কদরের রাতের পূর্বে



কদরের রাতের পূর্বে –
সিদরাতুল মুনতাহার ঢালে ঢালে অগনিত ফেরেশতার অবস্থান। যাদের সংখ্যা আল্লাহ ছাড়া কেউ জানেনা। তারা সেখানে আল্লাহর ইবাদত করে। চুল পরিমাণ এতটুকু জায়গাও খালি নাই, যেখানে কোন না কোন ফেরেশতা অবস্থান করে না। উহার মধ্যখানে হযরত জিবরীল (আ.)-এর আসন। কদরের রাত্রিতে সেখানকার সকল ফেরেশতাদের সংগে লইয়া পৃথিবীতে অবতরণ করার জন্য আল্লাহ্ তা'আলা জিবরীল (আ.)-কে নির্দেশ দেন। এদের প্রত্যেকের হৃদয়েই আল্লাহ্ তা'আলা ঈমানদারদের প্রতি দয়া ও করুণা দান করিয়াছেন। ফলে শবে কদরে সূর্যাস্তের সংগে সংগে তাঁহারা জিবরীল (আ.)-এর সংগে অবতরণ করেন। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন– "প্রত্যেক কাজের জন‍্য ফেরেশতা ও রূহ্ অবতীর্ণ হয়।" (সুরা কদর) তাঁরা দুনিয়াতে অবতরণ করিয়া পৃথিবীর প্রতিটি ভূখণ্ডে ছড়াইয়া পড়ে এবং দণ্ডায়মান কিংবা সিজদারত অবস্থায় ঈমানদার নর-নারীর জন্য দু'আ করে। যেমন আল্লাহ তা'আলা বলেন,– "ফযরের পূর্বে পর্যন্ত এই দোয়া অব্যাহত থাকে।(সুরা কদর)
তবে গীর্জা, মন্দির, অগ্নিপূজা ঘর, আবর্জনার ফেলার স্থান, যে ঘরে নেশাদার দ্রব্য থাকে, যে ঘরে মূর্তি স্থাপন করা থাকে ইত্যাদি অপবিত্র স্থানে তাঁহারা গমন করেন না। রাতভর তাঁহারা ঈমানদারদের জন্য দু'আ করিতে থাকে। হযরত জিবরীল (আ) প্রত্যেক ঈমানদারের সহিত মুসাফাহা করেন। ইহার লক্ষণ হইল, সেই রাতে খোদার ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত হওয়া হৃদয় বিগলিত হওয়া ও চক্ষু অশ্রুপূর্ণ হওয়া। হযরত জিবরীল (আ.)-এর মুসাফাহার ফলেই এমন হইয়া থাকে।
কা'ব (রা) বলেন, এই রাত্রে কেহ তিনবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ পাঠ করিলে একবারের বিনিময়ে আল্লাহ্ তা'আলা তাহাকে ক্ষমা করিয়া দেন, একবারের বিনিময়ে দোজখ হইতে মুক্তি দান করেন এবং একবারের বিনিময়ে জান্নাত দান করেন। বর্ণনাকারী বলেন, আমি কা'ব আল-আহবারকে জিজ্ঞাসা করিলাম যে, সঠিক বিশ্বাসে ইহা পাঠ করিবে, তাহার জন্য এই পুরস্কার? উত্তরে কা'ব (রা) বলেন, সঠিক বিশ্বাসী ছাড়া কি কেহ লায়লাতুল কদরের লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ বলেন? আমি- সেই আল্লাহ্ শপথ করিয়া বলিতেছি যে, কদরের রাত্রি কাফির মুশরিক ও মুনাফিকদের জন্য বড় ভারী হইয়া থাকে। যেন তাহাদের মাথার উপর পাহাড় চড়িয়া বসে। ঠিক সুবহে সাদিকের পূর্ব পর্যন্ত ফেরেশতারা এইভাবে দায়িত্ব পালন করিতে থাকে।

#কদর
#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা

কদর রাতের পরে যা হবে



কদর রাতের পরে যা হবে—
সুরা কদরে আল্লাহ্ তা’আলা বলেন,- “ সালামুন হিয়া হাত্তা মাতলাইল ফাজর”। অর্থাৎ – “শান্তিই শান্তি, বিরাজ করে উষার আবির্ভাব পর্যন্ত”।
এর পরের ঘটনা জানুন – 
কদরের রজনীতে জিব্রাইল (আ.) সকল ইমানদারদের সাথে করমর্দন করেন। তাঁর করমর্দনের সময় মুমিন ব্যক্তির শরীরের  লোমকুপ খাড়া হয়ে যায়। মন কোমল হয় এবং চোখে অশ্রুধারা নেমে আসে। এসব নিদর্শন দেখা দিলে বুঝতে হবে , তার হাত হজরত জিব্রাইল (আঃ)-এর হাতের মধ্যে রয়েছে। 

ফজরের পর জিব্রাইল (আঃ) সমস্ত ফেরেস্তাদের নিয়ে উপরে দিকে উঠে যান এবং অনেক উপরে উঠে স্বীয় পালক ছড়িয়ে দেন অতপর তিনি সেই দুটি সবুজ পালক প্রসারিত করেন, যা অন্য কোন সময় প্রসারিত করেননা। এর ফলে সূর্যের কিরণ মলিন ও স্থিমিত হয়ে যায়। তারপর তিনি সমস্ত ফেরেশতাদের ডাকিয়ে নিয়ে যান। সব ফেরেশতা উপরে উঠে গেলে তাদের নুর এবং জিব্রাইল (আঃ) এর পালকের নুর মিলিত হয়ে সুর্যের কিরণকে নিস্প্রভ করে দেয়। ঐ দিন সূর্য অবাক হয়ে যায়। সকল ফেরেশতা সেদিন আকাশ ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানের ইমানদার নারী-পুরুষের জন্য রহমত কামনা করে তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারা ঐ সব লোকের জন্যও দোয়া করেন, যারা সৎ নিয়তে রোযা রাখে এবং সুযোগ পেলে পরবর্তী রমযান মাসেও আল্লাহর ইবাদত করার মনোভাব পোষন করে। 
সন্ধ্যায় সবাই প্রথম আসমানে পৌঁছে যান। সেখানে অবস্থানকারী ফেরেশতারা এসে পৃথিবীতে অবস্থানকারী ঈমানদারদের অমুকের পুত্র অমুক।অমুকের কন্যা অমুক বলে বলে খবরাখবর জিজ্ঞেস করেন। নির্দিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করার পর কোন কোন ব্যক্তি সম্পর্কে ফেরেশতারা বলেন : তাকে আমরা গত বছর এবাদতে লিপ্ত দেখেছিলাম, কিন্তু সে এবারে বিদআতে লিপ্ত দেখে এসেছি। প্রশ্নকারী ফেরেশতা তখন শেষোক্ত ব্যক্তির জন্য মাগফিরাত ও রহমতের দোয়া করেন। ফেরেশতারা প্রশ্নকারী ফেরেশতাদেরকে আরো জানান যে, তারা অমুক অমুককে আল্লাহর জিকর করতে দেখেছেন। অমুক অমুককে রুকুতে এবং অমুক অমুককে সিজদায় পেয়েছেন। অমুক অমুককে কুরআন তিলাওয়াত করতে দেখেছেন। একরাত একদিন প্রথম আসমানে কাটিয়ে তারা দ্বিতীয় আসমানে গমন করেন। সেখানেও একই অবস্থা সৃষ্টি হয়। এভাবে তারা তাদের স্থান সিদরাতুল মুনতাহায় গিয়ে পৌছেন। সিদরাতুল মুনতাহা তাদেরকে বলে : আমাতে অবস্থানকারী হিসাবে তোমাদের প্রতি আমার দাবি রয়েছে। আল্লাহকে যারা ভালবাসে আমিও তাদেরকে ভালবাসি।আমাকে তাদের অবস্থার কথা শোনাও। তাদের নাম শোনাও। হজরত কাব (রঃ) বলেন : ফেরেশতারা তখন আল্লাহর পুণ্যবান বান্দাদের নাম ও পিতার নাম জানাতে শুরু করেন। তারপর জান্নাত সিদরাতুল মুনতাহাকে সম্বোধন করে বলে: তোমাতে অবস্থানকারী তোমাকে যা শুনিয়েছোট সে সব আমাকে একটু শোনাও। তখন সিদরাতুল মুনতাহা জান্নাতকে সব শুনিয়ে দেয়। শোনার পর জান্নাত বলে : অমুক পুরুষ ও নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক। হে আল্লাহ্ ! অতি শীঘ্রই তাদেরকে আমার সাথে মিলিত করুন।
হজরত জিব্রাইল (আঃ) সর্বপ্রথম নিজের যায়গায় পৌঁছে যান। তাঁর উপর তখন ইলহাম হয় এবং তিনি বলেন : হে আল্লাহ! আমি আপনার অমুক অমুক বান্দাকে সিজদারত অবস্থায় দেখেছি। আপনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিন। আল্লাহ তা'আলা তখন বলেন : আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম। হজরত জিব্রাইল (আঃ) তখন আরশ বহনকারী ফেরেশতাদেরকে এ কথা শুনিয়ে দেন। তখন ফেরেশতা বলাবলি করে যে , অমুক অমুক নারী পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত ও মাগফিরাত হয়েছে। তারপর হজরত জিব্রাইল (আঃ) বলেন, হে আল্লাহ ! গত বছর আমি অমুক অমুক ব্যক্তিকে সুন্নতের উপর আমলকারী এবং আপনার এবাদতকারী হিসেবে দেখেছি কিন্তু এবার সে বিদআতে লিপ্ত হয়ে পরেছে এবং আপনার বিধিবিধানের অবাধ্যতা করেছে। তখন আল্লাহ তাবারকা ওয়া তা'আলা বলেন, হে জিব্রাইল (আঃ) , সে যদি মৃত্যুর তিন মিনিট পূর্বেও #তওবা করে নেয়, তাহলে আমি তাকে মাফ করে দিবো তখন জিব্রাইল আঃ হঠাৎ করে বলেন , হে আল্লাহ আপনার জন্যই সমস্ত প্রশংসা। আপনি সমস্ত প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।।
(তপসীর ইবনে কাছীর থেকে)
#কদর
#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা

