ইসলাম-কে জানতে চেষ্টা করুন। Try to know about Islam
ব্যাথা উপশম হবার জন্য দোয়া
এক বাদশা এক যাদুকর ও এক দরবেশের কাহীনি
একদা রসূলুল্লাহ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, তোমাদের পূর্ববর্তী যামানায় এক বাদশাহ ছিল। তার ছিল এক যাদুকর। বার্ধক্যে পৌছে সে বাদশাহকে বলল, আমি তো বৃদ্ধ হয়ে পড়েছি, সুতরাং একজন যুবককে আপনি আমার কাছে প্রেরণ করুন, যাকে আমি যাদুবিদ্যা শিক্ষা দিব।
অতঃপর যাদুবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার জন্য বাদশাহ তার কাছে এক যুবককে প্রেরণ করল। বালকের যাত্রা পথে ছিল এক ধর্মযাজক। যুবক তার কাছে বসল এবং তার কথা শুনল। তার কথা যুবকের পছন্দ হলো। তারপর যুবক যাদুকরের কাছে যাত্রাকালে সর্বদাই ধর্মযাজকের কাছে যেত এবং তার নিকট বসত।
তারপর সে যখন যাদুকরের কাছে যেত তখন সে তাকে মারধর করত। ফলে যাদুকরের ব্যাপারে সে ধর্মযাজকের কাছে অভিযোগ করল। তখন ধর্মযাজক বলল, তোমার যদি যাদুকরের ব্যাপারে ভয় হয় তবে বলবে, আমার পরিবারের লোকেরা আমাকে আসতে দেয়নি। আর যদি তুমি তোমার গৃহকর্তার ব্যাপারে আশঙ্কাবোধ করে তবে বলবে, যাদুকর আমাকে বিলম্বে ছুটি দিয়েছে।
এমনিভাবে চলতে থাকাবস্থায় একদিন হঠাৎ সে একটি ভয়ানক হিংস্র প্রাণীর সম্মুখীন হলো, যা লোকেদের পথ আটকিয়ে রেখেছিল। এ অবস্থা দেখে সে বলল, আজই জানতে পারব, যাদুকর উত্তম না ধর্মযাজক উত্তম।
অতঃপর একটি পাথর হাতে নিয়ে সে বলল, হে আল্লাহ! যদি যাদুকরের চাইতে ধর্মযাজক আপনার কাছে পছন্দনীয় হয়, তবে এ পাথরাঘাতে এ হিংস্র প্রাণীটি নিঃশেষ করে দিন, যেন লোকজন চলাচল করতে পারে।
অতঃপর সে সেটার প্রতি পাথর ছুড়ে দিল এবং সেটাকে মেরে ফেলল। ফলে লোকজন আবার যাতায়াত শুরু করল। এরপর সে ধর্মযাজকের কাছে এসে তাকে সম্পূর্ণ ঘটনা বলল।
ধর্মযাজক বলল, বৎস! আজ তুমি আমার থেকেও শ্রেষ্ঠ। তোমার মর্যাদা এ পর্যন্ত পৌছেছে যা আমি দেখতে পাচ্ছি। তবে শীঘ্রই তুমি পরীক্ষার সম্মুখীন হবে। যদি পরীক্ষার মুখোমুখি হও তবে আমার কথা গোপন রাখবে।
এদিকে যুবক আল্লাহর হুকুমে জন্মান্ধ ও কুষ্ঠরোগীকে আরোগ্য দান করতে লাগল এবং লোকেদের সমুদয় রোগ-ব্যাধির নিরাময় করতে লাগল।
বাদশাহর পরিষদবর্গের এক লোক অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তার সংবাদ সে শুনতে পেয়ে বহু হাদিয়া ও উপটৌকন নিয়ে তার নিকট আসলো এবং তাকে বলল, তুমি যদি আমাকে আরোগ্য দান করতে পার তবে এসব মাল আমি তোমাকে দিয়ে দিব। এ কথা শুনে যুবক বলল, আমি তো কাউকে আরোগ্য দান করতে পারি না। আরোগ্য তো দেন আল্লাহ তা’আলা। তুমি যদি আল্লাহর উপর ঈমান আনো তবে আমি আল্লাহর কাছে দুআ করব, আল্লাহ তোমাকে আরোগ্য দান করবেন। তারপর সে আল্লাহর উপর ঈমান আনলো। আল্লাহ তা’আলা তাকে রোগ মুক্ত করে দিলেন।
এরপর সে বাদশাহর কাছে এসে অন্যান্য দিনের ন্যায় এবারও বসল। বাদশাহ তাকে প্রশ্ন করল, কে তোমার দৃষ্টি শক্তি ফিরিয়ে দিয়েছে?
