ক্বিয়ামতের বিভীষিকা ইমাম গাজ্জালী রহঃ

 ক্বিয়ামতের বিভীষিকা



✍🏼ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) 📚মুকাশাফাতুল_কুলুব

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা (রঃ) বর্ণনা করেন যে, একদা আমি রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) উনাকে জিজ্ঞাসা করেছি- ইয়া রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ক্বিয়ামতের দিন কি বন্ধু বন্ধুকে স্মরণ করবে? তিনি (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন “কিয়ামতের দিন তিন জায়গায় কেউ কাউকে স্মরণ করবে না। 

(১) মীযান-পাল্লার নিকট যে পর্যন্ত না সে জানতে পারবে যে, তার পাল্লা হালকা রয়েছে কি ভারী হয়েছে। 
(২) আমলনামা বিতরণের সময়; যে পর্যন্ত না সে জানতে পারবে যে, আমলনামা সে ডান হাতে প্রাপ্ত হবে কি বাম হাতে। 
(৩) যখন দোযখের মধ্য থেকে বিরাট-বিশাল একটি গর্দান বের হয়ে তাদেরকে অগ্নির লেলিহান শিখায় আবদ্ধ করে নিবে এবং বলতে থাকবে যে, আল্লাহ্ আমাকে তিন ধরনের লোকের উপর ন্যস্ত করে দিয়েছেন, দুনিয়াতে যারা আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কাউকে মাবূদ বানিয়েছে, আর অবাধ্যতা ও হঠকারিতা করেছে, আর যারা ক্বিয়ামতের দিনকে অবিশ্বাস করেছে। এই তিন শ্রেণীর লোকদেরকে সে পেঁচিয়ে জাহান্নামের কঠিন শাস্তির মধ্যে নিক্ষেপ করবে। 

জাহান্নামের একটি পুল রয়েছে চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম তরবারীর চেয়েও ধারালো– এতে রয়েছে অগ্রভাগ বাঁকানো আঁকড়া বা লৌহ-শলাকা; উপরন্তু কাঁটাদার ছোট ছোট চারা গাছ।” হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রঃ) রেওয়ায়াত করেছেন, রাসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন যে, আল্লাহ্ তা'আলা আসমান-যমীন সৃষ্টি করার সময়ই (ক্বিয়ামতের) সিঙ্গা সৃষ্টি করেছেন এবং তা হযরত ইস্রাফিল (আঃ) এর হাতে দিয়ে রেখেছেন । তিনি আরশের দিকে তাকিয়ে অপলক নেত্রে প্রতীক্ষা করছেন যে, কখন ফুৎকারের আদেশ করা হয়। অত্র হাদীসের বর্ণনাকারী হযরত আবূ হুরাইরাহ (রঃ) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম)-উনাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ইয়া

রাসূলাল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম), সিঙ্গা কি ? তিনি বললেনঃ নুরের শিং। আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তা কেমন? তিনি বললেনঃ “ঐ সত্তার কসম, যিনি আমাকে সত্য নবীরূপে পাঠিয়েছেন, আসমান-যমীনের প্রশস্ততা জুড়ে এর পরিধি; তিনবার এতে ফুৎকার দেওয়া হবে - ‘নফ্‌খায়ে ফাযা’ (ভয়–বিভীষিকা ও ত্রাসের ফুৎকার ), নফ্‌খায়ে সাক্কু (বেহুঁশকরণের ফুৎকার) এবং নফ্‌খায়ে বাছ (পুনরুত্থানের ফুৎকার)। 

আর এই শেষোক্ত ফুৎকারে আত্মাসমূহ (রূহ্) বের হবে। তখন এমন দেখা যাবে, যেন অসংখ্য-অগণিত মক্ষিকায় আসমান-যমীন ভরে গেছে। অতঃপর এসব রূহ্ (আত্মা) নাকের ছিদ্র পথ দিয়ে দেহসমূহে প্রবেশ করবে। এরপর হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) বললেন  : আমি সে ব্যক্তি যার কবর সর্বপ্রথম বিদীর্ণ (উন্মুক্ত) হবে।” 