কদরের রাতের গুরুত্ব



বিশ রমজান শেষ হলে কদরের রাতের সন্ধান করাটা মুমিন বান্দার জন্য অপরিহার্য । তাই কদর রাতের সন্ধানের জন‍্য আল্লাহর প্রিয় বান্দারা উত্তম উপায় হিসেবে ই'তিকাফ করে থাকেন। কারণ রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বিশ রমজানের পরে যে কোন রাতে কদরের রাতের তালাশ করতে বলেছেন। এই রাতের মূল‍্য হাজার মাস থেকে উত্তম। সেই হাজার মাস আমাদের হাজার মাসের ন‍্যায় নয়। এমন হাজার মাস সেই বান্দার হাজার মাস, যেই বান্দার দোয়া ফিরিয়ে দেয়া হয়না। তার মানে একজন ন‍্যায়পরায়ন বাদশার হাজার মাস। তিরমিজি শরিফের হাদিসে আছে ন‍্যায় পরায়ন বাদশাহর দোয়া রদ হয়না। সেই বাদশাহর হাজার মাস থেকেও কদরের রাতের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়ে আল্লাহ তা'আলা তার হাবীবকে খুশি করেছিলেন। এর পিছনে রহস্য কি তা জানাও জরুরী।

মহান রব্বুল আলামিন কোরআনুল করীমে ইরশাদ করেন—

"ইন্না আনযালনাহু ফী লাইলাতিল কাদর, ওয়ামা আদরাকা মা লাইলাতুল কাদর, লাইলাতুল কাদরি খাইরুম মিন আলফি শাহর" (সুরা কদর 1-3)

অর্থ– 
"নিশ্চয়ই আমি তা (কোরআন) অবতীর্ণ করেছি কদরের রাতে। আর কদরের রাত সম্বন্ধে আপনি কি জানেন ? কদরের রাত হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।"

ইমাম তিরমিযী (রহঃ) বলেন, ইউসুফ বিন সাদ কর্তৃক বর্ণিত, ইমাম হাসান (রদিয়াল্লাহু আনহু) হযরত মুআবিয়ার নিকট বাইআতের সময় জনৈক ব্যক্তি দাড়িয়ে ইমাম হাসান (রা.) - কে বলল, 'আপনি মুসলমানদের লজ্জিত করলেন'। তিনি বললেন, আল্লাহ তোমার উপর রহম করুন। আমাকে খারাপ বলোনা । কারণ নবী (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এক রাতে বনূ উমাইয়াকে মিম্বরের উপর দেখে বিহবলিত হয়ে পড়েছিলেন। সে সময়- সুরা কদর এবং সুরা কাউসার অবতীর্ণ হয়। "আমি সম্মানিত রাতে কুরআনকে নাযিল করলাম। আর আপনি কি জানেন সম্মানিত রাত কি? সম্মানিত রাত মানে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম রজনী।" আপনার ইন্তেকালের পর হে মুহাম্মদ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ! বনূ উমাইয়া হাজার মাসের মালিক হবে ! 

কাসেম বলেন, আমি হিসাব করেছি আমির মুআবিয়ার বাইআত থেকে হাজার মাস তাদের রাজত্ব ছিল, একটুকুও কম-বেশি হয়নি ।

#তারিখুল_খোলাফা
#সুরা_কদর
#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা 


সুরা ফাতিহা পাঠকারীর প্রতি আল্লাহর জবাব


সুরা ফাতিহা পাঠকারীর প্রতি আল্লাহর জবাব —

হাদীস শরীফে এসেছে, আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-কে বলতে শুনেছি, আল্লাহতায়ালা বলেন : ‘আমি সালাতকে আমার ও আমার বান্দার মধ্যে অর্ধেক অর্ধেক করে ভাগ করে নিয়েছি। আর আমার বান্দা যা চাইবে, তা সে পাবে।’
সুরা ফাতেহার প্রত্যেক আয়াতে আল্লাহ্ তা'আলা বান্দার পাঠের জবাব দিয়ে থাকেন। যা নিচে যথাস্থানে লিখিত হয়েছে । (সহীহ মুসলিম, ২য় খ- হাদীস নং ৭৭৪)

(১) 
উচ্চারণ : বিসমিল্লাহির্ রাহমা-নির্ রাহি-ম।

আরবী
بِسْمِ اللَّهِ الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ 

অনুবাদ –
আল্লাহর নামে শুরু করছি যিনি পরম করুণাময়, অতি দয়ালু।

অন্তরে থাকতে হবে–
[ আল্লাহ্ ! আমি আপনার মহিমাম্বিত নাম নিয়ে শুরু করছি।]

(২) 
উচ্চারণ : আলহামদু লিল্লাহি রব্বিল আ -লামি-ন।

আরবী–
الْحَمْدُ لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ 

অনুবাদ –
সকল প্রশংসা আল্লাহ তা’আলার জন্য যিনি সকল সৃষ্টি জগতের পালনকর্তা।

অন্তরে থাকতে হবে–
[আপনারই প্রশংসা করছি ( মনে মনে ভাবতে হবে যদিও আমি তার যোগ্য নই )] 

তখন মহান আল্লাহ্ তা'আলা বলেন, - "‘বান্দা আমার প্রশংসা করেছে।"

(৩) 
উচ্চারণ : আররহমা-নির রাহি-ম।

আরবী–
الرَّحْمَٰنِ الرَّحِيمِ 

অনুবাদ –
যিনি নিতান্ত মেহেরবান ও দয়ালু।

অন্তরে আল্লাহকে সম্বোধন করতে হবে–
[ এয়া রহমান এয়া রহিম ]

