সুখ-দুঃখ (মাজালিসে গাযযালী - ১০)




📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
১০ম দশম মজলিস

সুখ-দুঃখ—
চৌদ্দ রবিউল আউয়াল, রবিবার। মহান দরবারে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিলাম। পীর ও মুরশিদ যোহরের পর তাশরীফ আনিলেন। ভক্তবৃন্দও দরবারে উপস্থিত ছিলেন। সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।
মাননীয় পীর ও মুরশিদ সকলকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, এক দেশে এক বাদশাহ ছিলেন। তিনি তাহার মন্ত্রীকে বলিলেন, আমার এমন একটি আংটির প্রয়োজন যাহা দেখিলে আমার মন আনন্দিত হয়। অর্থাৎ যখন আমি কোন কারণে চিন্তিত থাকি তখন ঐ আংটি দেখিয়া যেন আমার চিন্তা দূর হইয়া যায় এবং আমার মনে আনন্দ স্রোত প্রবাহিত হয়। মন্ত্রী বাদশাহর অভিপ্রায় শুনিয়া খুবই চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। ভাবিতে লাগিলেন- এখন আমি কি করিব? এই সমস্যার সমাধান করিতে তিনি দেশের গুণী-জ্ঞানী সকলকে পরামর্শ করার জন্য আহ্বান করিলেন। কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় তাহাদের নিকট প্রশ্ন করিলেন।
তিনি সমবেত বিজ্ঞজনদের উদ্দেশে বলিলেন, আমার বাদশাহ আমাকে তো এই নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু আমি চিন্তা-ভাবনা করিয়াও ইহার সমাধান খুঁজিয়া পাইতেছি না। আপনারা আমাকে সমাধান বলুন, আমি কি করিতে পারি?
এই বিজ্ঞজনদের মধ্যে একজন খুবই অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান বুযুর্গ ছিলেন। তিনি অন্যান্য সকলের কথাবার্তা শুনার পর বলিলেন, হে মন্ত্রী মহোদয়! বড়ই কঠিন কাজের নির্দেশ আপনাকে দেওয়া হইয়াছে। তবে আমার মতে আপনি একটি আংটি তৈয়ার করাইয়া উহাতে "এই সময়ও অতিবাহিত হইয়া যাইবে" কথা কয়টি খোদাই করিয়া দিন।

উপস্থিত অভিজ্ঞজনেরা সকলেই এই পরামর্শ সমর্থন করিলেন। মন্ত্রী তাঁহাদের কথামত তখনই একটি আংটি তৈয়ার করাইয়া উহাতে উক্ত কথাগুলি ক্ষোদিত করাইয়া বাদশাহর সমীপে পেশ করিলেন। আংটি দেখিয়া বাদশাহ খুব খুশী হইলেন এবং মন্ত্রীর কাজের জন্য তাহাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করিলেন। কথিত আছে, হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর আংটিতেও উপরোক্ত কথা কয়টি সোনালী অক্ষরে ক্ষোদিত ছিল।

ইহার পর নিদ্রা সম্বন্ধে কথাবার্তা আরম্ভ হইল। হযরত পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, নিদ্রা তিন প্রকার:
১। আল্লাহর জন্য নিদ্রা
২। আল্লাহর সাথে নিদ্রা এবং
৩। আল্লাহ হইতে নিদ্রা।
প্রথম প্রকার নিদ্রার অর্থ এই যে, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকর-আযকারে এতটা লিপ্ত থাকে যে, তাহার নফস পরিশ্রান্ত হইয়া পড়ে এবং সেই অবস্থায় সে যদি মনে করে যে, সামান্য পরিমাণ নিদ্রা গেলে শ্রান্তি দূর হইয়া যাইবে এবং এই নিদ্রা আমার এবাদতে সাহায্যকারী হইবে, তখন নিদ্রা যাওয়া ভাল। অধিক এবাদত করার নিয়তে নিদ্রা যাওয়া এবাদতের মধ্যে পরিগণিত হইবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমাদের জন্য নিদ্রাকে বিশ্রামস্বরূপ করিয়াছি। এই আয়াত এমন সব ব্যক্তির উদ্দেশেই অবতীর্ণ হইয়াছে। এই কারণেই এই নিদ্রাকে আল্লাহর জন্য নিদ্রা বলা হয়।

