হজ্জ (মাজালিসে গাযযালী - ১৪)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
14 চতুর্দশ মজলিস

হজ্জ

উনিশে রবিউল আউয়াল, শুক্রবার। আমরা অনেকেই পবিত্র খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উপস্থিত দরবেশদের মধ্যে সাইয়েদ নূরুদ্দীন গযনবী, সাইয়েদ শরফুদ্দীন, শায়খ মুহম্মদ মুজাহদুয প্রমুখ দরবেশ এমন উন্নত পর্যায়ের ছিলেন যে, আরশ হইতে পাতাল পর্যন্ত সব কিছুই বিনা বাধায় দেখিতে পাইতেন। কাবা গৃহের মুসাফিরদের কথা আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।


হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, যে আল্লাহর খাস বান্দা, তিনি যদি স্বীয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত থাকেন তবে কাবা গৃহকে নির্দেশ দেওয়া হয় ঐ খাস বান্দার চারিদিকে তাওয়াফ কর। এই কথা বলিতে বলিতে তিনি এবং উপস্থিত সকলে দণ্ডায়মান হইয়া এমন বিস্ময়ের জগতে চলিয়া গেলেন যে, সকলেই আত্মহারা হইয়া পড়িলেন। অতঃপর সকলেই এমনভাবে তাকবীর পাঠ করিতে লাগিলেন- যেমন কাবা গৃহের তাওয়াফ করার সময় পাঠ করা হয়।


সকলেই তাকবীর পাঠ করিতেছিলেন এবং প্রত্যেকরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হইতে তাজা রক্তধারা প্রবাহিত হইতেছিল। রক্তের যেই ফোঁটা মাটিতে পড়িতেছিল, উহাই তাকবীরের চিত্র অঙ্কন করিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল।


আমাদের যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, কাবা আমাদের সম্মুখে। আমরা কাবার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করত চারিবার তাওয়াফ করিলাম। এই সময় আমরা অদৃশ্য আওয়ায শুনিতে পাইলাম, হে বন্ধুগণ! আমি তোমাদের তাওয়াফ, হজ্জ এবং নামায কবুল করিলাম। আর যাহারা তোমাদের অনুসারী তাহাদেরটাও কবুল করিলাম।


হযরত পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে বিশুদ্ধ নিয়তে হজ্জ করিলে তাহার পাপ ক্ষমা করিয়া খাস বান্দাদের নামের তালিকায় তাহার নাম লিখিয়া রাখার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদিগকে নির্দেশ দান করেন। হজ্জের উদ্দেশ্য হইল সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করা। এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। নিজের যাবতীয় পাপ পরিত্যাগ করিয়া লজ্জিত না হইলে এই সম্পর্ক স্থাপন হয় না।


হযরত ফোযায়েল ইবনে ইয়ায বলেন, আমি একবার আরাফাতে অবস্থানকালে দেখিলাম, সকলেই কাকুতি-মিনতি করিয়া মহান আল্লাহর দরবারে দোআ করিতেছে। আর এক যুবক মাথানত করত চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। আমি যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম, প্রিয় বৎস ! আজ এই মহান দিনে সকলেই আল্লাহর দরবারে দোআ করায় ব্যস্ত, অথচ তুমি চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছ?


যুবক আমার দিকে তাকাইয়া বলিল, হযরত! আমি আমার জীবনের মূল্যবান অনেক সময় অযথা কাজে ও কথায় নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি। তাই আমি লজ্জায় দোআ করার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত উঠানোর সাহস পাইতেছি না।


আমি বলিলাম, তুমি দোআ কর। আল্লাহ মহান, অতি মেহেরবান। কাহাকেও বঞ্চিত করেন না। এই সমস্ত লোকের বরকতে তিনি তোমাকে তোমার উদ্দিষ্ট স্থানে পৌছাইয়া দিবেন।


আমার কথা শুনিয়া সে দোআ করার জন্য হাত উঠাইতেই তাহার মুখ হইতে এমনভাবে চিৎকার বাহির হইল যে, সাথে সাথে তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল।

হজ্জের মূলতত্ত্ব এবং আসল উদ্দেশ্য হযরত জোনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)-এর নিম্নোক্ত ঘটনা হইতে সুন্দরূপে উপলব্ধি করা যায়।

জনৈক ব্যক্তি হযরত জোনায়েদ (রহঃ)-এর নিকট আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

সে ব্যক্তি উত্তর করিল, আমি হজ্জ করিয়া আসিয়াছি।

-তুমি হজ্জ করিয়াছ?

- জি-হাঁ! আমি হজ্জ করিয়াছি।

- তুমি যখন হজ্জ করার নিয়তে স্বগৃহ হইতে বাহির হও তখন কি তুমি তোমার ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করার নিয়ত করিয়াছিলে?

