নফল দান খয়রাতের ফযীলত সম্পর্কিত হাদীসসমুহ—
রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “সদকা কর যদিও তা একটি খেজুর হয়। কেননা, এটা ক্ষুধার্তের কিছু না কিছু কষ্ট দূর করে এবং গোনাহকে · এমনভাবে নির্বাপিত করে, যেমনভাবে পানি অগ্নি নির্বাপিত করে।” তিনি আরও বলেনঃ
“এক খন্ড খেজুর দান করে হলেও দোযখ থেকে আত্মরক্ষা কর। যদি তা না পাও, তবে ভাল কথা বলে আত্মরক্ষা কর।”
রসূলে করীম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন : যে মুসলমান বান্দা তার পবিত্র উপার্জন থেকে সদকা করে- আল্লাহ তাআলা পবিত্রকেই গ্রহণ করেন আল্লাহ্ তাআলা এই সদকা ডান হাতে গ্রহণ করেন, অতঃপর তা লালন-পালন করেন, যেমন তোমাদের কেউ উটের বাচ্চা লালন-পালন করে। অবশেষে খেজুর বেড়ে ওহুদ পাহাড়ের সমান হয়ে যায়।”
রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) হযরত আবু দারদাকে বললেন : “যখন তুমি শুরবা রান্না কর তখন তাতে বেশী পরিমাণে পানি দাও। অতঃপর তা থেকে প্রতিবেশীদেরকে দান কর।” তিনি আরও বলেন : “যে বান্দা ভাল সদকা দেয়, আল্লাহ তার সম্পদে অনেক বরকত দেন।”
এক হাদীসে আছে
“হাশরের মাঠে মানুষের মধ্যে ফয়সালা না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ব্যক্তি তার সদকার ছায়াতলে অবস্থান করবে।” আরও আছে
“সদকা অনিষ্টের সত্তরটি দরজা বন্ধ করে।” আরও আছে - “গোপন সদকা পালনকর্তার ক্রোধ নির্বাপিত করে।”
এক হাদীসে বলা হয়েছে- “যেব্যক্তি সচ্ছলতাবশতঃ দান করে, সে সওয়াবে সেই ব্যক্তির চেয়ে উত্তম নয়, যে অভাবের কারণে তা কবুল করে।”
এর উদ্দেশ্য সম্ভবতঃ এই, যেব্যক্তি সদকা কবুল করে নিজের অভাব দূর করে, যাতে ধর্মের কাজে আত্মনিয়োগ করতে পারে, সে সেই দাতার সমান, যে তার দান দ্বারা ধর্মের অগ্রগতির নিয়ত করে।
কেউ রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-কে প্রশ্ন করল : কোনটি সদকা উত্তম? তিনি বললেন : এমন সময়ে সদকা করা উত্তম, যখন মানুষ সুস্থ থাকে, মাল আটকে রাখতে চায়, অনেক দিন বাঁচার আশা রাখে এবং উপবাসকে খুব ভয় করে। সদকা দিতে এতদূর বিলম্ব করবে না যে, মরণোন্মুখ অবস্থায় বলতে থাকবে, এই পরিমাণ অমুককে এবং এই পরিমাণ অমুককে দেবে, অথচ তখন তোমার মাল অন্যের অর্থাৎ ওয়ারিসদের হয়ে গেছে।
একদিন রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবীগণকে বললেন : তোমরা সদকা কর। এক ব্যক্তি আরজ করল : আমার কাছে একটি দীনার আছে। তিনি বললেনঃ এটি নিজের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে। তিনি বললেন : এটি স্ত্রীর জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আরও একটি দীনার আছে, তিনি বললেন : এটি সন্তানদের জন্য ব্যয় কর। লোকটি আরজ করল, আমার কাছে আরেকটি দীনার আছে, তিনি বললেন এটি খাদেমের জন্যে ব্যয় কর। লোকটি বলল : আমার কাছে আর একটি দীনার আছে। তিনি বললেন : এটা যেখানে ভাল মনে কর, ব্যয় কর।
রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন : “মুহাম্মদ পরিবারের জন্যে সদকা হালাল নয়। কারণ, সদকা মানুষের সম্পদের ময়লা।” তিনি আরও বলেন : “যেব্যক্তি ভিক্ষুককে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয়, ফেরেশতারা তার গৃহের উপর সাত দিন পর্যন্ত ছায়া দান করেন না।”
দুটি কাজ রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) অন্যের হাতে সোপর্দ করতেন না- নিজে করতেন। এক, ওযুর পানি নিজে রাখতেন ও তা ঢেকে দিতেন এবং দুই, মিসকীনকে নিজের হাতে দান করতেন। তিনি বলেন : সে ব্যক্তি মিসকীন নয়, যাকে এক খেজুর অথবা দুই খেজুর এবং এক লোকমা অথবা দুই লোকমা দিয়ে বিদায় করা হয়; বরং সেই মিসকীন যে সওয়াল থেকে বিরত থাকে । তুমি এ আয়াত পড়ে দেখ - “তারা মানুষের কাছে গায়ে পড়ে সওয়াল করে না।”
রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) আরও বলেন :
“যে মুসলমান অন্য কোন মুসলমানকে বস্ত্র পরিধান করায়, সে মিসকীনের গায়ে ঐ বস্ত্রের তালি থাকা পর্যন্ত আল্লাহ্ তাআলার হেফাযতে থাকে।
নফল সদকা সম্পর্কে সাহাবায়ে কেরাম ও বুযুর্গগণের উক্তি নিম্নরূপ :
ওরওয়া ইবনে যুবায়র (রা.) বলেনঃ হযরত আয়েশা (রা.) পঞ্চাশ হাজার দেরহাম খয়রাত করেন অথচ তাঁর কোর্তায় তালিই থাকত।
হযরত ওমর (রা.) বলতেন : ইলাহী, ধনসম্পদ ও ধনাঢ্যতা আমাদের মধ্যে উত্তম ব্যক্তিকে দান করুন। সম্ভবতঃ সে তা আমাদের অভাবগ্রস্তদেরকে পৌছাবে।
আবদুল আজীজ ইবনে ওমায়র (রহঃ) বলেন : নামায মানুষকে অর্ধেক পথে পৌঁছায়, রোযা বাদশাহের দ্বারে নিয়ে যায় এবং সদকা বাদশাহের সামনে উপস্থিত করে।
ইবনে আবিল জা'দ (রহঃ) বলেন : সদকা মানুষ থেকে সত্তর প্রকার অনিষ্ট দূর করে। প্রকাশ্যে সদকা দেয়ার তুলনায় গোপনে দেয়ায় সত্তর গুণ বেশী সওয়াব। সদকা সত্তর শয়তানের চোয়াল বিদীর্ণ করে।
হযরত ইবনে মসউদ (রা.) বলেন : এক ব্যক্তি সত্তর বছর আল্লাহ তাআলার এবাদত করার পর কোন একটি কবীরা গোনাহ করায় তার এবাদত বাতিল করে দেয়া হল। অতঃপর সে এক মিসকীনের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে এক খন্ড রুটি সদকা করল। ফলে আল্লাহ তার অপরাধ মার্জনা করে সত্তর বছরের এবাদত বহাল করে দিলেন।
লোকমান (আ.) তাঁর পুত্রকে বললেন: তুমি যখন কোন গোনাহ কর, তখন সদকা করবে।
ইয়াহইয়া ইবনে মুআয (রহ.) বলেন : সদকার দানা ব্যতীত কোন দানা দুনিয়ার পাহাড়ের সমান হয়ে যায় বলে আমার জানা নেই। সদকার দানা অবশ্যই এতটুকু হয়ে যায়।
আবদুল আজীজ ইবনে আবী রুয়াদ বলেন : প্রথম যমানায় বলা হত, তিনটি বিষয় জান্নাতের ভান্ডারসমূহের মধ্যে দাখিল- রোগ গোপন করা, সদকা গোপন করা এবং বিপদাপদ গোপন করা।
হযরত ওমর (রা.) বলেন : আমলসমূহ একে অপরের উপর গর্ব করল। সদকা বলল : আমি তোমাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।
আবদুল্লাহ (রহ.) চিনি খয়রাত করতেন এবং বলতেন : আমি দেখলাম, আল্লাহ তাআলা বলেন : “তোমরা প্রিয় বস্তু ব্যয় না করা পর্যন্ত পূর্ণ নেকী পাবে না।” আমি চিনি ভালবাসি, একথা আল্লাহ তাআলা জানেন।
নখয়ী (রহ.) বলেন : আল্লাহর জন্যে যে বস্তু দেব তাতে কোন দোষ থাকা আমার পছন্দনীয় নয়।
