ইলম ও আমল (মাজালিসে গাযযালী - ৩)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
৩ - তৃতীয় মজলিস 

ইলম ও আমল
আটাশে সফর শনিবার। দরবার শরীফে ইলম ও আমল সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল
হযরত পীর ও মুরশিদ (ইমাম গাজ্জালী রহঃ) বলিলেন, কেহ যদি ইলম সম্বন্ধীয় প্রশ্ন করে তবে পশ্নকারীর অবস্থ। এবং হাল-হাকীকত অনুযায়ী উত্তর দিতে হয়।


এই প্রসঙ্গে তিনি বলিলেন, এক ব্যক্তি খুব মূল্যবান পোশাক পরিধান করিয়া এক বুযুর্গের দরবারে উপস্থিত হইল এবং প্রশ্ন করিল, বৈরাগ্য কি? 
এই ব্যক্তি ধন সম্পত্তির প্রতি প্রবল আসক্ত ছিল। বুযুর্গ তাহার ধর্মীয় উপকারিতার প্রতি লক্ষ্য করিয়া উত্তর দিলেন, ধন-সম্পদের মায়া পরিত্যাগ করাকেই যোহদ বা বৈরাগ্য বলা হয়।
উত্তরদানকারীর কর্তব্য প্রশ্নকারীর অবস্থা ও বুঝ-ব্যবস্থার প্রতি লক্ষ্য রাখিয়া উত্তর দেওয়া, যাহাতে প্রশ্নকারী সহজে বুঝিয়া উপকৃত হইতে পারে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করিয়াছেন, 
“উদ্দেশিত ব্যক্তির বুদ্ধিমত্তার পরিমাপে কথা বল।”
এই প্রসঙ্গে কোন বুযুর্গ বলিয়াছেন, লোকের বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী কথা বলিবে যাহাতে তাহারা "আমার কথা বুঝিতে পারে।
কোন লোক কোন বুযুর্গের নিকট প্রশ্ন করিলে বুযুর্গ যদি স্বীয় বুদ্ধিমত্তা অনুযায়ী উত্তর দেন তবে প্রশ্নকারী তাহা দ্বারা কোন প্রকার উপকৃত হয় না। উত্তরদাতার কর্তব্য প্রশ্নকারীকে বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যে, তাহার কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে কিনা? 
যদি উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলিয়া মনে হয় তবে তাহার বুঝশক্তি মোতাবেক উত্তর দিবে। আর যদি যদি মনে হয় যে, প্রশ্নকারীর প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোন প্রয়োজন নাই, তবে উত্তর দিবে না। বরং টালবাহানা করিয়া এড়াইয়া যাইবে। কারণ, তাহার প্রশ্ন অবান্তর : ধর্মের প্রতি তাহার কোন আসক্তি নাই। ধর্মের সন্ধান করা, যাহা তাহার পক্ষে ফরয, সে তাহা পরিত্যাগ করিয়াছে অযথা প্রশ্ন করিয়া সময় নষ্ট করিতে আসিয়াছে। বর্ণিত আছে, একবার এক গ্রাম্য আরব হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর খেদমতে উপস্থিত হইয়া বলিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আমাকে গুরুত্বপূর্ণ এলম শিখাইয়া দিন।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) তাহার দিকে তাকাইয়া বুঝিলেন, প্রশ্নকারী যে প্রশ্ন করিয়াছে সে তাহা বুঝে নাই। তাই তিনি তাহাকে এরশাদ করিলেন, মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হও। 