আল্লাহতায়ালা তখন বলেন, "আমার বান্দা আমার গুণাবলী বর্ণনা করেছে।"

(৪) 
উচ্চারণ : মা-লিকি ইয়াওমিদ্দি-ন।

আরবী –
مَالِكِ يَوْمِ الدِّينِ 

অনুবাদ –
যিনি বিচার দিনের মালিক।

মনে মনে সম্বোধন করবে–
[ হে বিচার দিবসের মালিক ]

আল্লাহ্ তখন বলেন, - "আমার বান্দা আমার মহিমা ও বুযুর্গী বর্ণনা করেছে।" আর কখনো বলেছেন, "আমার বান্দা (তার সব কাজ) আমার ওপর সোপর্দ করেছে।"

(৫) 
উচ্চারণ : ইয়্যা-কা না’বুদু ওয়া ইয়্যা-কা নাসতাই’-ন।

আরবী –
إِيَّاكَ نَعْبُدُ وَإِيَّاكَ نَسْتَعِينُ 

অনুবাদ –
আমরা (আমি) একমাত্র আপনারই ইবাদত করি এবং শুধুমাত্র আপনারই সাহায্য প্রার্থনা করি।

মনের বাসনা উপস্থাপন করবে–
[ কোমল অন্তরে ফরিয়াদ করবে- আপনার ইবাদত করি এবং আপনারই অনুগ্রহ, সাহায্য, ক্ষমা তথা সকল ধরনের হিত কামনা করছি ]

তখন আল্লাহ বলেন,– "এটা আমার ও আমার বান্দার মধ্যের ব্যাপার। আর আমার বান্দা যা চাইবে,তা সে পাবে।"

(৬)
উচ্চারণ : ইহদিনাস সিরাতা’ল মুসতাকি’-ম
আরবী –

আরবী –
اهْدِنَا الصِّرَاطَ الْمُسْتَقِيمَ

অনুবাদ –
আমাদেরকে সরল পথ দেখান,

মনের বাসনা থাকবে এরকম–
[ আপনার নির্দেশিত পথে পরিচালিত করুন ]
(যে ভাবে চললে আপনার সন্তুষ্টি পাব এবং রসুল (স.) ও তাঁর পরিবার পরিজনদের মহব্বত অন্তরে দৃঢ় থাকবে]

তখন আল্লাহ বলেন, "এটি (সরল পথ) কেবল আমার (অনুগত) বান্দার জন্য।"

(৭) 
উচ্চারণ : সিরাতা’ল্লা যি-না আনআ’মতা আ’লাইহিম, গা’ইরিল মাগ’দু’বি আ’লাইহিম ওয়ালা দ্বোয়া-ল্লি-ন।

আরবী –
صِرَاطَ الَّذِينَ أَنْعَمْتَ عَلَيْهِمْ غَيْرِ الْمَغْضُوبِ عَلَيْهِمْ وَلَا الضَّالِّينَ 

অনুবাদ –
সে সমস্ত লোকের পথ, যাদেরকে আপনি নেয়ামত দান করেছেন। তাদের পথ নয়, যাদের প্রতি আপনার গজব নাযিল হয়েছে এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়েছে।

মনের বাসনা হতে হবে–
[আপনার হাবীব, তাঁর আহলেবাইত ও উনার অনুগত সাহাবায়ে কিরাম ও আপনার আউলিয়াকেরাম উনাদের পথে। তাদের পথে নয়, যারা আপনার নাফরমানি করেছে এবং যারা অভিশপ্ত ]

তখন আল্লাহ বলেন, "আর আমার বান্দা যা চাইবে, তা সে পাবে।" 
------------------
আমিন
[বি. দ্র. — অনুবাদ কুরআনের থেকে, আল্লাহর জবাব হাদিসের থেকে, অন্তরের অনুভূতি আমার নিজের- যেন তেলাওয়াত করার সময় একাগ্রতা সৃষ্টি হয়। যদি মন না চায় এড়িয়ে চলুন।]

#সুরা_ফাতিহা
#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা

ই'তিকাফ



ই'তিকাফ — 

ই'তিকাফ শব্দটি আরবি। এর অর্থ অবস্থান করা। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিরালায় একনিষ্টভাবে ইবাদত বন্দেগীর মাধ‍্যমে সময় অতিবাহিত করাকে ই'তিকাফ বলা হয়।

যেহেতু সওয়াবের উদ্দেশ্যে যে কোন কাজে নিয়ত করা অপরিহার্য; তাই ই'তিকাফের জন‍্যও নিয়ত করা ওয়াজিব। সেই ই'তিকাফ হোক কয়েক মিনিটের জন‍্য কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন‍্য। নিয়ত হলো মনের সংকল্প। নিয়ত ব‍্যাতিত কোন আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের আজকের এই পোষ্ট বিশেষ করে রমজানুল করীমের শেষদিকে প্রচলিত ই'তিকাফের আলোচনাই উদ্দেশ্যে। আমি তার বিস্তারিত লিখার পূর্বে আরো কিছু ই'তিকাফ আছে সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা করব। এই ই'তিকাফ মানুষ যেকোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ই'তিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা সেটিও এক রকম ই'তিকাফ। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ মন চায় করতে পারে। রোজার প্রয়োজনও এই ই'তিকাফের শর্ত নয়। যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল ই'তিকাফের নিয়ত করা সুন্নাত। যেমন মসজিদে প্রবেশের পূর্বে নিয়ত করবে,- আমি সুন্নতে ই'তিকাফের নিয়ত করে মসজিদে ডুকতেছি। তাহলে যতক্ষন মসজিদে অবস্থানরত থাকবে অহেতুক কথাবার্তা ও কর্মাদি থেকে বিরত থাকবে ততক্ষন ই'তিকাফের সওয়াব পাবে। এই জাতীয় ই'তিকাফ নফল ই'তিকাফের অন্তর্ভুক্ত।
আবার কেউ যদি সংকল্প করে থাকে নির্দিষ্ট সময় বা দিনের ই'তিকাফ; যেমন- কেউ বললো, ‘আমার এই কাজ সমাধা হলে আমি (এক বা দুই দিনের) ই'তিকাফ করবো’, এতে যেমন ই'তিকাফ ওয়াজিব হবে ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে- ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ই'তিকাফ করবো’, এ অবস্থাতেও ই'তিকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে।  তখন ই'তিকাফ তার জন‍্য বাধ‍্যতামূলক হবে। পূর্ণদিবস ই'তিকাফের নিয়ত করলে দিনে রোযা রাখা শর্ত কারণ রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন "ই'তিকাফ হয় না সাওম ব্যতীত।" এবং দিন ও রাত মিলিয়ে একদিন হিসাব সাব‍্যস্ত হবে।

এবার আলোচনা করবো আমাদের মূল উদ্দেশ্য সেই ই'তিকাফ,- যা রমজান মাসের শেষের দিকে পালন করা হয়। সেই ই'তিকাফ হলো সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। কিছু মানুষের আমলের কারণে এলাকার সকলের পক্ষে আদায় হয়ে যাবে। কেউ যদি আদায় না করে সকলেই গুনাহগার হবে। যারা পালন করবে তারা পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। তারাই সৌভাগ্যবান বলে বিবেচিত হবে- যাদের কারণে এলাকার সবাই গুনাহগার হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। 
ইসলামে জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন। তার অর্থ হলো- যেই ইবাদত করার ইচ্ছা করবে সেই ইবাদত সঠিকভাবে  সম্পাদনের জন‍্য তার সুন্নাহ মোতাবেক সম্পাদন করার জন‍্য সেই ইবাদতের নিয়ম নীতি জানা। তাই আমাদের মূল আলোচনার বিষয় হল রমজান মাসের ই'তিকাফ বিষয়ে আলোচনা করা। 

