তাকবীর দেওয়া (মাজালিসে গাযযালী - ১৩)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
13 ত্রয়োদশ মজলিস

তাকবীর দেওয়া-
আঠার রবিউল আউয়াল, বৃহস্পতিবার। আমরা অনেকেই খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। দরবেশদের তাকবীর দেওয়া সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল যে, তাহারা যেখানে যান সেখানেই তাকবীর ধ্বনি করেন, এই নীতি কোথা হইতে আসিল? হযরত শায়খ এরশাদ করিলেন, এমনভাবে তাকবীর দেওয়ার নিয়ম রহিয়াছে। যখন কোন লোক দ্বীন অথবা দুনিয়ার নেয়ামত প্রাপ্ত হয় তখন উক্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় এবং আরও নেয়ামত যেন পাওয়া যায় তজ্জন্য তাকবীর দেওয়া জায়েয। কিন্তু যখন তখন বা যেখানে সেখানে তাকবীর দেওয়া জায়েয নহে। তাকবীর হামদ বা প্রশংসার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

একবার হুযুরে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে
 ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে উপবিষ্ট ছিলেন। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) তাঁহাদের উদ্দেশে এরশাদ করিলেন, আমি আশা করি পরকালে তোমরা বেহেশতের এক চতুর্থাংশ স্থানের অধিকারী হইবে। অবশিষ্ট তিন চতুর্থাংশ অন্যান্য নবীর উম্মতদের অধিকারে থাকিবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী এই পবিত্র বাণী শ্রবণ করত নেয়ামতের আধিক্যের শুকরিয়া আদায়ের জন্য আল্লাহু আকবার বলিয়া তাকবীর ধ্বনি করিলেন, যেন আল্লাহ তাআলা তাঁহাদিগকে আরও অধিক নেয়ামত দান করেন।
আবার এরশাদ করিলেন, আমি আশা করি আল্লাহ তোমাদিগকে বেহেশতের অর্ধেক দান করিবেন এবং অবশিষ্ট অর্ধাংশ অন্যান্য নবীর উম্মতদের জন্য হইবে। এই পবিত্র বাণী শ্রবণ করত হযরত ওসমান, হযরত আলী এবং অন্যান্য সাহাবী বসা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য তাকবীর ধ্বনি করিতে থাকেন।
আবার এরশাদ করিলেন, আমার উম্মতগণ সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাইবে। অতঃপর অন্যান্য উম্মতগণ বেহেশতে যাইবে। এই বাণী শুনিয়া হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবী দণ্ডায়মান হইয়া আল্লাহু আকবার বলিয়া তাকবীর ধ্বনি করিলেন।
এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, বিশেষ ক্ষেত্রে তাকবীর ধ্বনি করা জায়েয। কিন্তু যেখানে সেখানে যখন তখন তাকবীর দেওয়া জায়েয নহে। 

অতঃপর এই আলোচনা হইতে লাগিল যে, মুরীদ যদি নফল নামায আদায় করিতে থাকে এবং এ মুহূর্তে পীর ও মুরশিদ তাহাকে ডাকেন তখন মুরীদের কর্তব্য কি? মুরীদ কি নামায ছাড়িয়া পীরের আহ্বানে সাড়া দিবে না নামায আদায় করিয়া সাড়া দিবে।

পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, এই অবস্থায় পীরের আহ্বানে সাড়া দেওয়াই উত্তম। ইহাতে বেশী পুণ্যের অধিকারী হইবে। একবার আমি নফল নামায আদায় করিতেছিলাম। এমন সময় আমার পীর ও মুরশিদ আমাকে ডাক দিলেন। আমি খেদমতে হাযির হইলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করিতেছিলে? আমি বলিলাম, নফল নামায আদায় করিতেছিলাম। আপনার ডাক শুনিয়া নামায ছাড়িয়া খেদমতে উপস্থিত হইলাম। তিনি বলিলেন, ভাল করিয়াছ। তোমার এই কাজ নফল নামাযের চেয়ে বেশী পুণ্যময়। কেননা, পীরের কাজে নিয়োজিত থাকা ঠিক ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত থাকার সমতুল্য।
তিনি বলিলেন, একবার আমি আমার পীর ও মুরশিদের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। অন্য দরবেশগণও উপস্থিত ছিলেন। এই সময় আমাদের মধ্যে ওলীদের সম্বন্ধে কথাবার্তা হইতেছিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি আসিয়া আরয করিল, আমি মুরীদ হওয়ার জন্য আসিয়াছি। পীর ও মুরশিদ বলিলেন, আমি তোমাকে যাহা কিছু বলিব তাহা যদি পালন করিতে রাযী থাক তবে এই শর্তেই আমি তোমাকে বায়আত করিতে পারি। আগন্তুক তাঁহার কথায় রাযী হইয়া গেল।
পীর ও মুরশিদ বলিলেন, তবে কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু পাঠ কর। কালেমা পাঠ করার পর বলিলেন, এই কালেমা শরীফ সর্বক্ষণ অন্তরে অন্তরে পাঠ করিবে। তারপর তাহাকে বায়আত করিয়া বহু খেলাত দান করিলেন এবং বলিলেন, আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে পরীক্ষা করা যে, আমার প্রতি তোমার কতটা দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আমার ইচ্ছা যে, তুমি এইভাবে কালেমা শরীফ পাঠ কর। অন্যথায় আমার এমন কি গুণ-গরিমা আছে? আমি তো হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর একজন সামান্যতম দাস। এই কালেমা তো তুমি প্রথম হইতে পাঠ করিয়া আসিতেছ। প্রথম বিশ্বাস ও আগ্রহে ইহাই প্রমাণিত হইল যে, তুমি আমার সত্যিকারের মুরীদে পরিণত হইয়াছ। নিজেকে সত্যিকারের মুরীদ প্রমাণিত করাই মুরীদের কর্তব্য।

