ই'তিকাফ



ই'তিকাফ — 

ই'তিকাফ শব্দটি আরবি। এর অর্থ অবস্থান করা। ইসলামি পরিভাষায় আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে নিরালায় একনিষ্টভাবে ইবাদত বন্দেগীর মাধ‍্যমে সময় অতিবাহিত করাকে ই'তিকাফ বলা হয়।

যেহেতু সওয়াবের উদ্দেশ্যে যে কোন কাজে নিয়ত করা অপরিহার্য; তাই ই'তিকাফের জন‍্যও নিয়ত করা ওয়াজিব। সেই ই'তিকাফ হোক কয়েক মিনিটের জন‍্য কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন‍্য। নিয়ত হলো মনের সংকল্প। নিয়ত ব‍্যাতিত কোন আমলই আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
আমাদের আজকের এই পোষ্ট বিশেষ করে রমজানুল করীমের শেষদিকে প্রচলিত ই'তিকাফের আলোচনাই উদ্দেশ্যে। আমি তার বিস্তারিত লিখার পূর্বে আরো কিছু ই'তিকাফ আছে সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা করব। এই ই'তিকাফ মানুষ যেকোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ই'তিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা সেটিও এক রকম ই'তিকাফ। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ মন চায় করতে পারে। রোজার প্রয়োজনও এই ই'তিকাফের শর্ত নয়। যখনই মসজিদে প্রবেশ করবে নফল ই'তিকাফের নিয়ত করা সুন্নাত। যেমন মসজিদে প্রবেশের পূর্বে নিয়ত করবে,- আমি সুন্নতে ই'তিকাফের নিয়ত করে মসজিদে ডুকতেছি। তাহলে যতক্ষন মসজিদে অবস্থানরত থাকবে অহেতুক কথাবার্তা ও কর্মাদি থেকে বিরত থাকবে ততক্ষন ই'তিকাফের সওয়াব পাবে। এই জাতীয় ই'তিকাফ নফল ই'তিকাফের অন্তর্ভুক্ত।
আবার কেউ যদি সংকল্প করে থাকে নির্দিষ্ট সময় বা দিনের ই'তিকাফ; যেমন- কেউ বললো, ‘আমার এই কাজ সমাধা হলে আমি (এক বা দুই দিনের) ই'তিকাফ করবো’, এতে যেমন ই'তিকাফ ওয়াজিব হবে ঠিক তেমনই কেউ যদি বলে- ‘আমি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ই'তিকাফ করবো’, এ অবস্থাতেও ই'তিকাফ করা ওয়াজিব বলে সাব্যস্ত হবে।  তখন ই'তিকাফ তার জন‍্য বাধ‍্যতামূলক হবে। পূর্ণদিবস ই'তিকাফের নিয়ত করলে দিনে রোযা রাখা শর্ত কারণ রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন "ই'তিকাফ হয় না সাওম ব্যতীত।" এবং দিন ও রাত মিলিয়ে একদিন হিসাব সাব‍্যস্ত হবে।

এবার আলোচনা করবো আমাদের মূল উদ্দেশ্য সেই ই'তিকাফ,- যা রমজান মাসের শেষের দিকে পালন করা হয়। সেই ই'তিকাফ হলো সুন্নতে মোয়াক্কাদা আলাল কেফায়া। কিছু মানুষের আমলের কারণে এলাকার সকলের পক্ষে আদায় হয়ে যাবে। কেউ যদি আদায় না করে সকলেই গুনাহগার হবে। যারা পালন করবে তারা পূর্ণ সওয়াবের অধিকারী হবে। তারাই সৌভাগ্যবান বলে বিবেচিত হবে- যাদের কারণে এলাকার সবাই গুনাহগার হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। 
ইসলামে জ্ঞান অর্জন করা ফরযে আইন। তার অর্থ হলো- যেই ইবাদত করার ইচ্ছা করবে সেই ইবাদত সঠিকভাবে  সম্পাদনের জন‍্য তার সুন্নাহ মোতাবেক সম্পাদন করার জন‍্য সেই ইবাদতের নিয়ম নীতি জানা। তাই আমাদের মূল আলোচনার বিষয় হল রমজান মাসের ই'তিকাফ বিষয়ে আলোচনা করা। 