 যে ব‍্যাক্তি রমজানের শেষের দিকে ই'তিকাফের ইচ্ছা করবে তাকে রমজান দ্বিতীয় দশক শেষ হবার পূর্বেই নিয়ত করতে হবে। সেই হিসেবে বিশ রমজান শেষ হলে ই'তিকাফ শুরু। সুতরাং বিশ রমজান আসরের পরপরই সকল প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। যেমন বিছানাপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাতের কাছেই রাখতে হবে যাতে মসজিদ থেকে আর বের হতে না হয়। যেহেতু সূর্যাস্তের পরপরই চন্দ্র-তারিখ শুরু তাই মাগরিবের সময় থেকেই ই'তিকাফের শুরু। একুশ রমজানের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ই'তিকাফের সময়। তা হোক নয় দিন কিংবা দশ দিন। 
শেষ বা তৃতীয়  দশকে গুরুত্বের সঙ্গে ই'তিকাফের ব্যাপারে (মুসলিম শরীফের) হাদিসে আছে,- রাসুলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ই'তিকাফ করলাম। এরপর ই'তিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ই'তিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ই'তিকাফ করে।’ 

ই'তিকাফের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে দুনিয়ার সবার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং সকলের থেকে দূরত্ব অবলম্বন করে আপন মালিকের উদ্দেশ্যে অবস্থান করে থাকা। তাঁকেই স্মরণ করা, তাঁরই ধ্যানে মগ্ন থাকা, তাঁরই যিকির করা, তাঁর দরবারে তওবা ইস্তেগফার করা, নিজের অন্যায় অপরাধ ও গুনাহের জন্য কান্নাকাটি করে, দয়াময় মালিকের কাছে রহমত ও মাগফেরাত প্রার্থনা করা, তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য কামনা করা।

ই'তিকাফের জন‍্য স্থান হতে হবে যেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। তার মধ‍্যে সবচাইতে উত্তম হলো জুমআ মসজিদ। যেখানে জুমআর নামাজও আদায় হয়ে থাকে। তাহলে জুমআর নামাজের জন‍্য বের হবার প্রয়োজন হয়না। হুযায়ফা (রা.) বলেছেন : "জামা'আত অনুষ্ঠিত মসজিদ ছাড়া ই'তিকাফ হতে পারে না।" 

যদি কেউ জুমআ মসজিদ ছারা অন‍্য মসজিদে ই'তিকাফ করেন তখন সে সূর্য যখন ঢলে পড়বে তখনই বের হবে। কেননা (জুমুআর সালাত আদায়ের জন্য) ঐ সময়ের পরই সম্বোধন তার অভিমুখী হয়। যদি তার ই'তিকাফের স্থান জুমুআর মসজিদ থেকে দূরে হয়, তাহলে এমন সময়ে বের হবে যেন জুমুআর সালাত পাওয়া সম্ভব হয়, এবং তার পূর্বে চার রাকাআত, আরেক বর্ণনা মতে ছয় রাকাআত- চার রাকাআত সুন্নাত এবং দু'রাকাআত তাহিয়‍্যাতুল মাসজিদ আদায় করতে পারে। আর সেখানে জুমুআর পরে জুমুআর সুন্নাত সম্পর্কিত মতভেদ অনুযায়ী চার বা ছয় রাকাআত আদায় করবে। জুমুআর সুন্নাত হলো জুমুআর আনুষাঙ্গিক। সুতরাং এ গুলোকে জুমুআর সংগেই যুক্ত করা হয়।
যদি জামে মসজিদে এর চেয়ে বেশী সময় অবস্থান করে তাহলে তার ই'তিকাফ নষ্ট হবে না। কেননা, এটাও ই'তিকাফের স্থান। তবে তা পসন্দনীয় নয়। কেননা সে এক মসজিদে ই'তিকাফ আদায়ের বাধ্যবাধ্যকতা গ্রহণ করেছে, সুতরাং বিনা প্রয়োজনে দুই মসজিদে তা আদায় করবে না।
জুমআর খুতবার পূর্ব ছয় রাকআত নামাজ এবং পরে ছয় রাকআত নামাজ আদায় করার শর্তে ততটুকু সময় বাইরে থাকা সঙ্গত। এর স্বপক্ষে বক্তব্য এই যে, সকল মসজিদেই ই'তিকাফ করা শরীআত সম্মত। আর শুরু করা যখন শুদ্ধ হলো তখন প্রয়োজন বের হওয়ার বৈধতা অবশ্যই দান করবে। 

অবশ্য স্ত্রী লোক তার ঘরের মসজিদে (অর্থাৎ সালাত আদায়ের নির্ধারিত স্থানে) ই'তিকাফ করবে। কেননা সেটাই হলো তার সালাতের স্থান। সুতরাং সালাতের জন্য তার অপেক্ষা সেখানেই বাস্তবায়িত হয়। যদি ঘরে পূর্ব থেকে তার জন্য সালাতের নির্ধারিত কোন স্থান না থাকে তাহলে একটি স্থান নির্ধারণ করে নেবে এবং সেখানে ই'তিকাফ করবে।(হাদিসে আছে,– "মহিলাদের জন‍্য মসজিদের ছেয়ে তাদের ঘরের কোনায় নামাজের জন‍্য উত্তম স্থান" তাই নামাজের স্থানই তাদের জন‍্য ই'তেকাফের উত্তম স্থান। তারা জুমআ নামাজে যাবেনা তাই বের হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ই'তিকাফের স্থান থেকে বের হতে পারবে। 

প্রাকৃতিক প্রয়োজনে এবং জুমুআর উদ্দেশ্য ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হওয়ার বৈধতার প্রমাণ হলো 'আইশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীছ যে, নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁর ই'তিকাফের স্থল থেকে বের হতেন না।

তাছাড়া এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী ও জানা বিষয়। আর তা সারার জন্য বের হওয়া অনিবার্য, সুতরাং এ প্রয়োজনে বের হওয়াটা ই'তিকাফের আওতা বহির্ভূত। তবে তাহারাত থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাইরে বিলম্ব করবে না। কেননা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে যা কার্যকরী, তা প্রয়োজন পরিমাণেই সীমাবদ্ধ। আর জুমুআর বিষয় এ কারণে যে, তা তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ (দীনী) প্রয়োজন। এবং এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া জানা কথা। যদি বিনা প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্যও কেউ মসজিদ থেকে বাইরে যায় তাহলে তার ই'তিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে।

ই'তিকাফকারী কল্যাণমূলক ছাড়া কোন কথা বলবে না। তবে তার পক্ষে একেবারে চুপ থাকা মাকরুহ। কেননা আমাদের শরীআতে নীরবতার রোযা ইবাদতরূপে গণ্য নয়। কিন্তু যেসব কথায় গুনাহ্ হয়, তা পরিহার করে চলবে।

আর মু'তাকিফের জন্য সহবাস হারাম। কেননা আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন: "সহবাস করবে না।" অনুরূপভাবে স্পর্শ ও চুম্বনও হারাম। কেননা, তা সহবাসের আবেদন সৃষ্টিকারী। যদি 'যোনিপথ' হাড়া অন্যভাবে সংগম করে আর বীর্যস্খলন ঘটে কিংবা যদি স্পর্শ বা চুম্বন করে, ফলে বীর্যস্খলন ঘটে তাহলে তার ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর মধ্যে সংগমের মর্ম বিদ্যমান।
যদি রাত্রে কিংবা দিনে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলে সহবাস করে তাহলে তার ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।

ই'তিকাফের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হতে হবে লায়লাতুল কদর তালাশ করা। (কদরের রাত) নিশ্চিত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। কারণ রমজানের শেষ দশদিনের যে কোন এক রাতেই শবে কদর। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