অতঃপর পীর ও মুরশিদ বলিলেন এই যুগে এমন লোকও আছে যাহারা ফরয,ওয়াজিব, সুন্নত ও মুস্তাহাব আদায় করে না, কিন্তু ধুমধামের সাথে হজ্জ করিতে যায়। অথচ হজ্জ করা ফরয হওয়ার কোন শর্তই তাহাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। আবার এমন বহু লোকও আছে যাহারা বাপ-মায়ের হুকুম ব্যতীতই বিদেশ ভ্রমণে বাহির হয় এবং অহংকারের সহিত বলে আমি এমন এমন বস্তু দেখিয়াছি, এতবার বিদেশ ভ্রমণ করিয়াছি, অমুক অমুক বুযুর্গের সাক্ষাত লাভ করিয়াছি অমুক বড় বড় খানকায় গিয়াছি। এই জাতীয় সমস্ত সফরই হারাম।
তারপর বলিলেন, সফর চারি প্রকার।
প্রথম প্রকার হজ্জের সফর। যদি হজ্জের জন্য আর্থিক সামর্থ্য এবং রাস্তা বিপদমুক্ত থাকে তবে হজ্জ করা ফরয হয়। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন, যেব্যক্তি পথ খরচে সক্ষম তাহার পক্ষে আল্লাহর ঘরের হজ্জ করা ফযর। 
দ্বিতীয় সফর হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর রওযা যিয়ারত করার মানসে মদীনা শরীফ গমন করা।
তৃতীয় সফর বায়তুল মোকাদ্দাস যিয়ারতের জন্য গমন করা। 
চতুর্থ সফর ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের জন্য বিদেশযাত্রা।
নিজের দেশে যদি ধর্মীয় জ্ঞানার্জনের কোন প্রকার সুযোগ-সুবিধা না থাকে তবে অন্যত্র যাওয়া যায়। কেননা, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন জ্ঞানার্জন করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরয।
আর এক হাদীসে বর্ণিত আছে, চীন দেশে গিয়া হইলেও এলম শিক্ষা কর। 
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, কোন কোন বুযুর্গ জুমআর নামাযে উপস্থিত হন না, ইহার কারণ কি এবং ইহার রহস্য কোথায়?
তিনি উত্তরে বলিলেন, কোন কোন বুযুর্গ নির্জনতা অবলম্বন করিয়া এক বিশেষ অবস্থার মধ্যে থাকেন। নির্জনতায় থাকিয়া সেই বিশেষ অবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করেন। জুমআর জামাআতে উপস্থিত না হওয়ায় তাঁহাদের আসলে কোন প্রকার ক্ষতি হয় না। ফলে তাঁহারা উপকার ও অপকারের প্রতি লক্ষ্য রাখেন। যে কাজে বেশী উপকার দেখেন তাহাই অবলম্বন করেন। মসজিদে যাওয়া-আসা করিলে বহু লোকের সাথে মেলামেশা করিতে হয়। ইহাতে তাঁহাদের সময়ের অপচয় হয়। উপকারের চেয়ে অপকারই বেশী হয়। তাই তাঁহারা মসজিদে যাওয়া-আসা পরিত্যাগ করেন।
কিন্তু যে সমস্ত অকর্মণ্য লোক এই বিশেষ অবস্থায় না পৌঁছিয়া ঐ অবস্থার দাবী করত জুমআ ও জামাআত পরিত্যাগ করে এবং কোন স্বার্থসিদ্ধির মানসে নির্জনতা অবলম্বন করিয়া নিজের মর্যাদা বুযুর্গদের মর্যাদার সমতুল্য করিতে চায়, তাহাদের মত দুর্ভাগা আর কে আছে ? তাহারা গোমরাহ-পথভ্রষ্ট।