ওবায়েদ ইবনে ওমায়ের (রহ.) বলেন : কেয়ামতের দিন মানুষ সকল দিন অপেক্ষা অধিক ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত ও উলঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। অতঃপর যেব্যক্তি দুনিয়াতে আল্লাহর জন্যে ক্ষুধার্তকে আহার দিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে পেট ভরে আহার করাবেন। যেব্যক্তি আল্লাহর জন্যে বস্ত্রহীনকে বস্ত্র পরিধান করিয়ে থাকবে, আল্লাহ তাকে বস্ত্র পরিধান করাবেন।
হযরত হাসান বসরী (রহ.) বলেন : আল্লাহ তাআলা ইচ্ছা করলে তোমাদের সকলকে ধনাঢ্য করে দিতেন- তোমাদের মধ্যে ফকীর থাকত না । কিন্তু তিনি একজনকে অপরজন দ্বারা পরীক্ষা করেছেন।
শা'বী (রহ.) বলেন : ফকীর ধনীর সদকার যতটুকু মুখাপেক্ষী, যদি ধনী তার তুলনায় আপন সদকার সওয়াবের অধিক মুখাপেক্ষী না হয়, তবে তার সদকা অনর্থক। এ সদকা তার মুখে নিক্ষেপ করা হবে।
ইমাম মালেক (রহ.) বলেন : যে পানি সদকা করা হয় এবং মসজিদে পান করানো হয়, তা থেকে ধনী ব্যক্তি পান করলে আমরা দোষ মনে করি না। কেননা, যে পানি সদকা করে, সে পিপাসার্তদের জন্যে সদকা করে। বিশেষভাবে ফকীর-মিসকীনকে সদকা করার নিয়ত তার থাকে না।
কথিত আছে, জনৈক দাস বিক্রেতা এক বাঁদী সঙ্গে নিয়ে হযরত হাসান বসরীর কাছ দিয়ে গমন করলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন : তুমি এই বাঁদী এক দুই দেরহামের বিনিময়ে বিক্রয় করতে সম্মত আছ কি? সে বলল : না। হাসান বসরী (রহ.) বললেন : যাও, আল্লাহ তাআলা তো এক পয়সা ও এক লোকমা সদকা করার বিনিময়ে বেহেশতের হুর দিতে সম্মত আছেন।
সদকা গোপনে গ্রহণ করা—
আধ্যাত্ম পথের পথিকগণ মতভেদ করেছেন, সদকা গোপনে বা প্রকাশ্যে গ্রহণ করার মধ্যে কোন্টি উত্তম। কারও মতে গোপনে গ্রহণ করা উত্তম এবং কেউ বলেন, প্রকাশ্যে গ্রহণ করা ভাল। আমরা প্রথমে উভয় বিষয়ের উপকারিতা ও অপকারিতা বর্ণনা করব, এর পর যা সত্য তার ব্যাখ্যা করব ! প্রকাশ থাকে যে, গোপনে সদকা গ্রহণ করার উপকারিতা পাঁচটি।
(১) গ্রহীতার গোপনীয়তা বজায় থাকে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে ভদ্রতার পর্দা ছিন্ন হয়ে যায়, অভাব প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সওয়াল করার ভীতি দূর হয়ে যায় ।
(২) গোপনে সদকা গ্রহণ করলে মানুষের অন্তর ও মুখ নিরাপদ থাকে। কেননা, প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে মানুষ তার প্রতি হিংসা করে অথবা তার গ্রহণ অপছন্দ করে একথা ভেবে যে, সে ধনী হওয়া সত্ত্বেও সদকা গ্রহণ করেছে অথবা বেশী পরিমাণে গ্রহণ করেছে।
হিংসা ও কুধারণা বড় গোনাহ। মানুষকে এসব গোনাহ থেকে নিরাপদ রাখা উত্তম।
আবু আইউব সুখতিয়ানী (রহ.) বলেন : আমি নতুন বস্ত্র পরিধান করি না এই আশংকায়, কোথাও প্রতিবেশীদের মনে হিংসা সৃষ্টি না হয়ে যায়।
অন্য এক দরবেশ বলেন : আমি আমার ভাইদের খাতিরে অধিকাংশ বস্তুর ব্যবহার বর্জন করি, যাতে তারা একথা না বলে যে, তার কাছে এটা কোত্থেকে এল?