ইহার পর এরশাদ করিলেন, তওবা করার পর তওবাকারীর উচিত নহে পাপাচারীদের সাথে সংস্রব রাখা, যাহার ফলে সে পুনরায় পাপ কাজে লিপ্ত হয়। অসৎ সঙ্গের চেয়ে এমন ক্ষতিকর আর কিছু নাই। কারণ, অসৎ সঙ্গের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই কার্যকর হইয়া থাকে! খারাপ কাজ হইতেও তওবা করিবে এবং আত্মরক্ষা করিয়া চলিবে। অন্যায় কাজও তাহার শত্রু।
এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা বলিলেন যে, হামীদ উদ্দীন বাহওয়ানী নামক এক ব্যক্তি তওবা করেন। তাহার সাথী-সঙ্গীগণ আসিয়া বলিল, বন্ধু ! চল আমরা আবার আমাদের কাজে লাগিয়া যাই। তিনি বন্ধুদিগকে বলিলেন যাও, রাস্তা দেখ। আমার মত অসহায় লোকের পিছন ছাড়। আমি তওবা করিয়াছি। খোদা না করুন, কোন মতেই আমি তওবা হইতে ফিরিব না।
এই সমস্ত কথাবার্তা হইতেছিল, এমন সময় খাবার আসিল। আমরা সকলেই খাইতে বসিয়া গেলাম। ইত্যবসরে শায়খ নিযামুদ্দীন আবুল মুয়াইয়েদ উপস্থিত হইলেন এবং সালাম করিলেন। পীর ও মুরশিদ না তাঁহার সালামের উত্তর দিলেন আর না তাঁহার দিকে ততটা মনোযোগ দিলেন। শায়খ নিযামুদ্দীন ইহাতে বেশ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। আহারপর্ব শেষ হইবার পর শায়খ নিযামুদ্দীন জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনাদের আহার করার সময় আমি সালাম করিলাম, সালামের উত্তর দিলেন না কেন?
এরশাদ করিলেন, আমরা আল্লাহর এবাদতে লিপ্ত ছিলাম! তখন সালামের উত্তর কিভাবে দিব বলুন। আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করার শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করার জন্যই দরবেশগণ আহার গ্রহণ করেন এবং ইহাই তাঁহাদের একমাত্র নিয়ত থাকে। তাই যখন আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকা হয় তখন কিভাবে সালামের উত্তর দেওয়া যাইতে পারে? আগন্তুকের উচিত সালাম করিয়াই খাইতে বসিয়া যাওয়া এবং খাওয়ার পর উঠিয়া পুনরায় সালাম করা।
অতঃপর এরশাদ করিলেন, আমিও এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হইয়াছিলাম। একবার আমি শায়খ আবুল কাসেমের খানকায় গিয়া দেখি তাঁহারা সকলেই আহার করিতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে সালাম করিলাম। তাঁহারা আমার সালামের না উত্তর দিলেন আর না আমার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। আহারপর্ব শেষ হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা আমার সালামের উত্তর দিলেন না- ইহা কেমন ব্যবহার? 
শায়খ আবুল কাসেম বলিলেন, নিয়ম তো এই যে, কেহ কোন সমাবেশে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে খাইতে দেখিলে নিজেও খাইতে বসিয়া যাওয়া। খাওয়া শেষ হইলে উঠিয়া সালাম করিবে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই নিয়ম কোথায় পাইলেন? জ্ঞানগত না বর্ণনাগত। তিনি বলিলেন, জ্ঞানগত। কেননা, এবাদতের শক্তি অর্জন করার নিয়তেই দরবেশগণ পানাহার করিয়া থাকেন। এই জাতীয় আহার এবাদতের মধ্যে পরিগণিত। সুতরাং, এবাদত করার সময় সালামের জবাব কিভাবে দেওয়া যাইতে পারে?
এই কথা বলিয়াই হযরত আলমে সুকরে নিমজ্জিত হইয়া পড়িলেন! সে দিনকার মত দরবার বরখাস্ত হইয়া গেল।

----------------

No comments:

__