- জি-না। আমি তো এই সম্বন্ধে কোন চিন্তাই করি নাই।

- তাহা হইলে তো তুমি হজ্জের নিয়তে বাহির হও নাই।

আচ্ছা! তুমি মক্কার পথে যে সমস্ত মনযিল অতিক্রম করিয়াছ এবং যেখানে যেখানে রাত অতিবাহিত করিয়াছ তখন তুমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মঞ্জিল এবং সে পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহ অতিক্রম করার নিয়ত করিয়াছিলে কি?'

- না, আমি এমন কোন নিয়ত করি নাই।

- তবে হজ্জ কিভাবে শুদ্ধ হইল?

আচ্ছা। যখন তুমি এহরাম বাঁধার নিয়ত করিয়া প্রাত্যহিক পোশাক দেহ হইতে পরিত্যাগ করিয়াছ, তখন কি উহার সাথে তোমার খারাপ স্বভাবও পরিত্যাগ করিয়াছ?

- আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না।

- তবে তোমার এহরাম কিভাবে ঠিক হইল?

তুমি যখন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়াইয়াছিলে তখন কি তোমার মনে এই খেয়াল হইয়াছিল যে, তুমি আল্লাহর দরবারে দণ্ডায়মান এবং তাঁহাকে দেখিতেছ?

-না, আমি এমন খেয়াল করি নাই।

- তবে তুমি যেন আরাফাত ময়দানে দণ্ডায়মানই হও নাই।

তাওয়াফ করার সময় তুমি তোমার প্রতি আল্লাহর মেহেরবানী অবতীর্ণ হইতেছে এমন কিছু অনুভব করিয়াছ কি?

- না, এমন কিছু অনুভব করি নাই।

- তবে তো তুমি তাওয়াফই কর নাই।

সাফা ও মারওয়ায় দৌড়ানোর সময় কেন দৌড়াইতেছ তাহা চিন্তা করিয়াছ কি?

- না, করি নাই। -

– তবে তোমার সায়ী হয় নাই।

কোরবানী করার সময় তুপি পাপ বিসর্জন দেওয়ার নিয়ত করিয়াছিলে কি? 

- না।

- তবে তোমার কোরবানী করার সার্থকতা কোথায়?

-আচ্ছা! তুমি যখন কঙ্কর নিক্ষেপ করিয়াছিলে তখন কি এই নিয়ত করিয়াছিলে যে, আল্লাহ যেন আমার পাপরাশি আমা হইতে এমনভাবেই দূরে নিক্ষেপ করিয়া দেন।

- না, আমি এই নিয়ত করি নাই।

-তাহা হইলে তোমার হজ্জের কোন কাজই সুসম্পন্ন হয় নাই। অর্থাৎ যথার্থভাবে তোমার হজ্জ হয় নাই। সুতরাং তুমি ফিরিয়া যাও এবং মাকামে ইবরাহীম পর্যন্ত গিয়া পৌছ। যেই মাকাম সম্বন্ধে আল্লাহ পাক এরশাদ করিয়াছেন, ইবরাহীম তাঁহার প্রভুর নিকট কৃতজ্ঞতার হক আদায় করিয়াছেন।

হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হযরত আবু ইয়াযীদ (রঃ) বলেন, আমি প্রথমবার হজ্জ করিতে গিয়া দেখি, মক্কা শরীফে একমাত্র কাবা ব্যতীত আর কোন কিছুই নাই। দ্বিতীয়বার হজ্জ করিতে গিয়া কাবা গৃহ এবং উহার মালিককে দেখিতে পাইলাম।

তিনি আবার বলিলেন, হজ্জ মানুষের সকল পাপ বিদূরিত করিয়া দেয়। একবার হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মুযদালেফা হইতে রওয়ানা হওয়ার সময় সকলকে বলিলেন, তোমরা চুপ করিয়া থাক। সকলেই নীরবে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। অতঃপর তিনি এরশাদ করিলেন, হে উপস্থিত জনতা। আজ আল্লাহ তোমাদের প্রতি খুবই মেহেরবান। নেককার ব্যক্তিদের জন্য তোমাদের মধ্যকার পাপী ব্যক্তিও ক্ষমা প্রাপ্ত হইয়াছে। নেককার ব্যক্তি আল্লাহর নিকট যাহা কিছু প্রার্থনা করিয়াছে তাহাই পাইয়াছে। তোমরা সকলে ক্ষমা পাইয়াছ, এখন অগ্রসর হও।


এমন সময় এক গ্রাম্য আরব হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর উটের লাগাম ধরিয়া আরয করিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে খোদা আপনাকে সত্য নবীরূপে প্রেরণ করিয়াছেন তাঁহার শপথ করিয়া বলিতেছি, এমন কোন পাপ নাই যাহা আমি করি নাই? আজ আল্লাহ্ আমাকেও কি ক্ষমা করিয়াছেন?

হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিলেন, তোমার পূর্ববর্তী পাপরাশি ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। আমার উটের লাগাম ছাড় এবং এখন হইতে আরও বেশী সৎ কাজে আত্মনিয়োগ কর।

এই কথা বলার পর সেদিনকার মত মজলিস শেষ করা হইল।



No comments:

__