উলামায়ে ছূ বা অসৎ আলেম– ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

 উলামায়ে ছূ বা অসৎ আলেম–



📚 মুকাশাফাতুল কুলুব ✍🏼ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)


দুনিয়াদার ও অসৎ আলেম যারা, তারাই উলামায়ে ছূ। ইল্ম হাসিলের দ্বারা তাদের উদ্দেশ্য থাকে, কেবল দুনিয়াবী নেয়ামত ও জাগতিক যাবতীয় দ্রব্য-সত্তার জমা করা এবং উচ্চপদস্থ বড় বড় লোকদের কাছে মান-সম্মান ও মর্যাদা হাসিল করা। নবী করীম (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ 

“কেয়ামতের দিন সর্বাপেক্ষা কঠিন আযাব হবে সেই আলেমের যে নিজের ইল্ম দ্বারা উপকৃত হয় নাই।” 

তিনি (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) আরও ইরশাদ করেছেন : 

“যে কোন ব্যক্তি ততক্ষণ পর্যন্ত আলেম হতে পারে না যতক্ষণ পর্যন্ত সে নিজের ইল্ম অনুযায়ী আমল না করবে।” 

হুযূর আকরাম (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) আরও ইরশাদ করেনঃ ইলম দুই প্রকার

এক প্রকার ইল্ম যা শুধু মুখের কথা ও ভাষায় ব্যক্ত করা পর্যন্ত সীমিত থাকে; বস্তুতঃ এ ইল্ম অর্জনকারীর বিরুদ্ধে আল্লাহ্ তা'আলার কাছে সাক্ষ্য ও প্রমাণস্বরূপ। 

দ্বিতীয় প্রকার ইল্ম হচ্ছে, অস্তর ও অভ্যন্তরের ইল্ম। বস্তুতঃ এটাই প্রকৃত ইলম; এবং অর্জনকারীর জন্য এ ইলমই নাফে  ও উপকারী।”

হুযূর আকরাম (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেন: 

“তোমরা এ উদ্দেশ্যে ইল্ম অর্জন করো না যে, সমকালীন আলেমদের সাথে গর্ব করবে; তাদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে, নির্বোধ লোকদের সাথে বাক-বিতণ্ডা ও ঝগড়া করবে এবং মানুষকে নিজের প্রতি আকর্ষণ করবে। কেননা, যে ব্যক্তি এহেন উদ্দেশ্যে ইল্ল্ম হৗসিল করবে, আল্লাহ্ তা'আলা তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবেন।”


হুযূর আকরাম (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) আরও ইরশাদ করেছেন  : 

“কোন ব্যক্তিকে তার জানা বিষয় সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে যদি সে তা গোপন করে তবে কেয়ামতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরিয়ে দেওয়া হবে।” 

তিনি (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) আরও ইরশাদ করেছেন 

“আমি তোমাদের ব্যাপারে কতিপয় ব্যক্তিকে দাজ্জালের চেয়েও বেশী ভয়ঙ্কর মনে করি”। 

কেউ জিজ্ঞাসা করলো : ইয়া রাসূলাল্লাহ্ ! তারা কারা? তিনি বললেন  : 

“ভ্রষ্ট পথে পরিচালনাকারী সমাজ ও জাতির নেতারা”। 

অপর এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম)  ইরশাদ করেন 

“যে ব্যক্তি কেবল অধিক বিদ্যাই অর্জন করে গেল; অথচ হেদায়াতের পথে আসলো না - এরূপ বিদ্যার্জন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ্ থেকে ক্রমবর্ধমান দূরত্বেরই কারণ হয়।” 

হযরত ঈসা (আলাইহিস্সালাম) বলেনঃ “ওহে ! আর কতদিন অন্ধকার রাতের পথচারীদের জন্য পথ পরিষ্কার করবে আর দিশাহারা লক্ষ্যচ্যুত লোকদের সহবাস গ্রহণ করে থাকবে !”  উপরোল্লিখিত রেওয়ায়াতসমূহ এবং আরও অন্যান্য রেওয়ায়াতে ইলমের অপরিসীম গুরুত্ব বুঝা যায় এবং সেই সঙ্গে এ কথাও প্রতীয়মান হয় যে, ইলম হাসিল করার পর সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন না করা খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক অপরাধ। তাই আলেম ব্যক্তি সত্যিকার অর্থে তার সার্বিক দায়িত্ব পালন করে যেমন চির সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারে, অপরদিকে এর বিপরীত করে সে চির ধ্বংসও হতে পারে। সুতরাং সে যদি অত্যস্ত সতর্কতার সহিত ইলমের হক ও দায়িত্ব আদায় না করে, তাহলে অত্যন্ত দুঃখজনকভাবে বঞ্চনার সম্মুখীন হতে হবে। 

