বিচারক (মাজালিসে গাযযালী - ৯)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
9/ নবম মজলিস

বিচারক

তের রবিউল আউয়াল, শনিবার। জাহেল কাযী বা বিচারক ও তাহাদের ফয়সালা সম্বন্ধে কথাবার্তা হইতেছিল।

পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ) এরশাদ করিয়াছেন, “এক বিচারক জান্নাতী আর দুই বিচারক দোযখী”।

এই পবিত্র বাণী মোতাবেক বিচারক তিন প্রকার। প্রথম প্রকার কাযী আলেম, নিজের এলম দ্বারা শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করেন এবং এই ফয়সালার ব্যাপারে তিনি নিঃস্বার্থ থাকেন। এই প্রথম প্রকারের কাযী জান্নাতী, আল্লাহ তা’আলা বলেন- "ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন যে, তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়া বিরাট প্রতিদান দিবেন।"


দ্বিতীয় প্রকার কাযী আলেম। কিন্তু উৎকোচ গ্রহণ করিয়া শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করিয়া থাকে। রায় দেওয়ার ব্যাপারে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষ হইতে স্বার্থসিদ্ধির আশা পোষণ করে। নিঃস্বার্থভাবে কোন কাজই করে না। উৎকোচ গ্রহণকারী বিচারকের স্থান অবশ্যই দোযখে। 

তৃতীয় প্রকার কাযী জাহেল, অজ্ঞ! শরীয়তের কাজ নিজের অজ্ঞতা দ্বারা সম্পন্ন করিয়া থাকে।

মানুষের অজ্ঞতা অগ্নিস্বরূপ। ওহে ভাই। উহা এমনই অগ্নি যে, উহা দ্বারা একজন আলেম ভন্মে পরিণত হইতে পারে।


জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রদীপ তোমার সম্মুখে রাখ। অন্যথায় মাথানত অবস্থায় অজ্ঞতার কূপে গড়িয়া যাইবে।


শেষোক্ত দুই প্রকার কাযী বা বিচারক সম্পর্কে শরীয়তের অভিমত, তাহারা দোযখী। অবশ্য মেহেরবান আল্লাহ ক্ষমা করিয়া দিতে পারেন।


এই প্রসঙ্গে হযরত পীর ও মুরশিদ একটি কাহিনী বলিলেন যে, এক শহরে একজন পীর ও একজন আলেম ছিলেন। উভয়ের গৃহদ্বার সামনাসামনি। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বিরাজমান ছিল।

হঠাৎ সেই শহরের কাযী (বিচারক) মারা যান। আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার মানসে সেই আলেমকে উক্ত শহরের কাযীর পদে নিয়োগ করা হইল। বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। পীর সাহেবের কিছু গম পিষানোর প্রয়োজন দেখা দিল। পূর্বের ন্যায় দাসী সেই গয় ভাঙাইতে কাযীর বাড়ী গেল। গম ভাঙাইয়া আসার সময় পীর সাহেব দাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার মাথায় কি?

দাসী বলিল, কাযী সাহেবের বাড়ী হইতে কিছু গম ভাঙাইয়া আনিলাম।

পীর সাহেব বলিলেন, আটা এখানে রাখিয়া তুমি চলিয়া যাও। পীর সাহেবের কথামত দাসী আটা রাখিয়া চলিয়া গেল।

অতঃপর পীর সাহেব তাহার কোন মুরীদকে ডাকিয়া বলিলেন-

এই আটা মাথায় লইয়া শহরময় ঘুরিয়া বেড়াও এবং ঘোষণা কর যে, এই আটা কাযীর বাড়ীর চাক্কিতে পিষানো হইয়াছে। যাহার ইচ্ছা বিনা পয়সায় লইতে পার।

পীরের নির্দেশমত মুরীদ আটা মাথায় করিয়া সমস্ত শহর ঘুরিয়া ফিরিয়া ঘোষণা করিল, কিন্তু কেহই সেই আটা লইতে রাযী হইল না। মুরীদ ফিরিয়া আসিয়া পীরের খেদমতে আরয করিল, কাযীর চাক্কিতে পিষানো বলিয়া কেহই এই আটা গ্রহণ করিতে রাযী হইল না।

পীর সাহেব বলিলেন, এই আটা নদীতে ফেলিয়া দাও! মুরীদ পীরের নির্দেশমত তাহাই করিল। অতঃপর পীর সাহেব শপথ করিলেন, আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন আর এই নদীর পানি পান করিব না।

পীর সাহেব বলিলেন, ইহা ছিল সেই যুগের কাযীর চাক্কিতে পিষানো আটার অবস্থা। আর এই যুগের কার্যীদের অবস্থা পরকালে কি হইবে তখনই তাহারা জানিতে পারিবে। অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হইবে।

ধূলিঝড় সরিয়া যাওয়ার পর তুমি অবশ্য দেখিতে পাইবে যে, তোমার বাহন ঘোড়া না গাধা। আজ শক্তি মদমত্ত অবস্থায় যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতেছ। কিন্তু কাল কেয়ামতের ময়দানে যখন তোমাকে আমলনামা দেওয়া হইবে এবং দাবীদারগণ হাযির হইবে তখন তোমার অবস্থা কি হইবে? এই সমস্ত কাযীর সম্বন্ধে ভয়ানক শাস্তির কথা বলা হইয়াছে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, যাহাকে বিচারক করা হইয়াছে তাহাকে বিনা ছুরিতে হত্যা করা হইয়াছে।

মানসূরের শাসন আমলে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বিচারকের পদ গ্রহণ না করায় তাঁহাকে কতই না যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইয়াছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁহাকে বন্দিশালায় রাখিয়া অত্যাচার করা হয় এবং সেই অত্যাচার-উৎপীড়নেই তিনি মারা যান। তবু তিনি বিচারকের পদ গ্রহণ করেন নাই।

যাঁহারা সর্বক্ষণ নামাযরত অবস্থায় থাকেন, বিশ্বাস কর, তাঁহারাই রহস্যের ভাণ্ডার। তাঁহারা কাহারও প্রত্যাশী নহেন। আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকিয়া অন্যের নিকটে অপ্রত্যাশী থাকেন। দরিদ্রতার চুল্লিতে জ্বলিতে থাকেন। নিজেকে প্রিয়ের চিন্তার আধারে পরিণত করেন, একত্বের প্রভাবে দোজাহান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যান। আল্লাহ ব্যতীত যাবতীয় কিছু হইতে সব সময় আত্মরক্ষা করিয়া চলেন।

---------------

No comments:

__