অন্য এক রেওয়ায়াতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত জিব্রাঈল, মিকাঈল ও ইস্রাফিল (আঃ)-কে যখন যিন্দা করা হবে, তখন তাঁরা হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া-সাল্লাম)  এর কবরের পার্শ্বে গিয়ে উপস্থিত হবেন। তাঁদের নিকট থাকবে (হুযূরের আরোহণের জন্য) বুরাক্ক, আরও থাকবে জান্নাতের পোষাক। কবর মুবারক বিদীর্ণ হওয়ার পর নবী করিম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) জিব্রাঈল (আঃ)-কে জিজ্ঞাসা করবেন, হে জিবরাঈল। আজকে এ কোনদিন? তিনি বলবেন, আজকে ক্বিয়ামত দিবস। 

[এখানে একটি কথা উল্লেখ করা জরুরী যে আল্লাহর রসুল (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) তা জানেননা এমন নয়; যেমন বিদায় হজ্জের খুতবায় তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন ‘আজকের এই দিন কোন্ দিন?’।কিয়ামতের দিন সর্বপ্রথম উনাকেই উঠানো হবে তা তিনি এখনো জানেন তখনো জানবেন ]

হক–নাহাকের ফয়সালার দিবস। ক্বারিয়াহ্ তথা করাঘাতকারীর দিবস। তিনি জিজ্ঞাসা করবেন, হে জিব্রাঈল আল্লাহ্ তা'আলা আমার উম্মতের সাথে কিরূপ আচরণ করেছেন? তিনি বলবেন, আপনি সুসংবাদ নিন; সর্বপ্রথম আপনার কবরই বিদীর্ণ হয়েছে। 

হযরত আবূ হুরাইরাহ্ (রঃ) বর্ণনা করেছেন যে, হযরত নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) বলেছেনঃ আল্লাহ্ তা'আলা বল্‌বেন  : “হে জ্বিন ও মানবকুল ! আমি তোমাদের মঙ্গল চেয়েছি, এই নাও তোমাদের কর্মফল তোমাদের আমলনামায় রয়েছে। যদি ভাল হয়ে থাকে, তবে আল্লাহ্র প্রশংসা কর। আর যদি বিপরীত কিছু পাও, তবে অন্য কাউকে নয় নিজকেই ভর্ৎসনা কর।” 