হযরত উমর (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন– “এই উম্মতের মধ্যে আমি ‘ইল্মধারী মুনাফিকের’ বিষয়টিকে বড় ভয়ঙ্কর ও আশংকাজনক বোধ করি”। 

লোকেরা জিজ্ঞাসা করলো  হে আমীরুল মুমেনীন ! 

আলেম মুনাফেক হয় কি করে ? তিনি বললেন  :  মুখের ভাষায় ও কথনে সে বড় বিদ্বান ও আলেম, কিন্তু অন্তর এবং আমল এ উভয় দিক থেকেই সে জাহেল-মূর্খ।


হযরত হাসান (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেছেন : “খবরদার ! তুমি ঐসব লোকের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না, যারা বড় বড় বিদ্বান লোকের বিদ্যা এবং বড় বড় তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রজ্ঞা একত্রিত করে নিয়েছে কিন্তু আমলের প্রশ্নে একেবারে শূন্য; নির্বোধ ও অজ্ঞ লোকদের পথ ধরেছে।” 

এক ব্যক্তি হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রদিয়াল্লাহু আনহু)-এর নিকট আরজ করলো : আমার ইলম হাসিল করতে ইচ্ছা হয়; কিন্তু আশংকা বোধ করি যে, হয়তঃ আমি ইলমের হক আদায় করতে পারবো না; বরং আরো বরবাদ করবো। হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন  : “ইল্ম হাসিল না করাও মূলতঃ ইল্ল্মকে বরবাদ করার অন্তর্ভুক্ত। 

হযরত ইব্রাহীম ইব্‌নে উয়াইনাহ্ (রদিয়াল্লাহু আনহু)– কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলঃ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশী লজ্জিত হয় কে? 

তিনি বলেছেন “দুনিয়াতে ঐ ব্যক্তি সবচেয়ে বেশী লজ্জিত হয়, যে অকৃতজ্ঞ লোকের প্রতি এহ্সান ও অনুগ্রহ করে। 

আর আখেরাতে সবচেয়ে বেশী লজ্জিত হবে অসৎ আলেম।” 

হযরত খলীল ইব্‌নে আহমদ (রদিয়াল্লাহু আনহু) বলেন  “লোকেরা সাধারণতঃ চার প্রকারের হয়ে থাকে  : 

(১) যে জানে (অর্থাৎ ইল্ল্ম শিক্ষা করেছে এবং এ কথাও জানে অর্থাৎ অনুভূতি রাখে  যে, সে জানে (অর্থাৎ নিজের ইলমের দায়িত্বজ্ঞান আছে), এরূপ ব্যক্তি সত্যিকার আলেম; তোমরা তার অনুসরণ কর। 

(২) যে জানে এবং একথা জানে না যে, সে জানে - এরূপ লোক ঘুমন্ত অবস্থায় রয়েছে; তাকে তোমরা জাগ্রত কর। 

(৩) যে জানে না (অর্থাৎ অজ্ঞ) এবং এ কথা জানে (অর্থাৎ অনুভূতি আছে) যে, সে জানে না - এরূপ ব্যক্তি সত্যপথের অনুসন্ধানী; তাকে তোমরা সত্য ও হেদায়াতের পথ দেখিয়ে দাও। 

(৪) যে জানে না (অর্থাৎ অজ্ঞ-মূর্খ) এবং এ কথাও জানে না যে, সে জানে না- এ ব্যক্তি জাহেল, দাম্ভিক; তাকে তোমরা পরিহার কর এবং এ থেকে বেঁচে চল। 


”হযরত সুফিয়ান সওরী (রহঃ) বলেন  : “ইলম চিৎকার করে আমলের দাবী জানায়, যদি তার দাবী ও আহ্বানে সাড়া দেওয়া হয় অর্থাৎ আলেম ব্যক্তি তার ইলম অনুযায়ী আমল করে, তবে সেই ইলম তার কাছে থাকে, অন্যথায় সে বিদায় নিয়ে নেয়।” 