বুখারি শরীফের হাদিসে আছে, নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক রমজানের শেষ ১০ দিন ই'তিকাফ করতেন; কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের বছরে তিনি ২০ দিন ই'তিকাফ করেন। তাহলে বুঝা যায় কেউ যদি দীর্ঘ  ই'তেকাফ রাখতে চায় এটাও সঙ্গত।

জ্ঞানহীন হয়ে গেলে ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়, মহিলাদের মাসিক বা নেফাস শুরু হলে  ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়। কারণ, পবিত্রতা একটি শর্ত। শিরক ও কুফরী করলেও  ই'তিকাফ বাতিল। কারণ ঈমান  ই'তিকাফের পূর্বশর্ত। রোগী দেখা, জানাজা, ইত্যাদি সওয়াবের কাজ হলেও এতে গমন ই'তিকাফকারীর জন‍্য বৈধ নয়। যেখানে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর মতে জুমার নামাজের জন‍্য যাওয়াও অনুমতি নেই, যা ফরজে আইন।

আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুক।
---------

নফল দান-খয়রাত ও তার ফযীলত (এহইয়াউ উলুমিদ্দিন)

নফল দান খয়রাতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমুহ—

রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “সদকা কর যদিও তা একটি খেজুর হয়। কেননা, এটা ক্ষুধার্তের কিছু না কিছু কষ্ট দূর করে এবং গোনাহকে · এমনভাবে নির্বাপিত করে, যেমনভাবে পানি অগ্নি নির্বাপিত করে।” তিনি আরও বলেনঃ

“এক খন্ড খেজুর দান করে হলেও দোযখ থেকে আত্মরক্ষা কর। যদি তা না পাও, তবে ভাল কথা বলে আত্মরক্ষা কর।”


রসূলে করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন : যে মুসলমান বান্দা তার পবিত্র উপার্জন থেকে সদকা করে- আল্লাহ তাআলা পবিত্রকেই গ্রহণ করেন আল্লাহ্ তাআলা এই সদকা ডান হাতে গ্রহণ করেন, অতঃপর তা লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ উটের বাচ্চা লালন-পালন করে। অবশেষে খেজুর বেড়ে ওহুদ পাহাড়ের সমান হয়ে যায়।”


রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) হযরত আবু দারদাকে বললেন : “যখন তুমি শুরবা রান্না কর তখন তাতে বেশী পরিমাণে পানি দাও। অতঃপর তা থেকে প্রতিবেশীদেরকে দান কর।”  তিনি আরও বলেন :  “যে বান্দা ভাল সদকা দেয়, আল্লাহ তার সম্পদে অনেক বরকত দেন।”

এক হাদীসে আছে

“হাশরের মাঠে মানুষের মধ্যে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি তার সদকার ছায়াতলে অবস্থান করবে।” আরও আছে

“সদকা অনিষ্টের সত্তরটি দরজা বন্ধ করে।”  আরও আছে - “গোপন সদকা পালনকর্তার ক্রোধ নির্বাপিত করে।”


এক হাদীসে বলা হয়েছে- “যেব্যক্তি সচ্ছলতাবশতঃ দান করে, সে সওয়াবে সেই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম নয়, যে অভাবের কারণে তা কবুল করে।” 

এর উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ এই, যেব্যক্তি সদকা কবুল করে নিজের অভাব দূর করে, যাতে ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে সেই দাতার সমান, যে তার দান দ্বারা ধর্মের অগ্রগতির নিয়ত করে। 

কেউ রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-কে প্রশ্ন করল : কোনটি সদকা উত্তম? তিনি বললেন : এমন সময়ে সদকা করা উত্তম, যখন মানুষ সুস্থ থাকে, মাল আটকে রাখতে চায়, অনেক দিন বাঁচার আশা রাখে এবং উপবাসকে খুব ভয় করে। সদকা দিতে এতদূর বিলম্ব করবে না যে, মরণোন্মুখ অবস্থায় বলতে থাকবে, এই পরিমাণ অমুককে এবং এই পরিমাণ অমুককে দেবে, অথচ তখন তোমার মাল অন্যের অর্থাৎ ওয়ারিসদের হয়ে গেছে। 


একদিন রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে বললেন : তোমরা সদকা কর। এক ব্যক্তি আরজ করল : আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেনঃ এটি নিজের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে। তিনি বললেন : এটি স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে, তিনি বললেন : এটি সন্তানদের জন্য ব্যয় কর। লোকটি আরজ করল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে, তিনি বললেন এটি খাদেমের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আর একটি দীনার আছে। তিনি বললেন : এটা যেখানে ভাল মনে কর, ব্যয় কর। 

রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন : “মুহাম্মদ পরিবারের জন্যে সদকা হালাল নয়। কারণ, সদকা মানুষের সম্পদের ময়লা।” তিনি আরও বলেন : “যেব্যক্তি ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়, ফেরেশতারা তার গৃহের উপর সাত দিন পর্যন্ত ছায়া দান করেন না।”

 দুটি কাজ রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) অন্যের হাতে সোপর্দ করতেন না- নিজে করতেন। এক, ওযুর পানি নিজে রাখতেন ও তা ঢেকে দিতেন এবং দুই, মিসকীনকে নিজের হাতে দান করতেন। তিনি বলেন : সে ব্যক্তি মিসকীন নয়, যাকে এক খেজুর অথবা দুই খেজুর এবং এক লোকমা অথবা দুই লোকমা দিয়ে বিদায় করা হয়; বরং সেই মিসকীন যে সওয়াল থেকে বিরত থাকে । তুমি এ আয়াত পড়ে দেখ - “তারা মানুষের কাছে গায়ে পড়ে সওয়াল করে না।”

রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন : 

“যে মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে বস্ত্র পরিধান করায়, সে মিসকীনের গায়ে ঐ বস্ত্রের তালি থাকা পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার হেফাযতে থাকে।


নফল সদকা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গগণের উক্তি নিম্নরূপ :


ওরওয়া ইবনে যুবায়র (রা.) বলেনঃ হযরত আয়েশা (রা.) পঞ্চাশ হাজার দেরহাম খয়রাত করেন অথচ তাঁর কোর্তায় তালিই থাকত। 

হযরত ওমর (রা.) বলতেন : ইলাহী, ধনসম্পদ ও ধনাঢ্যতা আমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিকে দান করুন। সম্ভবতঃ সে তা আমাদের অভাবগ্রস্তদেরকে পৌছাবে। 

আবদুল আজীজ ইবনে ওমায়র (রহঃ) বলেন : নামায মানুষকে অর্ধেক পথে পৌঁছায়, রোযা বাদশাহের দ্বারে নিয়ে যায় এবং সদকা বাদশাহের সামনে উপস্থিত করে। 

ইবনে আবিল জা'দ (রহঃ) বলেন : সদকা মানুষ থেকে সত্তর প্রকার অনিষ্ট দূর করে। প্রকাশ্যে সদকা দেয়ার তুলনায় গোপনে দেয়ায় সত্তর গুণ বেশী সওয়াব। সদকা সত্তর শয়তানের চোয়াল বিদীর্ণ করে। 

হযরত ইবনে মসউদ (রা.) বলেন : এক ব্যক্তি সত্তর বছর আল্লাহ তাআলার এবাদত করার পর কোন একটি কবীরা গোনাহ করায় তার এবাদত বাতিল করে দেয়া হল। অতঃপর সে এক মিসকীনের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে এক খন্ড রুটি সদকা করল। ফলে আল্লাহ তার অপরাধ মার্জনা করে সত্তর বছরের এবাদত বহাল করে দিলেন। 

লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে বললেন: তুমি যখন কোন গোনাহ কর, তখন সদকা করবে। 

ইয়াহইয়া ইবনে মুআয (রহ.) বলেন : সদকার দানা ব্যতীত কোন দানা দুনিয়ার পাহাড়ের সমান হয়ে যায় বলে আমার জানা নেই। সদকার দানা অবশ্যই এতটুকু হয়ে যায়। 