হযরত ইয়াহইয়া ইব্‌নে রাযী (রহঃ) এর মজলিসে এক ব্যক্তি এ আয়াতখানি তিলাওয়াত করেছিল
“যেদিন আমি মুক্তাকীদেরকে করুণাময়ের নিকট মেহমানরূপে একত্রিত করবো, আর পাপীদের তৃষ্ণার্ত অবস্থায় দোযখের দিকে তাড়িয়ে নিবো।” (মরইয়াম : ৮৬ ) 
অর্থাৎ পাপীদেরকে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় পায়ে হাঁটিয়ে নেওয়া হবে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন “হে লোকসকল ! কোথায় দৌড়ােচ্ছ— থাম, থাম; এইতো আগামীকল্যই তোমাদেরকে হাশরের ময়দানে একত্রিত করা হবে। চতুর্দিক থেকে তোমরা দলে দলে উপস্থিত হতে থাকবে এবং আল্লাহ্র সম্মুখে একা একা দন্ডায়মান হবে। জীবনের প্রতিটি কথা ও কাজ সম্পর্কে তোমাদেরকে অক্ষরে অক্ষরে জিজ্ঞাসা করা হবে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাদেরকে সম্মান ও মর্যাদা সহকারে জামাআত বন্দী অবস্থায় পরম করুণাময়ের মহান দরবারে পৌঁছিয়ে দেওয়া হবে। আর পাপীদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় কঠিন আযাবের সোপর্দ করা হবে ; দলে দলে তারা দোযখে প্রবেশ করবে। ওহে ভাইয়েরা আমার ! তোমাদের সামনে এমন একদিন রয়েছে, যে দিনটির পরিমাণ তোমাদের গণনা অনুযায়ী পঞ্চাশ হাজার বছর দীর্ঘ হবে। সে দিনটি হবে প্রকম্পনকারী সিঙ্গা - ফুঁকের দিন। মহা বিভীষিকাময় ক্বিয়ামতের দিন। বিশ্বজগতের রব্বের সন্মুখে দণ্ডায়মান হওয়ার দিন। লজ্জা, অনুতাপ, অনুশোচনা ও হায় আপসুস করার দিন । চুলচেরা ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে হিসাব-নিকাশের দিন। দুঃখ-দৈন্য অভাব-অনটন ও ঘাট্‌তি-কমৃতির দিন। চিৎকার, আহাজারি ও আর্তনাদের দিন। হক ও সত্য প্রকাশিত হওয়ার দিন। উত্থান ও পুনর্জীবিত হওয়ার দিন। আপন কৃতকর্ম স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করার দিন। লাভ-লোকসান চূড়ান্ত হওয়ার দিন। চেহারা কালো কিংবা সাদা হওয়ার দিন। ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি কোন কাজে না আসার দিন তবে হাঁ, যারা পবিত্র আত্মা নিয়ে উপস্থিত হবে। অনাচারীদের উযর-আপত্তি কোন কাজে না আসার উপর তাদের উপর অভিশাপ ও খারাবী বর্ষিত হওয়ার দিন।”

হযরত মুক্বাতিল ইব্‌নে সুলাইমান (রহঃ) বলেন, ক্বিয়ামতের দিন সমগ্র মখ্লূক একশত বছর নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকবে ; কোনই কথা বলবে না। একশত বছর গভীর অন্ধকারে বিপন্ন ও দিশাহারা হয়ে থাকবে। আর একশত বছর উত্তাল তরঙ্গের ন্যায় পরস্পর উলট-পালট খেতে থাকবে আর স্বীয় রব্বের নিকট কাতর মোকদ্দমা নিবেদন করতে থাকবে। পক্ষান্তরে, পঞ্চাশ হাজার বছর বিলম্বিত দিনটি নিষ্ঠাবান মুমিনের উপর একটি হালকা ফরয নামাযের ন্যায় স্বল্প সময়ে অতিবাহিত হয়ে যাবে। হুযূর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেন

“(হাশরের দিন) বান্দাকে চারটি প্রশ্ন না করা পর্যন্ত তার পদদ্বয় আপন জায়গা থেকে নড়বে না
(১) তার জীবন কি কাজে ব্যয় করেছে ? 
(২) তার শরীরকে কি বিষয়ে সে জীর্ণ করেছে ? 
(৩) যে বিদ্যা সে অর্জন করেছে, সেই অনুযায়ী কতটুকু আমল করেছে ? 
(৪) ধন-দৌলত কোথা হতে উপার্জন করেছে এবং তা কিভাবে ব্যয় করেছে?” 

হযরত ইবনে আব্বাস (রঃ) থেকে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়া আলিহী ওয়া-সাল্লাম) ইরশাদ করেছেনঃ “প্রত্যেক নবীকে একটি মকবূল দো'আর অধিকার দেওয়া হয়েছে। সকল নবী তা দুনিয়াতেই গ্রহণ করে নিয়েছেন। কিন্তু আমি তা আখেরাতে আমার উম্মতের শাফা'আতের জন্য সংরক্ষিত রেখেছি।” 

আয় আল্লাহ ! আমাদেরকেও তোমার প্রিয় হাবীবের শাফা'আত নসীব করুন। আমীন ॥

——————-

#মুকাশাফাতুল_কুলুব

#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা

No comments:

__