হযরত ইব্‌নে মুবারক (রহঃ) বলেন : 

“একজন লোক সত্যিকার আলেম বা জ্ঞানী হতে হলে সর্বদা (নিজকে মুখাপেক্ষী জ্ঞান করে) জ্ঞান অন্বেষায় মগ্ন থাকতে হবে। আর যদি সে নিজকে আলেম বা জ্ঞানী ভেবে নেয়, তাহলে সে প্রকৃত আলেম বা জ্ঞানী নয়; জাহেল মূর্খ।” 

হযরত ফুযাইল ইব্‌নে ইয়ায (রহঃ) বলেন : তিন শ্রেণীর লোকের উপর আমার বড় করুণা আসে : (১) সমাজের শীর্ষস্থানীয় মান্য-গণ্য ব্যক্তি যদি অপমানিত হয়। 

(২) সমাজের বিত্তশালী ও ধনাঢ্য ব্যক্তি যদি দরিদ্র ও অভাবী হয়ে যায়। 

(৩) যে আলেম মানুষের শ্রদ্ধা-সম্মান হারিয়ে ফেলেছে; লোকেরা যাকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে হেয় দৃষ্টিতে দেখে।” 


হযরত হাসান (রহঃ) বলেন : “আলেমের শাস্তি হচ্ছে, তার অন্তর মরে যাওয়া, আর অন্তর মরে যাওয়ার অর্থ হচ্ছে, দ্বীন ও আখেরাতের কাজ করে দুনিয়া তলব করা।” এ প্রসঙ্গে জনৈক আরবী কবি কতই না চমৎকার বলেছেন  : “আমি বিস্মিত হই সে ব্যক্তির উপর যে হিদায়াতের বিনিময়ে গোমরাহী খরিদ করে, আর যে ব্যক্তি দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া খরিদ করে তার অবস্থা আরও অধিক বিস্ময়কর।” 

“এ দুয়ের মধ্যে অধিকতর বিস্ময়কর হলো তার অবস্থা যে সমান দামে দ্বীন বিক্রি করে দুনিয়া নিয়ে নেয় ।” 


হুযূর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন

“(অসৎ) আলেমকে এমন কঠিন শাস্তি দেওয়া হবে যে, দোযখবাসীরা তার আশে-পাশে জমা হয়ে যাবে ।” হযরত উসামাহ্ ইব্‌নে যায়েদ (রঃ) বলেন, হুযূর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়াসাল্লাম)-কে আমি বলতে শুনেছি যে, “কিয়ামতের দিন (অসৎ) আলেমকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে; তার নাড়ি-ভুঁড়ি বের হয়ে আসবে এবং এমনভাবে ঘুরতে থাকবে যেমন গাধা চাকীর চতুর্পার্শ্বে ঘুরতে থাকে। দোযখীরা তার আশে পাশে জমা হয়ে জিজ্ঞাসা করবে - তোমার এ শাস্তি কি জন্যে হচ্ছে ? সে বলবে, আমি মানুষকে সৎকাজের উপদেশ দিয়েছি কিন্তু নিজে সে অনুযায়ী আমল করি নাই, লোকদেরকে আমি মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য নসীহত করেছি; কিন্তু নিজে মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকি নাই ।” 

আলেমের শাস্তি এতো অধিক হওয়ার কারণ হচ্ছে, সে জেনেশুনে আল্লাহর না ফরমানী করেছে। এ জন্যেই আল্লাহ্ তা'আলা পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেছেন  :  “নিশ্চয় মুনাফিকরা দোযখের সর্বনিম্ন স্তরে হবে।” (নিসা : ১৪৫ ) মুনাফিকদের শাস্তির কঠোরতার কারণ তারা সত্য বিষয় জানার পরেও অস্বীকার করেছে। এমনিভাবে, নাসরাদের তুলনায় ইহুদীদেরকে অধিকতর অপরাধী সাব্যস্ত করা হয়েছে; অথচ এরা নাসারাদের মত আল্লাহর জন্য পুত্রের কথা এবং ত্রিত্ববাদের কথা বলে নাই; এর কারণ হচ্ছে, এই ইহুদীরা জেনে-বুঝে এবং ভালভাবে পরিচয়লাভের পরও অস্বীকার করেছে। যেমন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, “তারা তাঁকে এরূপ চিনে, যেরূপ তারা আপন পুত্রকে চিনে থাকে” (বাকারাহ্ : ১৪৬ )  “অতঃপর যখন তাদের নিকট আসলো সেই পরিচিত কিতাব, তখন তারা একে অস্বীকার করে বসলো; সুতরাং আল্লাহর লা'নত হোক এরূপ কাফেরদের উপর ।” (বাকারাহ্ ৮৯) 