ইবরাহীম তায়মীর গায়ে নতুন জামা দেখে কেউ জিজ্ঞেস করল : এটা আপনি কোথায় পেলেন? তিনি বললেন : আমার ভাই' খায়সামা আমাকে পরিধান করিয়েছে। যদি জানতাম, তার পরিবারের লোকেরা এটা জানে, তবে কখনও কবুল করতাম না।
(৩) গোপনে দান গ্রহণ করলে দাতাকে গোপনে আমল করতে সাহায্য করা হয়। বলাবাহুল্য, দান গোপনে করাই উত্তম। অতএব এ ব্যাপারে গ্রহীতা দাতাকে সাহায্য করলে উত্তম কাজে সাহায্য করা হবে, যা নিঃসন্দেহে ভাল । দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের প্রচেষ্টা ছাড়া গোপনে দান হতে পারে না। ফকীর নিজের অবস্থা প্রকাশ করে দিলে দাতার অবস্থাও প্রকাশ হয়ে পড়বে। এক ব্যক্তি জনৈক আলেমকে প্রকাশ্যে কিছু দান করলে তিনি গ্রহণ করলেন না। অন্য এক ব্যক্তি তাকে গোপনে কিছু দান করলে তিনি গ্রহণ করলেন। অতঃপর এ কারণ জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বললেনঃ দ্বিতীয় ব্যক্তি তার খয়রাতে আদব ও নিয়মের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে- গোপনে দিয়েছে। তাই আমি কবুল করেছি।
এক ব্যক্তি জনৈক দরবেশ সুফীকে জনসমাবেশে কিছু দান করলে দরবেশ তা ফিরিয়ে দিলেন। লোকটি বলল : যে বস্তু আপনাকে আল্লাহ তাআলা দিলেন, তা গ্রহণ করলেন না কেন? দরবেশ বললেন : যে বস্তু একান্তভাবে আল্লাহর ছিল, তাতে অপরকে শরীক করে নিয়েছ। কেবল আল্লাহর দেখা তুমি যথেষ্ট মনে করনি। কাজেই তোমার শেরক আমি তোমার কাছেই ফিরিয়ে দিলাম।
জনৈক সাধক এক বস্তু গোপনে কবুল করে নিলেন, যা তিনি প্রকাশ্যে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। দাতা এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন : প্রকাশ্যে দেয়ার কারণে তুমি আল্লাহর নাফরমানী করেছিলে। তাই আমি তোমাকে সাহায্য করিনি। এখন গোপনে দেয়ার কারণে তুমি আল্লাহর আনুগত্য করেছ। তাই আনুগত্যের কাজে আমি তোমাকে সাহায্য করেছি।
সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন : যদি আমি জানতাম, কোন ব্যক্তি দান করে তার আলোচনা করবে না এবং অন্যের কাছে বলবে না, তবে আমি তার দান গ্রহণ করতাম।
(৪) গোপনে গ্রহণ করলে গ্রহীতা অপমান ও লাঞ্ছনা থেকে বেঁচে থাকে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে লাঞ্ছনা হয়। নিজেকে লাঞ্ছিত করা ঈমানদার ব্যক্তির জন্যে শোভন নয়। কোন আলেমকে গোপনে কেউ কিছু দিলে তিনি তা গ্রহণ করতেন এবং প্রকাশ্যে দিলে গ্রহণ করতেন না। তিনি বলতেন : প্রকাশ্যে নেয়ার মধ্যে এলেমের লাঞ্ছনা এবং আলেমগণের বেইযযতী হয়। তাই আমি দুনিয়ার ধন-সম্পদকে উঁচু করে বিনিময়ে এলেম ও আলেমগণকে নীচু করি না।