 যে ব‍্যাক্তি রমজানের শেষের দিকে ই'তিকাফের ইচ্ছা করবে তাকে রমজান দ্বিতীয় দশক শেষ হবার পূর্বেই নিয়ত করতে হবে। সেই হিসেবে বিশ রমজান শেষ হলে ই'তিকাফ শুরু। সুতরাং বিশ রমজান আসরের পরপরই সকল প্রস্তুতি শেষ করতে হবে। যেমন বিছানাপত্র ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী হাতের কাছেই রাখতে হবে যাতে মসজিদ থেকে আর বের হতে না হয়। যেহেতু সূর্যাস্তের পরপরই চন্দ্র-তারিখ শুরু তাই মাগরিবের সময় থেকেই ই'তিকাফের শুরু। একুশ রমজানের রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এই ই'তিকাফের সময়। তা হোক নয় দিন কিংবা দশ দিন। 
শেষ বা তৃতীয়  দশকে গুরুত্বের সঙ্গে ই'তিকাফের ব্যাপারে (মুসলিম শরীফের) হাদিসে আছে,- রাসুলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আমি কদরের রাতের সন্ধানে প্রথম ১০ দিন ই'তিকাফ করলাম। এরপর ই'তিকাফ করলাম মধ্যবর্তী ১০ দিন। অতঃপর ওহি প্রেরণ করে আমাকে জানানো হলো যে তা শেষ ১০ দিনে। সুতরাং তোমাদের যে ই'তিকাফ পছন্দ করবে, সে যেন ই'তিকাফ করে।’ 

ই'তিকাফের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে দুনিয়ার সবার নিকট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এবং সকলের থেকে দূরত্ব অবলম্বন করে আপন মালিকের উদ্দেশ্যে অবস্থান করে থাকা। তাঁকেই স্মরণ করা, তাঁরই ধ্যানে মগ্ন থাকা, তাঁরই যিকির করা, তাঁর দরবারে তওবা ইস্তেগফার করা, নিজের অন্যায় অপরাধ ও গুনাহের জন্য কান্নাকাটি করে, দয়াময় মালিকের কাছে রহমত ও মাগফেরাত প্রার্থনা করা, তার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য কামনা করা।

ই'তিকাফের জন‍্য স্থান হতে হবে যেখানে নিয়মিত নামাজ আদায় করা হয়। তার মধ‍্যে সবচাইতে উত্তম হলো জুমআ মসজিদ। যেখানে জুমআর নামাজও আদায় হয়ে থাকে। তাহলে জুমআর নামাজের জন‍্য বের হবার প্রয়োজন হয়না। হুযায়ফা (রা.) বলেছেন : "জামা'আত অনুষ্ঠিত মসজিদ ছাড়া ই'তিকাফ হতে পারে না।" 

যদি কেউ জুমআ মসজিদ ছারা অন‍্য মসজিদে ই'তিকাফ করেন তখন সে সূর্য যখন ঢলে পড়বে তখনই বের হবে। কেননা (জুমুআর সালাত আদায়ের জন্য) ঐ সময়ের পরই সম্বোধন তার অভিমুখী হয়। যদি তার ই'তিকাফের স্থান জুমুআর মসজিদ থেকে দূরে হয়, তাহলে এমন সময়ে বের হবে যেন জুমুআর সালাত পাওয়া সম্ভব হয়, এবং তার পূর্বে চার রাকাআত, আরেক বর্ণনা মতে ছয় রাকাআত- চার রাকাআত সুন্নাত এবং দু'রাকাআত তাহিয়‍্যাতুল মাসজিদ আদায় করতে পারে। আর সেখানে জুমুআর পরে জুমুআর সুন্নাত সম্পর্কিত মতভেদ অনুযায়ী চার বা ছয় রাকাআত আদায় করবে। জুমুআর সুন্নাত হলো জুমুআর আনুষাঙ্গিক। সুতরাং এ গুলোকে জুমুআর সংগেই যুক্ত করা হয়।
যদি জামে মসজিদে এর চেয়ে বেশী সময় অবস্থান করে তাহলে তার ই'তিকাফ নষ্ট হবে না। কেননা, এটাও ই'তিকাফের স্থান। তবে তা পসন্দনীয় নয়। কেননা সে এক মসজিদে ই'তিকাফ আদায়ের বাধ্যবাধ্যকতা গ্রহণ করেছে, সুতরাং বিনা প্রয়োজনে দুই মসজিদে তা আদায় করবে না।
জুমআর খুতবার পূর্ব ছয় রাকআত নামাজ এবং পরে ছয় রাকআত নামাজ আদায় করার শর্তে ততটুকু সময় বাইরে থাকা সঙ্গত। এর স্বপক্ষে বক্তব্য এই যে, সকল মসজিদেই ই'তিকাফ করা শরীআত সম্মত। আর শুরু করা যখন শুদ্ধ হলো তখন প্রয়োজন বের হওয়ার বৈধতা অবশ্যই দান করবে। 