অনুরূপ, বাল্আম বাউরের ঘটনা বর্ণনা প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হয়েছে  : 

“আর তাদেরকে সেই ব্যক্তির অবস্থা পাঠ করে শুনিয়ে দিন যাকে আমি আমার আয়াতগুলো প্রদান করেছিলাম, অতঃপর সে তা হতে সম্পূর্ণরূপে বের হয়ে পড়লো, অতএব শয়তান তার পিছনে লেগে গেল, ফলে সে বিপথগামীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল।” (আ'রাফ  : ১৭৫ ) 

উক্ত প্রসঙ্গের শেষ পর্যায়ে ইরশাদ হয়েছে; “ ফলতঃ তার অবস্থা কুকুরের মত হয়ে গেল— তুমি যদি এটাকে আক্রমণ কর তবুও হাঁপাতে থাকে, অথবা যদি এটাকে নিজ অবস্থায় ছেড়ে দাও তবুও হাঁপাতে থাকে।” 

অনুরূপ, অসৎ আলেমেরও ঠিক একই পরিণাম। কেননা, বাল্আম বাউরকেও আল্লাহ্ তা'আলা স্বীয় কিতাবের ইলম দান করেছিলেন; কিন্তু সে কাম-প্রবৃত্তির অনুসরণে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছিল। এ জন্যেই আল্লাহ্ তা'আলা তাকে কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছেন। অর্থাৎ, সে জ্ঞান-বিদ্যার কোনই পরোয়া করে নাই; ইল্ল্ম আছে বা নাই - এ প্রশ্নই তার থাকে নাই; খাহেশাত ও কুপ্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থকরণে সে নিমজ্জিত হয়ে গেছে।

হযরত ঈসা (আঃ) বলেছেনঃ 

“অসৎ আলেমের উদাহরণ সেই পাথরের ন্যায়, যেটি প্রবাহিত ঝর্ণার বহির্মুখে পতিত হয়ে পানির প্রবাহ বন্ধ করে দেয় ; সে নিজেও পানি পান করে না এবং শস্যক্ষেত্রেও পানি যেতে দেয় না।”

**********

#অসত_আলেম

#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিয়াহ

#মুকাশাফাতুল_কুলুব

ক্বিয়ামতের বিভীষিকা ইমাম গাজ্জালী রহঃ

 ক্বিয়ামতের বিভীষিকা



✍🏼ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) 📚মুকাশাফাতুল_কুলুব

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রঃ) বর্ণনা করেন যে, একদা আমি রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) উনাকে জিজ্ঞাসা করেছি- ইয়া রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ক্বিয়ামতের দিন কি বন্ধু বন্ধুকে স্মরণ করবে? তিনি (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন “কিয়ামতের দিন তিন জায়গায় কেউ কাউকে স্মরণ করবে না। 

(১) মীযান-পাল্লার নিকট যে পর্যন্ত না সে জানতে পারবে যে, তার পাল্লা হালকা রয়েছে কি ভারী হয়েছে। 
(২) আমলনামা বিতরণের সময়; যে পর্যন্ত না সে জানতে পারবে যে, আমলনামা সে ডান হাতে প্রাপ্ত হবে কি বাম হাতে। 
(৩) যখন দোযখের মধ্য থেকে বিরাট-বিশাল একটি গর্দান বের হয়ে তাদেরকে অগ্নির লেলিহান শিখায় আবদ্ধ করে নিবে এবং বলতে থাকবে যে, আল্লাহ্ আমাকে তিন ধরনের লোকের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন, দুনিয়াতে যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে মাবূদ বানিয়েছে, আর অবাধ্যতা ও হঠকারিতা করেছে, আর যারা ক্বিয়ামতের দিনকে অবিশ্বাস করেছে। এই তিন শ্রেণীর লোকদেরকে সে পেঁচিয়ে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করবে। 