(৫) গোপনে গ্রহণ করলে শরীকানার সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা যায় । কারণ, রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : “যেব্যক্তির কাছে কোন উপঢৌকন আসে, তার কাছে যত লোক থাকে, তারা সকলেই উপঢৌকনে শরীক থাকে। স্বর্ণ-রৌপ্য হলেও তা উপঢৌকন। কেননা, রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : মানুষের দেয়া উত্তম উপঢৌকন হচ্ছে রূপা অথবা খাদ্য, যা খাওয়ানো হয়। এতে রূপাকেও উপঢৌকন বলা হয়েছে। এ থেকে জানা গেল, জনসমাবেশে সকলের সম্মতি ছাড়া বিশেষ কোন ব্যক্তিকে কিছু দেয়া মাকরূহ। সকলের সম্মতি সন্দিগ্ধ বিধায় একান্তে দিলে এই সন্দেহ থেকে মুক্ত থাকা যায় ।
সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা—
এখন সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা এবং অন্যের কাছে তার আলোচনা করার মধ্যে যেসকল উপকারিতা রয়েছে, সেগুলো বর্ণিত হচ্ছে। এতে চারটি উপকারিতা আছে।
(১) সদকা প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে আন্তরিকতা ও সততা প্রকাশ পায়, নিজের অবস্থা সম্পর্কে অপরকে ধোঁকা দেয়া হয় না এবং রিয়া থেকে মুক্ত থাকা যায়। কারণ, এতে বাস্তব অবস্থাই প্রকাশ পায়।
এরূপ হয় না যে, বাস্তব অবস্থা অন্যরূপ এবং লোক দেখানোর উদ্দেশ তা প্রকাশ করা হয় না।
(২) প্রকাশ্যে গ্রহণ করলে জাঁকজমকপ্রীতি দূর হয়ে যায়, দাসত্ব ও দীনতা প্রকাশ পায়, অহংকার ও অভাবমুক্ততার দাবী থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায় এবং মানুষের দৃষ্টিতে হেয় হওয়া যায়। এ কারণেই জনৈক সাধক তাঁর শিষ্যকে বলেন : সদকা সর্বাবস্থায় প্রকাশ্যে নেবে। এরূপ করলে তোমার ব্যাপারে মানুষ দু'দলে বিভক্ত হয়ে যাবে।
এক দল হবে, যাদের মনে তোমার কোন মর্যাদা থাকবে না । এট তো অভীষ্ট লক্ষ্যই। কেননা, এটা তোমার ধর্মের নিরাপত্তার জন্য অধিক উপকারী ।
আরেক দল হবে, যাদের মনে তোমার প্রতি সহানুভূতি বেশী হবে। কারণ, তুমি আপন অবস্থা ঠিক ঠিক প্রকাশ করে দিয়েছ। এটা তোমার ভাইয়ের কাম্য। কারণ, তার উদ্দেশ্য বেশী বেশী সওয়াব পাওয়া। সে যখন তোমাকে মহব্বত বেশী করবে তখন সে সওয়াবও অবশ্যই পাবে। এ সওয়াব তুমিও পাবে। কেননা, তার সওয়াব বেশী হওয়ার কারণ তুমিই।
(৩) প্রকাশ্যে সদকা গ্রহণ করলে তওহীদকে শেরক থেকে বাঁচানো যায়। কেননা, সাধকের দৃষ্টি মহান আল্লাহ ব্যতীত অন্য দিকে নিবদ্ধ হয় না। গোপনও প্রকাশ্য তার জন্যে সমান। এ অবস্থার পরিবর্তন তওহীদে শেরকের নামান্তর । জনৈক বুযুর্গ বলেন : যেব্যক্তি গোপনে গ্রহণ এবং প্রকাশ্যে প্রত্যাখ্যান করত, আমরা তার দোয়ার কোনই মূল্য দিতাম না । উপস্থিত অথবা অনুপস্থিত মানুষের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করা হালের ক্ষতি বৈ নয়। দৃষ্টি সর্বদা এক আল্লাহর দিকে নিবিষ্ট থাকা উচিত।