আবদুল আজীজ ইবনে আবী রুয়াদ বলেন : প্রথম যমানায় বলা হত, তিনটি বিষয় জান্নাতের ভান্ডারসমূহের মধ্যে দাখিল- রোগ গোপন করা, সদকা গোপন করা এবং বিপদাপদ গোপন করা। 

হযরত ওমর (রা.) বলেন : আমলসমূহ একে অপরের উপর গর্ব করল। সদকা বলল : আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। 

আবদুল্লাহ (রহ.) চিনি খয়রাত করতেন এবং বলতেন : আমি দেখলাম, আল্লাহ তাআলা বলেন : “তোমরা প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত পূর্ণ নেকী পাবে না।” আমি চিনি ভালবাসি, একথা আল্লাহ তাআলা জানেন। 

নখয়ী (রহ.) বলেন : আল্লাহর জন্যে যে বস্তু দেব তাতে কোন দোষ থাকা আমার পছন্দনীয় নয়। 

ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের (রহ.) বলেন : কেয়ামতের দিন মানুষ সকল দিন অপেক্ষা অধিক ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত ও উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। অতঃপর যেব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহর জন্যে ক্ষুধার্তকে আহার দিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে পেট ভরে আহার করাবেন। যেব্যক্তি আল্লাহর জন্যে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র পরিধান করিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে বস্ত্র পরিধান করাবেন। 

হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকে ধনাঢ্য করে দিতেন- তোমাদের মধ্যে ফকীর থাকত না । কিন্তু তিনি একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। 

শা'বী (রহ.) বলেন : ফকীর ধনীর সদকার যতটুকু মুখাপেক্ষী, যদি ধনী তার তুলনায় আপন সদকার সওয়াবের অধিক মুখাপেক্ষী না হয়, তবে তার সদকা অনর্থক। এ সদকা তার মুখে নিক্ষেপ করা হবে। 

ইমাম মালেক (রহ.) বলেন : যে পানি সদকা করা হয় এবং মসজিদে পান করানো হয়, তা থেকে ধনী ব্যক্তি পান করলে আমরা দোষ মনে করি না। কেননা, যে পানি সদকা করে, সে পিপাসার্তদের জন্যে সদকা করে। বিশেষভাবে ফকীর-মিসকীনকে সদকা করার নিয়ত তার থাকে না। 

কথিত আছে, জনৈক দাস বিক্রেতা এক বাঁদী সঙ্গে নিয়ে হযরত হাসান বসরীর কাছ দিয়ে গমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি এই বাঁদী এক দুই দেরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করতে সম্মত আছ কি? সে বলল : না। হাসান বসরী (রহ.) বললেন : যাও, আল্লাহ তাআলা তো এক পয়সা ও এক লোকমা সদকা করার বিনিময়ে বেহেশতের হুর দিতে সম্মত আছেন।

সদকা গোপনে গ্রহণ করা—

আধ্যাত্ম পথের পথিকগণ মতভেদ করেছেন, সদকা গোপনে বা প্রকাশ্যে গ্রহণ করার মধ্যে কোন্‌টি উত্তম। কারও মতে গোপনে গ্রহণ করা উত্তম এবং কেউ বলেন, প্রকাশ্যে গ্রহণ করা ভাল। আমরা প্রথমে উভয় বিষয়ের উপকারিতা ও অপকারিতা বর্ণনা করব, এর পর যা সত্য তার ব্যাখ্যা করব ! প্রকাশ থাকে যে, গোপনে সদকা গ্রহণ করার উপকারিতা পাঁচটি।

(১) গ্রহীতার গোপনীয়তা বজায় থাকে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে ভদ্রতার পর্দা ছিন্ন হয়ে যায়, অভাব প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সওয়াল করার ভীতি দূর হয়ে যায় ।

(২) গোপনে সদকা গ্রহণ করলে মানুষের অন্তর ও মুখ নিরাপদ থাকে। কেননা, প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে মানুষ তার প্রতি হিংসা করে অথবা তার গ্রহণ অপছন্দ করে একথা ভেবে যে, সে ধনী হওয়া সত্ত্বেও সদকা গ্রহণ করেছে অথবা বেশী পরিমাণে গ্রহণ করেছে। 

হিংসা ও কুধারণা বড় গোনাহ। মানুষকে এসব গোনাহ থেকে নিরাপদ রাখা উত্তম। 

আবু আইউব সুখতিয়ানী (রহ.) বলেন :  আমি নতুন বস্ত্র পরিধান করি না এই আশংকায়, কোথাও প্রতিবেশীদের মনে হিংসা সৃষ্টি না হয়ে যায়। 

অন্য এক দরবেশ বলেন : আমি আমার ভাইদের খাতিরে অধিকাংশ বস্তুর ব্যবহার বর্জন করি, যাতে তারা একথা না বলে যে, তার কাছে এটা কোত্থেকে এল? 

ইবরাহীম তায়মীর গায়ে নতুন জামা দেখে কেউ জিজ্ঞেস করল : এটা আপনি কোথায় পেলেন? তিনি বললেন : আমার ভাই' খায়সামা আমাকে পরিধান করিয়েছে। যদি জানতাম, তার পরিবারের লোকেরা এটা জানে, তবে কখনও কবুল করতাম না।

(৩) গোপনে দান গ্রহণ করলে দাতাকে গোপনে আমল করতে সাহায্য করা হয়। বলাবাহুল্য, দান গোপনে করাই উত্তম। অতএব এ ব্যাপারে গ্রহীতা দাতাকে সাহায্য করলে উত্তম কাজে সাহায্য করা হবে, যা নিঃসন্দেহে ভাল । দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রচেষ্টা ছাড়া গোপনে দান হতে পারে না। ফকীর নিজের অবস্থা প্রকাশ করে দিলে দাতার অবস্থাও প্রকাশ হয়ে পড়বে। এক ব্যক্তি জনৈক আলেমকে প্রকাশ্যে কিছু দান করলে তিনি গ্রহণ করলেন না। অন্য এক ব্যক্তি তাকে গোপনে কিছু দান করলে তিনি গ্রহণ করলেন। অতঃপর এ কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেনঃ দ্বিতীয় ব্যক্তি তার খয়রাতে আদব ও নিয়মের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে- গোপনে দিয়েছে। তাই আমি কবুল করেছি। 

এক ব্যক্তি জনৈক দরবেশ সুফীকে জনসমাবেশে কিছু দান করলে দরবেশ তা ফিরিয়ে দিলেন। লোকটি বলল : যে বস্তু আপনাকে আল্লাহ তাআলা দিলেন, তা গ্রহণ করলেন না কেন? দরবেশ বললেন : যে বস্তু একান্তভাবে আল্লাহর ছিল, তাতে অপরকে শরীক করে নিয়েছ। কেবল আল্লাহর দেখা তুমি যথেষ্ট মনে করনি। কাজেই তোমার শেরক আমি তোমার কাছেই ফিরিয়ে দিলাম। 

জনৈক সাধক এক বস্তু গোপনে কবুল করে নিলেন, যা তিনি প্রকাশ্যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দাতা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন : প্রকাশ্যে দেয়ার কারণে তুমি আল্লাহর নাফরমানী করেছিলে। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করিনি। এখন গোপনে দেয়ার কারণে তুমি আল্লাহর আনুগত্য করেছ। তাই আনুগত্যের কাজে আমি তোমাকে সাহায্য করেছি। 

সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন : যদি আমি জানতাম, কোন ব্যক্তি দান করে তার আলোচনা করবে না এবং অন্যের কাছে বলবে না, তবে আমি তার দান গ্রহণ করতাম।