জাহান্নামের একটি পুল রয়েছে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম তরবারীর চেয়েও ধারালো– এতে রয়েছে অগ্রভাগ বাঁকানো আঁকড়া বা লৌহ-শলাকা; উপরন্তু কাঁটাদার ছোট ছোট চারা গাছ।” হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রঃ) রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ্ তা'আলা আসমান-যমীন সৃষ্টি করার সময়ই (ক্বিয়ামতের) সিঙ্গা সৃষ্টি করেছেন এবং তা হযরত ইস্রাফিল (আঃ) এর হাতে দিয়ে রেখেছেন । তিনি আরশের দিকে তাকিয়ে অপলক নেত্রে প্রতীক্ষা করছেন যে, কখন ফুৎকারের আদেশ করা হয়। অত্র হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবূ হুরাইরাহ (রঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম)-উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া

রাসূলাল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম), সিঙ্গা কি ? তিনি বললেনঃ নুরের শিং। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তা কেমন? তিনি বললেনঃ “ঐ সত্তার কসম, যিনি আমাকে সত্য নবীরূপে পাঠিয়েছেন, আসমান-যমীনের প্রশস্ততা জুড়ে এর পরিধি; তিনবার এতে ফুৎকার দেওয়া হবে - ‘নফ্‌খায়ে ফাযা’ (ভয়–বিভীষিকা ও ত্রাসের ফুৎকার ), নফ্‌খায়ে সাক্কু (বেহুঁশকরণের ফুৎকার) এবং নফ্‌খায়ে বাছ (পুনরুত্থানের ফুৎকার)। 

আর এই শেষোক্ত ফুৎকারে আত্মাসমূহ (রূহ্) বের হবে। তখন এমন দেখা যাবে, যেন অসংখ্য-অগণিত মক্ষিকায় আসমান-যমীন ভরে গেছে। অতঃপর এসব রূহ্ (আত্মা) নাকের ছিদ্র পথ দিয়ে দেহসমূহে প্রবেশ করবে। এরপর হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) বললেন  : আমি সে ব্যক্তি যার কবর সর্বপ্রথম বিদীর্ণ (উন্মুক্ত) হবে।” 

অন্য এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত জিব্রাঈল, মিকাঈল ও ইস্রাফিল (আঃ)-কে যখন যিন্দা করা হবে, তখন তাঁরা হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)  এর কবরের পার্শ্বে গিয়ে উপস্থিত হবেন। তাঁদের নিকট থাকবে (হুযূরের আরোহণের জন্য) বুরাক্ক, আরও থাকবে জান্নাতের পোষাক। কবর মুবারক বিদীর্ণ হওয়ার পর নবী করিম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞাসা করবেন, হে জিবরাঈল। আজকে এ কোনদিন? তিনি বলবেন, আজকে ক্বিয়ামত দিবস। 

[এখানে একটি কথা উল্লেখ করা জরুরী যে আল্লাহর রসুল (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) তা জানেননা এমন নয়; যেমন বিদায় হজ্জের খুতবায় তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আজকের এই দিন কোন্ দিন?’।কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম উনাকেই উঠানো হবে তা তিনি এখনো জানেন তখনো জানবেন ]

হক–নাহাকের ফয়সালার দিবস। ক্বারিয়াহ্ তথা করাঘাতকারীর দিবস। তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, হে জিব্রাঈল আল্লাহ্ তা'আলা আমার উম্মতের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তিনি বলবেন, আপনি সুসংবাদ নিন; সর্বপ্রথম আপনার কবরই বিদীর্ণ হয়েছে। 

হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা বল্‌বেন  : “হে জ্বিন ও মানবকুল ! আমি তোমাদের মঙ্গল চেয়েছি, এই নাও তোমাদের কর্মফল তোমাদের আমলনামায় রয়েছে। যদি ভাল হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ্র প্রশংসা কর। আর যদি বিপরীত কিছু পাও, তবে অন্য কাউকে নয় নিজকেই ভর্ৎসনা কর।” 