কথিত আছে, জনৈক বুযুর্গ তাঁর মুরীদগণের মধ্যে একজনের প্রতি অধিক আকৃষ্ট ছিলেন। এটা অন্য মুরীদদের কাছে দুঃসহ মনে হলে বুযুর্গ ব্যক্তি তাদের কাছে সেই মুরীদের শেষ্ঠত্ব প্রকাশ করতে চাইলেন। সেমতে প্রত্যেক মুরীদকে একটি করে মুরগী দিয়ে তিনি বললেন : প্রত্যেকেই আপন আপন মুরগী এমন জায়গা থেকে জবাই করে আনবে, যেখানে অন্য কেউ না দেখে। সকল মুরীদ গিয়ে আপন আপন মুরগী জবাই করে আনল । কিন্তু সেই মুরীদ জীবিত মুরগী নিয়ে এল । বুযুর্গ তাকে কারণ জিজ্ঞেস করলে সে বলল : আমি এমন কোন জায়গা খুঁজে পেলাম না, যেখানে কেউ দেখে না। কেননা, আল্লাহ্ তাআলা সর্বত্রই দেখেন। বুযুর্গ ব্যক্তি মুরীদগণকে বললেন : এ কারণেই আমি তার প্রতি অধিক আকৃষ্ট । সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুর প্রতি ধ্যান দেয় না ।
(৪) প্রকাশ্যে সদকা গ্রহণ করলে শোকরের সুন্নত আদায় হয়। আল্লাহ্ তাআলা বলেন,-“তুমি তোমার পালনকর্তার নেয়ামত বর্ণনা কর। নেয়ামত গোপন করা অকৃতজ্ঞতার শামিল । যারা আল্লাহর নেয়ামত গোপন করে, আল্লাহ তাদের নিন্দা করেন এবং কৃপণ আখ্যা দেন।
বলা হয়েছে : “যারা কৃপণতা করে, মানুষকে কৃপণতা করতে আদেশ করে এবং আল্লাহ প্রদত্ত অনুগ্রহ গোপন করে।
রসূলে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : আল্লাহ তাআলা যখন কোন বান্দাকে নেয়ামত দেন, তখন বান্দাকে সেই নেয়ামতের উপযোগী দেখাও পছন্দ করেন। এক ব্যক্তি জনৈক সাধককে গোপনে কিছু দিলে সাধক আপন হাত উঁচু করে বললেন : এটা দুনিয়ার বস্তু। এটা প্রকাশ্যে দেয়া উত্তম। আখেরাতের কাজ গোপন করা উত্তম। এ কারণেই জনৈক বুযুর্গ বলেন : তোমাকে জনসমাবেশে কিছু দেয়া হলে তুমি তা গ্রহণ কর। এর পর একান্তে তা ফেরত দিয়ে দাও। সদকার ক্ষেত্রে শোকরের প্রতি উৎসাহ বর্ণিত আছে। রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেনঃ
যে মানুষের শোকর করে না, সে আল্লাহরও শোকর করে না। শোকর প্রতিদানের স্থলবর্তী হয়ে থাকে। রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন : কেউ তোমার প্রতি অনুগ্রহ করলে তুমি তার প্রতিদান দাও। প্রতিদান সম্ভব না হলে উত্তমরূপে তার প্রশংসা কর এবং সেই পর্যন্ত দোয়া কর, যে পর্যন্ত প্রতিদান হয়ে গেছে বলে তোমার বিশ্বাস না জন্মে। মুহাজিরগণ মদীনায় রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম)-কে শোকর সম্পর্কে প্রশ্ন করলেন ঃ ইয়া রসূলাল্লাহ্, আমরা আনসারদের চেয়ে উত্তম লোক দেখিনি। আমরা তাঁদের কাছে এলে তাঁরা আপন বিষয়-সম্পত্তি আমাদের মধ্যে বন্টন করে দিয়েছেন। আমাদের আশংকা হচ্ছে, সব সওয়াব তাঁরাই নিয়ে যাবেন । রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: না, তা নয়। তোমরা যে তাঁদের শোকর করেছ এবং প্রশংসা করেছ, এতে প্রতিদান হয়ে গেছে।
সদকা গোপন ও প্রকাশ্যে গ্রহন করার মতভেদের কারণ—