অবশ্য স্ত্রী লোক তার ঘরের মসজিদে (অর্থাৎ সালাত আদায়ের নির্ধারিত স্থানে) ই'তিকাফ করবে। কেননা সেটাই হলো তার সালাতের স্থান। সুতরাং সালাতের জন্য তার অপেক্ষা সেখানেই বাস্তবায়িত হয়। যদি ঘরে পূর্ব থেকে তার জন্য সালাতের নির্ধারিত কোন স্থান না থাকে তাহলে একটি স্থান নির্ধারণ করে নেবে এবং সেখানে ই'তিকাফ করবে।(হাদিসে আছে,– "মহিলাদের জন‍্য মসজিদের ছেয়ে তাদের ঘরের কোনায় নামাজের জন‍্য উত্তম স্থান" তাই নামাজের স্থানই তাদের জন‍্য ই'তেকাফের উত্তম স্থান। তারা জুমআ নামাজে যাবেনা তাই বের হওয়ার প্রশ্নই আসেনা। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে ই'তিকাফের স্থান থেকে বের হতে পারবে। 

প্রাকৃতিক প্রয়োজনে এবং জুমুআর উদ্দেশ্য ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারবে না। প্রাকৃতিক প্রয়োজনে বের হওয়ার বৈধতার প্রমাণ হলো 'আইশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদীছ যে, নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) প্রাকৃতিক প্রয়োজন ছাড়া তাঁর ই'তিকাফের স্থল থেকে বের হতেন না।

তাছাড়া এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া অবশ্যম্ভাবী ও জানা বিষয়। আর তা সারার জন্য বের হওয়া অনিবার্য, সুতরাং এ প্রয়োজনে বের হওয়াটা ই'তিকাফের আওতা বহির্ভূত। তবে তাহারাত থেকে ফারেগ হওয়ার পর বাইরে বিলম্ব করবে না। কেননা প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে যা কার্যকরী, তা প্রয়োজন পরিমাণেই সীমাবদ্ধ। আর জুমুআর বিষয় এ কারণে যে, তা তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ (দীনী) প্রয়োজন। এবং এ প্রয়োজন দেখা দেওয়া জানা কথা। যদি বিনা প্রয়োজনে কিছু সময়ের জন্যও কেউ মসজিদ থেকে বাইরে যায় তাহলে তার ই'তিকাফ ফাসিদ হয়ে যাবে।

ই'তিকাফকারী কল্যাণমূলক ছাড়া কোন কথা বলবে না। তবে তার পক্ষে একেবারে চুপ থাকা মাকরুহ। কেননা আমাদের শরীআতে নীরবতার রোযা ইবাদতরূপে গণ্য নয়। কিন্তু যেসব কথায় গুনাহ্ হয়, তা পরিহার করে চলবে।

আর মু'তাকিফের জন্য সহবাস হারাম। কেননা আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন: "সহবাস করবে না।" অনুরূপভাবে স্পর্শ ও চুম্বনও হারাম। কেননা, তা সহবাসের আবেদন সৃষ্টিকারী। যদি 'যোনিপথ' হাড়া অন্যভাবে সংগম করে আর বীর্যস্খলন ঘটে কিংবা যদি স্পর্শ বা চুম্বন করে, ফলে বীর্যস্খলন ঘটে তাহলে তার ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে। কেননা এর মধ্যে সংগমের মর্ম বিদ্যমান।
যদি রাত্রে কিংবা দিনে ইচ্ছাকৃতভাবে কিংবা ভুলে সহবাস করে তাহলে তার ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যাবে।

ই'তিকাফের দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হতে হবে লায়লাতুল কদর তালাশ করা। (কদরের রাত) নিশ্চিত ইবাদতের মাধ্যমে অতিবাহিত করা। কারণ রমজানের শেষ দশদিনের যে কোন এক রাতেই শবে কদর। যা পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে।

বুখারি শরীফের হাদিসে আছে, নবী করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) প্রত্যেক রমজানের শেষ ১০ দিন ই'তিকাফ করতেন; কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের বছরে তিনি ২০ দিন ই'তিকাফ করেন। তাহলে বুঝা যায় কেউ যদি দীর্ঘ  ই'তেকাফ রাখতে চায় এটাও সঙ্গত।

জ্ঞানহীন হয়ে গেলে ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়, মহিলাদের মাসিক বা নেফাস শুরু হলে  ই'তিকাফ বাতিল হয়ে যায়। কারণ, পবিত্রতা একটি শর্ত। শিরক ও কুফরী করলেও  ই'তিকাফ বাতিল। কারণ ঈমান  ই'তিকাফের পূর্বশর্ত। রোগী দেখা, জানাজা, ইত্যাদি সওয়াবের কাজ হলেও এতে গমন ই'তিকাফকারীর জন‍্য বৈধ নয়। যেখানে ইমাম শাফেয়ী (রহ.) এর মতে জুমার নামাজের জন‍্য যাওয়াও অনুমতি নেই, যা ফরজে আইন।

আল্লাহ তা'আলা আমাদেরকে বিষয়গুলি সঠিকভাবে বুঝার ও আমল করার তাওফীক দান করুক।
---------

No comments:

__