(৪) গোপনে গ্রহণ করলে গ্রহীতা অপমান ও লাঞ্ছনা থেকে বেঁচে থাকে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে লাঞ্ছনা হয়। নিজেকে লাঞ্ছিত করা ঈমানদার ব্যক্তির জন্যে শোভন নয়। কোন আলেমকে গোপনে কেউ কিছু দিলে তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং প্রকাশ্যে দিলে গ্রহণ করতেন না। তিনি বলতেন : প্রকাশ্যে নেয়ার মধ্যে এলেমের লাঞ্ছনা এবং আলেমগণের বেইযযতী হয়। তাই আমি দুনিয়ার ধন-সম্পদকে উঁচু করে বিনিময়ে এলেম ও আলেমগণকে নীচু করি না।

(৫) গোপনে গ্রহণ করলে শরীকানার সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা যায় । কারণ, রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “যেব্যক্তির কাছে কোন উপঢৌকন আসে, তার কাছে যত লোক থাকে, তারা সকলেই উপঢৌকনে শরীক থাকে। স্বর্ণ-রৌপ্য হলেও তা উপঢৌকন। কেননা, রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : মানুষের দেয়া উত্তম উপঢৌকন হচ্ছে রূপা অথবা খাদ্য, যা খাওয়ানো হয়। এতে রূপাকেও উপঢৌকন বলা হয়েছে। এ থেকে জানা গেল, জনসমাবেশে সকলের সম্মতি ছাড়া বিশেষ কোন ব্যক্তিকে কিছু দেয়া মাকরূহ। সকলের সম্মতি সন্দিগ্ধ বিধায় একান্তে দিলে এই সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা যায় ।


সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা—

এখন সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা এবং অন্যের কাছে তার আলোচনা করার মধ্যে যেসকল উপকারিতা রয়েছে, সেগুলো বর্ণিত হচ্ছে। এতে চারটি উপকারিতা আছে।

(১) সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে আন্তরিকতা ও সততা প্রকাশ পায়, নিজের অবস্থা সম্পর্কে অপরকে ধোঁকা দেয়া হয় না এবং রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়। কারণ, এতে বাস্তব অবস্থাই প্রকাশ পায়।  

এরূপ হয় না যে, বাস্তব অবস্থা অন্যরূপ এবং লোক দেখানোর উদ্দেশ তা প্রকাশ করা হয় না।


(২) প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে জাঁকজমকপ্রীতি দূর হয়ে যায়, দাসত্ব ও দীনতা প্রকাশ পায়, অহংকার ও অভাবমুক্ততার দাবী থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং মানুষের দৃষ্টিতে হেয় হওয়া যায়। এ কারণেই জনৈক সাধক তাঁর শিষ্যকে বলেন : সদকা সর্বাবস্থায় প্রকাশ্যে নেবে। এরূপ করলে তোমার ব্যাপারে মানুষ দু'দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। 

এক দল হবে, যাদের মনে তোমার কোন মর্যাদা থাকবে না । এট তো অভীষ্ট লক্ষ্যই। কেননা, এটা তোমার ধর্মের নিরাপত্তার জন্য অধিক উপকারী । 

আরেক দল হবে, যাদের মনে তোমার প্রতি সহানুভূতি বেশী হবে। কারণ, তুমি আপন অবস্থা ঠিক ঠিক প্রকাশ করে দিয়েছ। এটা তোমার ভাইয়ের কাম্য। কারণ, তার উদ্দেশ্য বেশী বেশী সওয়াব পাওয়া। সে যখন তোমাকে মহব্বত বেশী করবে তখন সে সওয়াবও অবশ্যই পাবে। এ সওয়াব তুমিও পাবে। কেননা, তার সওয়াব বেশী হওয়ার কারণ তুমিই।


(৩) প্রকাশ্যে সদকা গ্রহণ করলে তওহীদকে শেরক থেকে বাঁচানো যায়। কেননা, সাধকের দৃষ্টি মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য দিকে নিবদ্ধ হয় না। গোপনও প্রকাশ্য তার জন্যে সমান। এ অবস্থার পরিবর্তন তওহীদে শেরকের নামান্তর । জনৈক বুযুর্গ বলেন : যেব্যক্তি গোপনে গ্রহণ এবং প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করত, আমরা তার দোয়ার কোনই মূল্য দিতাম না । উপস্থিত অথবা অনুপস্থিত মানুষের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হালের ক্ষতি বৈ নয়। দৃষ্টি সর্বদা এক আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট থাকা উচিত। 

কথিত আছে, জনৈক বুযুর্গ তাঁর মুরীদগণের মধ্যে একজনের প্রতি অধিক আকৃষ্ট ছিলেন। এটা অন্য মুরীদদের কাছে দুঃসহ মনে হলে বুযুর্গ ব্যক্তি তাদের কাছে সেই মুরীদের শেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে চাইলেন। সেমতে প্রত্যেক মুরীদকে একটি করে মুরগী দিয়ে তিনি বললেন : প্রত্যেকেই আপন আপন মুরগী এমন জায়গা থেকে জবাই করে আনবে, যেখানে অন্য কেউ না দেখে। সকল মুরীদ গিয়ে আপন আপন মুরগী জবাই করে আনল । কিন্তু সেই মুরীদ জীবিত মুরগী নিয়ে এল । বুযুর্গ তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল : আমি এমন কোন জায়গা খুঁজে পেলাম না, যেখানে কেউ দেখে না। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা সর্বত্রই দেখেন। বুযুর্গ ব্যক্তি মুরীদগণকে বললেন : এ কারণেই আমি তার প্রতি অধিক আকৃষ্ট । সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর প্রতি ধ্যান দেয় না ।


(৪) প্রকাশ্যে সদকা গ্রহণ করলে শোকরের সুন্নত আদায় হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,-“তুমি তোমার পালনকর্তার নেয়ামত বর্ণনা কর। নেয়ামত গোপন করা অকৃতজ্ঞতার শামিল । যারা আল্লাহর নেয়ামত গোপন করে, আল্লাহ তাদের নিন্দা করেন এবং কৃপণ আখ্যা দেন। 

বলা হয়েছে : “যারা কৃপণতা করে, মানুষকে কৃপণতা করতে আদেশ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ গোপন করে।


রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তাআলা যখন কোন বান্দাকে নেয়ামত দেন, তখন বান্দাকে সেই নেয়ামতের উপযোগী দেখাও পছন্দ করেন। এক ব্যক্তি জনৈক সাধককে গোপনে কিছু দিলে সাধক আপন হাত উঁচু করে বললেন : এটা দুনিয়ার বস্তু। এটা প্রকাশ্যে দেয়া উত্তম। আখেরাতের কাজ গোপন করা উত্তম। এ কারণেই জনৈক বুযুর্গ বলেন : তোমাকে জনসমাবেশে কিছু দেয়া হলে তুমি তা গ্রহণ কর। এর পর একান্তে তা ফেরত দিয়ে দাও। সদকার ক্ষেত্রে শোকরের প্রতি উৎসাহ বর্ণিত আছে। রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ 

যে মানুষের শোকর করে না, সে আল্লাহরও শোকর করে না। শোকর প্রতিদানের স্থলবর্তী হয়ে থাকে। রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : কেউ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলে তুমি তার প্রতিদান দাও। প্রতিদান সম্ভব না হলে উত্তমরূপে তার প্রশংসা কর এবং সেই পর্যন্ত দোয়া কর, যে পর্যন্ত প্রতিদান হয়ে গেছে বলে তোমার বিশ্বাস না জন্মে। মুহাজিরগণ মদীনায় রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে শোকর সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন ঃ ইয়া রসূলাল্লাহ্, আমরা আনসারদের চেয়ে উত্তম লোক দেখিনি। আমরা তাঁদের কাছে এলে তাঁরা আপন বিষয়-সম্পত্তি আমাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছেন। আমাদের আশংকা হচ্ছে, সব সওয়াব তাঁরাই নিয়ে যাবেন । রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: না, তা নয়। তোমরা যে তাঁদের শোকর করেছ এবং প্রশংসা করেছ, এতে প্রতিদান হয়ে গেছে।