আবার কোন কোন বুযুর্গ বয়সের আধিক্য এবং দুর্বলতার জন্যও জুমআ এবং জামাআতে যাইতে অক্ষম থাকেন। এই দুর্বলতা ও অক্ষমতা শরীয়তের দৃষ্টিতে মার্জনীয়। যদিও তাঁহারা ইশারায় অনেক কিছু করার ক্ষমতা রাখেন তথাপি তাঁহারা অক্ষম। এই জন্যই তাঁহারা মসজিদে উপস্থিত হন না।
আবার কোন কোন বুযুর্গ আল্লাহর ধ্যানে ডুবিয়া থাকেন। এই ডুবিয়া থাকাতে তাঁহারা অনেক উপকার মনে করেন। মসজিদে যাওয়া আসা এবং সেখানে লোকের সাথে মেলামেশা করিয়া সময় নষ্ট করা এই ডুবিয়া থাকার পক্ষে ক্ষতিকর মনে করেন। এই সমস্ত ধ্যানমগ্ন লোকদের উদ্দেশেই হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, আল্লাহর সাথে যাহার মধুর সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছে, লোকের সাথে মেলামেশা করিতে সে ভয় পায়।
কিন্তু প্রকৃত কথা হইল. যে আরেফ মসজিদে উপস্থিত থাকিয়া ফরয, ওয়াজিব ও সুন্নত আদায় করেন সেই আরেফকেই পরিপূর্ণ নিরাপদ বলিব। কারণ, তরীকতের উপর শরীয়ত মোতাবেক আমল করাই কর্তব্য এবং উভয়ের মধ্যে কোন প্রকার তারতম্য আসিতে না দেওয়াই উচিত।
তারপর তিনি এরশাদ করিলেন, বুযুর্গদের নীতি হইল, মতবিরোধযুক্ত মাসআলার যে দিকটা কঠিন সেই দিকটাই তাঁহারা অবলম্বন করেন এবং সেই মতেই নফসকে চলার নির্দেশ দেন। কারণ, ইহাতে নফসের কৃচ্ছ্র সাধন হয়।
প্রতিটি সাধারণ লোক যে তাঁহাদের অসাধারণ বাণীর অনুসরণ করে, তুমি মনে রাখিও, তাহাতে আসলে বহু দোষ আছে। কারণ, তাহার নফস তৃপ্তি ও সহজ পন্থার সন্ধানী এবং নফসের খুশীমত ঠিকভাবে এবাদত হয় না।
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, যখন হইতে আমি এই হাদীস “দুই জামা বিশিষ্ট লোকের ঈমানে স্বাদ নাই" দেখিলাম, তখন হইতেই আমার মনে কেমন যেন খটকা লাগিয়া রহিয়াছে। এই হাদীসের অর্থ কি? পীর ও মুরশিদ বলিলেন, এই হাদীসের ব্যাখ্যা মতে দুই স্ত্রীওয়ালা লোক ঈমানের স্বাদ পায় না।
তারপর বলিলেন, অধিক বিবাহ করা উচিত নহে। কারণ, অধিক বিবাহের ফলে পুরুষ বিপদাপন্ন হয়। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, পরিবারের সংখ্যাধিক্য এবং সম্পদের অপ্রাচুর্য লোকের পক্ষে অবমাননাকর।
প্রকৃতপক্ষে দুই জামার অধিকারী শব্দটির আরও সুন্দর একটি অর্থ আছে। অর্থাৎ, যেব্যক্তি দুই জামার অধিকারী, তাহার চেয়ে এক জামার মালিক অধিক সংসারবিরাগী। আর যেব্যক্তি সংসারবিরাগী নহে সে ঈমানের স্বাধ কিভাবে পাইতে পারে?
যে বস্তু তোমাকে বন্ধু হইতে দূরে রাখে তাহা খারাপ। আর যে বস্তু তোমাকে বন্ধুর নৈকট্যলাভে সহায়তা করে তাহা খুবই ভাল। তাই এক বুযুর্গ কি সুন্দর বলিয়াছেন, তুমি দুনিয়াতেই দুনিয়ার আসক্তি ত্যাগ কর। এরূপ করিলেই তুমি আল্লাহর সৌন্দর্য প্রত্যক্ষ করিতে পারিবে। আমার ও আল্লাহর মধ্যে ইহাই অন্তরায় । ইহাই সত্য অনুধাবন করা। ইহাই সঠিক পথ।
---------------

No comments:

__