এসব উপকারিতা জানার পর এখন জানা দরকার, এ সম্পর্কে বর্ণিত মতভেদ মূল বিষয়বস্তুর মধ্যে নয়; বরং এটা হাল তথা অবস্থার মতভেদ।
এ ক্ষেত্রে সত্য এই যে, গোপনে গ্রহণ করা সর্বাবস্থায় উত্তম অথবা প্রকাশ্যে গ্রহণ করা ভাল, একথা নিশ্চিতরূপে বলা যায় না। বরং এটা নিয়তের বিভিন্নতার কারণে বিভিন্ন হয়ে থাকে। হাল ও ব্যক্তির পার্থক্যের কারণে নিয়ত আলাদা আলাদা হয়ে যায়। এমতাবস্থায় এখলাসবিশিষ্ট ব্যক্তির উচিত নিজের দেখাশুনা করা এবং বিভ্রান্তিতে না পড়া। এ ব্যাপারে মনের প্রতারণা ও শয়তানের ধোঁকা থেকে বেঁচে থাকতে হবে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করার তুলনায় গোপনে গ্রহণ করার কারণসমূহের মধ্যে ধোঁকা প্রতারণা বেশী রয়েছে- যদিও উভয়ের মধ্যেই প্রতারণা আছে। গোপনে গ্রহণ করার মধ্যে প্রতারণার কারণ, মন গোপনে গ্রহণ করার প্রতি আগ্রহী থাকে। কারণ, এতে জাঁকজমক ও মর্যাদা বহাল থাকে। মানুষের দৃষ্টিতে সম্মান ঠিক থাকে। কেউ মিসকীনকে ঘৃণার দৃষ্টিতে এবং দাতাকে তার প্রতি অনুগ্রহকারী ও নেয়ামতদানকারীরূপে দেখে না। এই রোগ মনের মধ্যে গোপন থাকে এবং শয়তান এর মাধ্যমে উপকারিতা প্রকাশ করে। এমনকি, পূর্ববর্ণিত পাঁচটি উপকারিতাকেই গোপনে গ্রহণ করার কারণরূপে উল্লেখ করে। প্রকাশ্যে গ্রহণ করার প্রতিও মন আগ্রহী থাকে। কারণ, এতে দাতার মন প্রফুল্ল হয় এবং সে দানে উৎসাহিত হয়। এখানে শয়তান বলে, শোকর আদায় করা সুন্নত এবং গোপন রাখা রিয়া। এমনকি, শয়তান পূর্বোল্লিখিত চারটি উপকারিতাকেও প্রমাণস্বরূপ পেশ করে, যাতে প্রকাশ্যে গ্রহণ করতে উদ্বুদ্ধ করা যায়।
অতএব ফয়সালা এই যে, দাতাকে দেখতে হবে। যদি সে শোকর ও প্রকাশ্যে দেয়া পছন্দ করে, তবে তার দান গোপন রাখবে এবং শোকর করবে না। কেননা, শোকর তলব করা একটি জুলুম। এই জুলুমের কাজে তাকে সাহায্য না করা চাই। পক্ষান্তরে যদি দাতা শোকর পছন্দ না করে, তবে গ্রহীতা তার শোকর করবে এবং দান প্রকাশ করবে। এ কারণেই রসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর সামনে লোকেরা এক ব্যক্তির প্রশংসা করলে তিনি বললেন: তোমরা তাকে মেরে ফেলেছ। সে শুনলে কল্যাণ প্রাপ্ত হবে না। অথচ রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মানুষের প্রশংসা তাদের উপস্থিতিতে করতেন। কারণ, তিনি তাদের ব্যাপারে আস্থাশীল ছিলেন, এ প্রশংসা তাদের জন্যে ক্ষতিকর হবে না। বরং তাদের সৎ কাজের প্রতি উৎসাহ আরও বৃদ্ধি করবে। উদাহরণতঃ তিনি এক ব্যক্তিকে বললেন : সে গেঁয়ো লোকদের সর্দার। অন্য এক ব্যক্তি সম্পর্কে বললেন : তোমাদের কাছে কোন সম্প্রদায়ের সর্দার আগমন করলে তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন কর। এক ব্যক্তির কথাবার্তা রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর খুব ভাল লাগলে তিনি বললেন : “নিঃসন্দেহে কিছু বর্ণনা জাদু হয়ে থাকে।”