সদকা গোপন ও প্রকাশ্যে গ্রহন করার মতভেদের কারণ—

এসব উপকারিতা জানার পর এখন জানা দরকার, এ সম্পর্কে বর্ণিত মতভেদ মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে নয়; বরং এটা হাল তথা অবস্থার মতভেদ।

এ ক্ষেত্রে সত্য এই যে, গোপনে গ্রহণ করা সর্বাবস্থায় উত্তম অথবা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা ভাল, একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। বরং এটা নিয়তের বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হয়ে থাকে। হাল ও ব্যক্তির পার্থক্যের কারণে নিয়ত আলাদা আলাদা হয়ে যায়। এমতাবস্থায় এখলাসবিশিষ্ট ব্যক্তির উচিত নিজের দেখাশুনা করা এবং বিভ্রান্তিতে না পড়া। এ ব্যাপারে মনের প্রতারণা ও শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করার তুলনায় গোপনে গ্রহণ করার কারণসমূহের মধ্যে ধোঁকা প্রতারণা বেশী রয়েছে- যদিও উভয়ের মধ্যেই প্রতারণা আছে। গোপনে গ্রহণ করার মধ্যে প্রতারণার কারণ, মন গোপনে গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী থাকে। কারণ, এতে জাঁকজমক ও মর্যাদা বহাল থাকে। মানুষের দৃষ্টিতে সম্মান ঠিক থাকে। কেউ মিসকীনকে ঘৃণার দৃষ্টিতে এবং দাতাকে তার প্রতি অনুগ্রহকারী ও নেয়ামতদানকারীরূপে দেখে না। এই রোগ মনের মধ্যে গোপন থাকে এবং শয়তান এর মাধ্যমে উপকারিতা প্রকাশ করে। এমনকি, পূর্ববর্ণিত পাঁচটি উপকারিতাকেই গোপনে গ্রহণ করার কারণরূপে উল্লেখ করে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করার প্রতিও মন আগ্রহী থাকে। কারণ, এতে দাতার মন প্রফুল্ল হয় এবং সে দানে উৎসাহিত হয়। এখানে শয়তান বলে, শোকর আদায় করা সুন্নত এবং গোপন রাখা রিয়া। এমনকি, শয়তান পূর্বোল্লিখিত চারটি উপকারিতাকেও প্রমাণস্বরূপ পেশ করে, যাতে প্রকাশ্যে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা যায়।

অতএব ফয়সালা এই যে, দাতাকে দেখতে হবে। যদি সে শোকর ও প্রকাশ্যে দেয়া পছন্দ করে, তবে তার দান গোপন রাখবে এবং শোকর করবে না। কেননা, শোকর তলব করা একটি জুলুম। এই জুলুমের কাজে তাকে সাহায্য না করা চাই। পক্ষান্তরে যদি দাতা শোকর পছন্দ না করে, তবে গ্রহীতা তার শোকর করবে এবং দান প্রকাশ করবে। এ কারণেই রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে লোকেরা এক ব্যক্তির প্রশংসা করলে তিনি বললেন: তোমরা তাকে মেরে ফেলেছ। সে শুনলে কল্যাণ প্রাপ্ত হবে না। অথচ রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের প্রশংসা তাদের উপস্থিতিতে করতেন। কারণ, তিনি তাদের ব্যাপারে আস্থাশীল ছিলেন, এ প্রশংসা তাদের জন্যে ক্ষতিকর হবে না। বরং তাদের সৎ কাজের প্রতি উৎসাহ আরও বৃদ্ধি করবে। উদাহরণতঃ তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন : সে গেঁয়ো লোকদের সর্দার। অন্য এক ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন : তোমাদের কাছে কোন সম্প্রদায়ের সর্দার আগমন করলে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। এক ব্যক্তির কথাবার্তা রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর খুব ভাল লাগলে তিনি বললেন : “নিঃসন্দেহে কিছু বর্ণনা জাদু হয়ে থাকে।”


তিনি আরও বলেন : “মুমিনের প্রশংসা করা হলে তার অন্তরে ঈমান বৃদ্ধি পায়।” 

সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন : যেব্যক্তি নিজেকে সম্যক চেনে, মানুষের প্রশংসা তার জন্যে ক্ষতিকর হয় না। 

সারকথা, জনসমাবেশে গ্রহণ করা এবং একান্তে না করা উত্তম ও নিরাপদ পন্থা। হাঁ, যদি মারেফত কামেল হয় এবং প্রকাশ্যে গ্রহণ ও গোপনে গ্রহণ উভয়টি সমান হয়ে যায়, তবে গোপনে গ্রহণ করার মধ্যেও দোষ নেই । কিন্তু এরূপ ব্যক্তি অত্যন্ত বিরল। আলোচনায় আছে— বাস্তবে পাওয়া ভার। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন এবং তওফীক দান করুন।

সদকা গ্রহণ করা উত্তম না যাকাত—

ইবরাহীম খাওয়াস, জুনায়দ বাগদাদী প্রমুখ বুযুর্গের অভিমত হচ্ছে, যাকাতের তুলনায় সদকার অর্থ গ্রহণ করা উত্তম। কেননা, যাকাতের অর্থ গ্রহণ করলে মিসকীনদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়। এছাড়া যাকাতের হকদার হওয়ার জন্যে যেসকল বিশেষণ ও শর্ত উল্লিখিত আছে, সেগুলো নিজের মধ্যে থাকে না। সদকার মধ্যে এ ব্যাপারে অবকাশ বেশী । কেউ কেউ বলেন : যাকাত গ্রহণ করা উচিত- সদকা নয়। কেননা, যাকাত গ্রহণ করলে মানুষকে ফরয আদায়ে সাহায্য করা হয়। সকল মিসকীন যাকাত নেয়া ত্যাগ করলে সকল মানুষ গোনাগার হবে। এছাড়া যাকাত কারও অনুগ্রহ নয়। এটা মালদারের যিম্মায় আল্লাহর ওয়াজেব হক। এর মাধ্যমে অভাবী বান্দাদের রুজি অর্জিত হয়। আরও কারণ, যাকাত অভাবের কারণে গ্রহণ করা হয়। অভাব প্রত্যেক ব্যক্তির নিশ্চিতরূপে জানা থাকে। কিন্তু সদকা গ্রহণ করা দ্বীনদারীর কারণে হয়। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাতা তাকেই সদকা দেয়, যার দ্বীনদারী সম্পর্কে তার বিশ্বাস থাকে ।

এক্ষেত্রে সত্য হচ্ছে, এ বিষয়টি প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন রূপ হয়। যে ধরনের অবস্থা প্রবল এবং যেরূপ নিয়ত হয়, সেই ধরনের বিধান হয়ে থাকে। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি সন্দেহ করে, তার মধ্যে যাকাতের হকদার হওয়ার শর্ত আছে কিনা, তবে তার যাকাত গ্রহণ না করা উচিত । আর যদি নিজেকে হকদার বলে নিশ্চিতরূপে জানে, তবে যাকাত গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণতঃ এক ব্যক্তির যিম্মায় ঋণ আছে, যা সে উত্তম পথে ব্যয় করেছে। এখন ঋণ শোধ করার কোন উপায় নেই। এরূপ ব্যক্তি নিশ্চিতরূপেই যাকাতের হকদার। তাকে সদকা ও যাকাতের মধ্যে এখতিয়ার দেয়া হলে সে চিন্তা করবে- যদি আমি এই সদকা গ্রহণ না করি, তবে মালিক সদকা করবে না। এমতাবস্থায় সে সদকাই গ্রহণ করবে। আর যদি যাকাত নিলে মিসকীনদের কোন অসুবিধা না হয়, তবে সদকা ও যাকাত প্রত্যেকটি গ্রহণ করবে। এতদসত্ত্বেও নফসকে হেয় করার ব্যাপারে যাকাত গ্রহণের প্রভাব সম্ভবতঃ অনেক বেশী ।

_______


__