদ্ধ এই প্রশ্ন শুনিয়া চুপ করিয়া রহিল।

ইহুদীগণ সমস্বরে বলিয়া উঠিল, আপনি আমাদের বুযুর্গ এবং ধর্মীয় নেতা। আপনি তিনটি প্রশ্ন করিয়াছেন তিনি উত্তর দিয়াছেন। তিনি একটি মাত্র প্রশ্ন করিয়াছেন, আপনি কেন চুপ করিয়া রহিলেন? তাঁহার প্রশ্নের উত্তর দিন।

বৃদ্ধ বলিল, আমি যে উত্তর দিব তোমরা যদি তাহা মানিয়া লওয়ার অঙ্গীকার কর তবেই আমি উত্তর দিব। অন্যথায় নহে। তাহারা সকলেই অঙ্গীকার করিল, হাঁ। আমরা আপনার কথায় বিশ্বাস করিয়া অবশ্যই মানিয়া লইব।


বৃদ্ধ বলিল, বেহেশতের দরজার উপর লিখা রহিয়াছে-


‎لا إلهَ إِلَّا اللَّهُ مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ


(লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ মুহম্মদুর রসূলুল্লাহ)


এই উত্তর শুনিয়া সকলেই কালেমা তাওহীদ পাঠ করত ইসলামের সুশীতল ছায়ায় আশ্রয় গ্রহণ করিল। ইহার পর পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, বেহেশতবাসী মনে মনে যে বস্তু পাওয়ার ইচ্ছা করিবে, সাথে সাথেই মেহেরবান আল্লাহ উহা তাহাকে দান করিবেন।

তারপর আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হযরত! বেহেশতবাসী যদি সেখানে শরীয়ত বিরোধী কোন বস্তু কামনা করে তবে দান করা হইবে কিনা?

এরশাদ করিলেন, শরীয়ত বিরোধী কোন বস্তুর কথা সেখানে কাহারও মনে উদয়ই হইবে না। বেহেশতবাসী সেখানে যে কাজ করিবে তাহা সবই হইবে প্রশংসনীয়।

তারপর বলিলেন, কোন কোন লোক প্রশ্ন করিয়া থাকে যে, বেহেশতে কোন প্রকার চিন্তা-ভাবনা থাকিবে না- ইহা কি প্রকারে সম্ভবপর হইতে পারে? বাবা বেহেশতী আর পুত্র দোযখী অথবা পুত্র বেহেশতী এবং বাবা দোযখী হইলে অবশ্যই একে অন্যের জন্য চিন্তা করিবে। সুতরাং বেহেশতে চিন্তা-ভাবনা থাকিবে না, ইহা আমাদের ধারণায় আসে না।

উত্তরে বলিলেন, যাহাদের জন্য চিন্তা-ভাবনা হইতে পারে, বেহেশতবাসীদের মনে তাহাদের কথা উদয়ই হইবে না। বর্ণিত আছে, বেহেশতবাসী যখন স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত হইয়া বসিবে তখন আল্লাহ তাআলা এক বিশেষ প্রকার বাতাস প্রবাহিত হওয়ার নির্দেশ দিবেন। সেই বাতাস বেহেশতবাসীদের দেহ স্পর্শ করার সাথে সাথে যাহাদের জন্য চিন্তা-ভাবনা হইতে পারে, এমনকি তাহার যে আপনজন দোযখী হইবে তাহার আকৃতি পর্যন্ত সে ভুলিয়া যাইবে। যেমন- আমরা এই পৃথিবীতে অনেক লোকের কথা ভুলিয়া যাই। আসল কথা হইল, আল্লাহর ইচ্ছাই ইচ্ছা এবং আল্লাহর কথাই কথা। অর্থাৎ তিনি যাহা ইচ্ছা সম্পাদন করেন এবং যাহা ইচ্ছা নির্দেশ দেন।

কোন এক বুযুর্গ বলেন, আল্লাহর হেকমত প্রসঙ্গে কথা বলার অধিকার তোমার কোথায়? নিশ্বাস ছাড়িও না! অন্যথায় ফাঁসী কাষ্ঠের উপর তোমার স্থান। ধৈর্যধারণ এবং চুপ করিয়া থাকাই তোমার পথ। তাহার চেয়ে উত্তম কোন পথ আর তোমার জন্য নাই।

ইহার পর কথাবার্তা এবং চলাফেরার সততা সম্বন্ধে বলিলেন, সততা এক প্রকার শক্ত রশি। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কাজে মোমেনের কর্তব্য সততার আশ্রয় গ্রহণ করা, যেন তাহার দোজাহানের কাজের পরিণতি মঙ্গলময় হয়।


হযরত যুননূন মিসরী (রঃ) বলিয়াছেন, সততা আল্লাহর তরবারি। দুনিয়াতে এমন কোন বস্তু নাই যাহার উপর সেই তরবারি দ্বারা আঘাত করার পর উহা অক্ষত অবস্থায় থাকিতে পারে। তাই নিরাপত্তার জন্য সততার আশ্রয় গ্রহণ কর। তোমার  পক্ষ হইতে সততা প্রকাশ পাইলে আল্লাহর পক্ষ হইতে বিজয় আসিবে। মোমেনের কর্তব্য ঈমানের ব্যাপারে সততার আশ্রয় গ্রহণ করা এবং পদস্খলন হইতে সতর্ক থাকা। ইহা হইলেই পূর্ণভাবে নাজাত পাওয়া যাইবে।

তোমার পদযুগল যখন বিশ্বাসের দৃঢ়তায় সুদৃঢ় হইবে, তখন সমুদ্র হইতে মাটি এবং অগ্নি হইতে নম্রতা বাহির করিয়া লও। অর্থাৎ, তখন যেকোন কঠিন কাজই তুমি সুচারুরূপে সম্পন্ন করিতে পারিবে।

No comments:

__