দ্বিতীয় প্রকার নিদ্রা হইল, যদি কোন ব্যক্তি নিদ্রা যাওয়া নিজের পক্ষে হারাম করিয়া যিকর-আযকারে ডুবিয়া থাকে এবং এই ডুবিয়া থাকার দরুন সে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেও ইহা তাহার পক্ষে ইচ্ছাকৃত নিদ্রা নহে; বরং আল্লাহর পক্ষ হইতেই সে নিদ্রিত হইয়া পড়ে। তাই ইহাকে আল্লাহর সাথে নিদ্রা বলা হয়।

তৃতীয় প্রকার নিদ্রা হইল, আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী হইতে বিরত থাকিয়া নিদ্রা যাওয়া। যেমন- আমাদের নিদ্রা। আর ইহাই হইল প্রকৃত পাপ। কারণ, নফসের প্রতিপালন এবং শয়তানের নির্দেশ পালন করার জন্যই এই নিদ্রা। এই প্রকার নিদ্রা মানুষকে আল্লাহ হইতে গাফেল করিয়া দেয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নিদ্রা মৃত্যুর ভাই। এই প্রকার নিদ্রা সম্বন্ধেই কোন কবি বলিয়াছেন-
"অলসতা করিয়া মূল্যবান সময় নষ্ট করিয়া দিয়াছ। তুমি কি উত্তর দিবে? খেলাধুলায় দিন এবং নিদ্রায় রাত অতিবাহিত করিয়াছ। ওহে অলস! অন্তরে জাগ্রত থাক, দুনিয়ায় গাধার ন্যায় খাওয়া ও ঘুমানোর জন্য তোমার আগমন নহে।"
ইহার পর তিনি মোমেনদের মঙ্গল সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বলিলেন, চল্লিশ দিনের মধ্যে যদি মোমেন বান্দা কোন প্রকার বিপদে জড়িত হয় তবে ভাল। কারণ ইহার মধ্যেই তাহার মঙ্গল নিহিত রহিয়াছে। যদি কোন মোমেন চল্লিশ দিন পর্যন্ত নিরাপদ থাকে, কোন প্রকার বিপদে পতিত না হয় তবে গোমরাহীর ভয় রহিয়াছে। আল্লাহ আমাদিগকে নিরাপদ রাখুন।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলিলেন, একদিন মদীনায় হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এক মহিলাকে দেখিলেন এবং তাহাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন।
এক সাহাবী হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া আরয করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে মহিলাকে বিবাহ করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, আমি তাহার সম্বন্ধে এতটা জানি যে, সে তাহার সারা জীবনে একবারও অসুস্থ হয় নাই। এমনকি' কোন বিপদেও সে জড়িত হয় নাই।
এই কথা শুনিয়া হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিলেন, তাহার মধ্যে কোন প্রকার মঙ্গল নাই। অতএব তিনি বিবাহ করার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করিয়া এরশাদ করিলেন, ফেরআউন চারিশত বৎসর বয়স পাইয়াছিল। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে সে কোন দিন পীড়িত হয় নাই। এমনকি একদিনের জন্য সে সর্দিতেও ভোগে নাই। দেখ, ইহার ফলে সে কোন প্রকার বিপদে পতিত হইল। সে দাবী করিল "আমি তোমাদের মহান আল্লাহ।" ইহার পরিণতি সে দুনিয়াতেই ভোগ করিল। অর্থাৎ সে তাহার পরিবার-পরিজনসহ নীল নদে ডুবিয়া মরিল।
আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে বলেন, তোমরা দেখিতেছ, আমি ফেরআউনকে তাহার পরিবার-পরিজনসহ ডুবাইয়া দিলাম। পরকালে তাহাদের দোযখে নিক্ষেপ করা হইবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনি প্রথম ও শেষ অসৎ কাজের প্রতিফল হিসাবে তাহাকে পাকড়াও করিলেন।
তাই চল্লিশ দিনের মধ্যে মোমেন বান্দার জান ও মালের উপর কোন বিপদ আসা প্রয়োজন। কারণ, মোমেনের বিপদের মধ্যে মঙ্গল নিহিত রহিয়াছে। সাধারণ লোকও যদি বিপদাপন্ন হয় তবে উহা দ্বারা তাহার পাপ মার্জনা হয়। আর যদি কোন সালেক বিপদাপন্ন হয় তবে তাহার মর্যাদা ও অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
---------------------

No comments:

__