তিনি আরও বলেন : “মুমিনের প্রশংসা করা হলে তার অন্তরে ঈমান বৃদ্ধি পায়।”
সুফিয়ান সওরী (রহ.) বলেন : যেব্যক্তি নিজেকে সম্যক চেনে, মানুষের প্রশংসা তার জন্যে ক্ষতিকর হয় না।
সারকথা, জনসমাবেশে গ্রহণ করা এবং একান্তে না করা উত্তম ও নিরাপদ পন্থা। হাঁ, যদি মারেফত কামেল হয় এবং প্রকাশ্যে গ্রহণ ও গোপনে গ্রহণ উভয়টি সমান হয়ে যায়, তবে গোপনে গ্রহণ করার মধ্যেও দোষ নেই । কিন্তু এরূপ ব্যক্তি অত্যন্ত বিরল। আলোচনায় আছে— বাস্তবে পাওয়া ভার। আল্লাহ আমাদেরকে সাহায্য করুন এবং তওফীক দান করুন।
সদকা গ্রহণ করা উত্তম না যাকাত—
ইবরাহীম খাওয়াস, জুনায়দ বাগদাদী প্রমুখ বুযুর্গের অভিমত হচ্ছে, যাকাতের তুলনায় সদকার অর্থ গ্রহণ করা উত্তম। কেননা, যাকাতের অর্থ গ্রহণ করলে মিসকীনদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়। এছাড়া যাকাতের হকদার হওয়ার জন্যে যেসকল বিশেষণ ও শর্ত উল্লিখিত আছে, সেগুলো নিজের মধ্যে থাকে না। সদকার মধ্যে এ ব্যাপারে অবকাশ বেশী । কেউ কেউ বলেন : যাকাত গ্রহণ করা উচিত- সদকা নয়। কেননা, যাকাত গ্রহণ করলে মানুষকে ফরয আদায়ে সাহায্য করা হয়। সকল মিসকীন যাকাত নেয়া ত্যাগ করলে সকল মানুষ গোনাগার হবে। এছাড়া যাকাত কারও অনুগ্রহ নয়। এটা মালদারের যিম্মায় আল্লাহর ওয়াজেব হক। এর মাধ্যমে অভাবী বান্দাদের রুজি অর্জিত হয়। আরও কারণ, যাকাত অভাবের কারণে গ্রহণ করা হয়। অভাব প্রত্যেক ব্যক্তির নিশ্চিতরূপে জানা থাকে। কিন্তু সদকা গ্রহণ করা দ্বীনদারীর কারণে হয়। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দাতা তাকেই সদকা দেয়, যার দ্বীনদারী সম্পর্কে তার বিশ্বাস থাকে ।
এক্ষেত্রে সত্য হচ্ছে, এ বিষয়টি প্রত্যেক ব্যক্তির অবস্থা অনুযায়ী বিভিন্ন রূপ হয়। যে ধরনের অবস্থা প্রবল এবং যেরূপ নিয়ত হয়, সেই ধরনের বিধান হয়ে থাকে। সুতরাং যদি কোন ব্যক্তি সন্দেহ করে, তার মধ্যে যাকাতের হকদার হওয়ার শর্ত আছে কিনা, তবে তার যাকাত গ্রহণ না করা উচিত । আর যদি নিজেকে হকদার বলে নিশ্চিতরূপে জানে, তবে যাকাত গ্রহণ করতে পারে। উদাহরণতঃ এক ব্যক্তির যিম্মায় ঋণ আছে, যা সে উত্তম পথে ব্যয় করেছে। এখন ঋণ শোধ করার কোন উপায় নেই। এরূপ ব্যক্তি নিশ্চিতরূপেই যাকাতের হকদার। তাকে সদকা ও যাকাতের মধ্যে এখতিয়ার দেয়া হলে সে চিন্তা করবে- যদি আমি এই সদকা গ্রহণ না করি, তবে মালিক সদকা করবে না। এমতাবস্থায় সে সদকাই গ্রহণ করবে। আর যদি যাকাত নিলে মিসকীনদের কোন অসুবিধা না হয়, তবে সদকা ও যাকাত প্রত্যেকটি গ্রহণ করবে। এতদসত্ত্বেও নফসকে হেয় করার ব্যাপারে যাকাত গ্রহণের প্রভাব সম্ভবতঃ অনেক বেশী ।
_______
No comments:
Post a Comment