হযরত ইয়াহইয়া ইব্‌নে রাযী (রহঃ) এর মজলিসে এক ব্যক্তি এ আয়াতখানি তিলাওয়াত করেছিল
“যেদিন আমি মুক্তাকীদেরকে করুণাময়ের নিকট মেহমানরূপে একত্রিত করবো, আর পাপীদের তৃষ্ণার্ত অবস্থায় দোযখের দিকে তাড়িয়ে নিবো।” (মরইয়াম : ৮৬ ) 
অর্থাৎ পাপীদেরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পায়ে হাঁটিয়ে নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “হে লোকসকল ! কোথায় দৌড়ােচ্ছ— থাম, থাম; এইতো আগামীকল্যই তোমাদেরকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে। চতুর্দিক থেকে তোমরা দলে দলে উপস্থিত হতে থাকবে এবং আল্লাহ্র সম্মুখে একা একা দন্ডায়মান হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ সম্পর্কে তোমাদেরকে অক্ষরে অক্ষরে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে জামাআত বন্দী অবস্থায় পরম করুণাময়ের মহান দরবারে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে। আর পাপীদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কঠিন আযাবের সোপর্দ করা হবে ; দলে দলে তারা দোযখে প্রবেশ করবে। ওহে ভাইয়েরা আমার ! তোমাদের সামনে এমন একদিন রয়েছে, যে দিনটির পরিমাণ তোমাদের গণনা অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার বছর দীর্ঘ হবে। সে দিনটি হবে প্রকম্পনকারী সিঙ্গা - ফুঁকের দিন। মহা বিভীষিকাময় ক্বিয়ামতের দিন। বিশ্বজগতের রব্বের সন্মুখে দণ্ডায়মান হওয়ার দিন। লজ্জা, অনুতাপ, অনুশোচনা ও হায় আপসুস করার দিন । চুলচেরা ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব-নিকাশের দিন। দুঃখ-দৈন্য অভাব-অনটন ও ঘাট্‌তি-কমৃতির দিন। চিৎকার, আহাজারি ও আর্তনাদের দিন। হক ও সত্য প্রকাশিত হওয়ার দিন। উত্থান ও পুনর্জীবিত হওয়ার দিন। আপন কৃতকর্ম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার দিন। লাভ-লোকসান চূড়ান্ত হওয়ার দিন। চেহারা কালো কিংবা সাদা হওয়ার দিন। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে না আসার দিন তবে হাঁ, যারা পবিত্র আত্মা নিয়ে উপস্থিত হবে। অনাচারীদের উযর-আপত্তি কোন কাজে না আসার উপর তাদের উপর অভিশাপ ও খারাবী বর্ষিত হওয়ার দিন।”

হযরত মুক্বাতিল ইব্‌নে সুলাইমান (রহঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সমগ্র মখ্লূক একশত বছর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবে ; কোনই কথা বলবে না। একশত বছর গভীর অন্ধকারে বিপন্ন ও দিশাহারা হয়ে থাকবে। আর একশত বছর উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় পরস্পর উলট-পালট খেতে থাকবে আর স্বীয় রব্বের নিকট কাতর মোকদ্দমা নিবেদন করতে থাকবে। পক্ষান্তরে, পঞ্চাশ হাজার বছর বিলম্বিত দিনটি নিষ্ঠাবান মুমিনের উপর একটি হালকা ফরয নামাযের ন্যায় স্বল্প সময়ে অতিবাহিত হয়ে যাবে। হুযূর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন

“(হাশরের দিন) বান্দাকে চারটি প্রশ্ন না করা পর্যন্ত তার পদদ্বয় আপন জায়গা থেকে নড়বে না
(১) তার জীবন কি কাজে ব্যয় করেছে ? 
(২) তার শরীরকে কি বিষয়ে সে জীর্ণ করেছে ? 
(৩) যে বিদ্যা সে অর্জন করেছে, সেই অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে ? 
(৪) ধন-দৌলত কোথা হতে উপার্জন করেছে এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে?” 

হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ “প্রত্যেক নবীকে একটি মকবূল দো'আর অধিকার দেওয়া হয়েছে। সকল নবী তা দুনিয়াতেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমি তা আখেরাতে আমার উম্মতের শাফা'আতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি।” 

আয় আল্লাহ ! আমাদেরকেও তোমার প্রিয় হাবীবের শাফা'আত নসীব করুন। আমীন ॥

——————-

#মুকাশাফাতুল_কুলুব

#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা

__