সে বলল, আমার পালনকর্তা। এ কথা শুনে বাদশাহ তাকে আবার প্রশ্ন করল, আমি ছাড়া তোমার অন্য কোন পালনকর্তাও আছে কি?
সে বলল, আমার ও আপনার সকলের প্রতিপালকই মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন।
অতঃপর বাদশাহ্ তাকে পাকড়াও করে অবিরতভাবে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ঐ বালকের অনুসন্ধান দিল, অতঃপর বালককে নিয়ে আসা হলো।
বাদশাহ তাকে বলল, হে প্রিয় বৎস! তোমার যাদু এ পর্যায়ে পৌছে গেছে যে, তুমি অন্ধ ও কুষ্ঠ রোগীকেও নিরাময় করতে পার।
বালক বলল, আমি কাউকে নিরাময় করতে পারি না। নিরাময় করেন আল্লাহ। ফলে বাদশাহ তাকে শাস্তি দিতে লাগল, অবশেষে সে ধর্মযাজকের (দরবেশের) কথা বলে দিল।
এরপর ধর্মযাজককে ধরে আনা হলো এবং তাকে বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সে অস্বীকার করল, ফলে তার মাথার তালুতে করাত রেখে সেটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলা হলো। এতে তার মাথাও দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেল।
অবশেষে ঐ যুবকটিকে আনা হলো এবং তাকেও বলা হলো তুমি তোমার দীন থেকে ফিরে এসো। সেও অস্বীকার করল।
অতঃপর বাদশাহ তাকে তার কিছু সহচরের হাতে তাকে অর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে অমুক পাহাড়ে নিয়ে যাও এবং তাকে সহ পাহাড়ে আরোহণ করো। পর্বত শৃঙ্গে পৌছার পর সে যদি তার ধর্ম থেকে ফিরে আসে তবে ভাল। নতুবা তাকে সেখান থেকে ছুড়ে মারবে।
তারপর তারা তাকে নিয়ে গেল এবং তাকে সহ পর্বতে আরোহণ করল। তখন সে দুআ করে বলল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করুন। তৎক্ষণাৎ তাদেরকে সহ পাহাড় কেঁপে উঠল। ফলে তারা পাহাড় হতে গড়িয়ে পড়ল। আর সে হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো।
এ দেখে বাদশাহ্ তাকে প্রশ্ন করল, তোমার সাথীরা কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের চক্রান্ত হতে সংরক্ষণ করেছেন।
আবারো বাদশাহ্ তাকে তার কতিপয় সহচরের হাতে সমর্পণ করে বলল, তোমরা তাকে নিয়ে নাও এবং নৌকায় উঠিয়ে তাকে মাঝ সমুদ্রে নিয়ে যাও। অতঃপর সে যদি তার দীন (ধর্ম) হতে ফিরে আসে তবে ভাল, নতুবা তোমরা তাকে সমুদ্রে ফেলে দাও।
তারা তাকে সমুদ্রে নিয়ে গেল। এবারও সে দু’আ করে বলল, হে আল্লাহ! আপনার যেভাবে ইচ্ছা আপনি আমাকে তাদের চক্রান্ত থেকে রক্ষা করুন।
তৎক্ষণাৎ নৌকাটি তাদেরসহ উল্টে গেল। ফলে তারা সকলেই পানিতে ডুবে গেল। আর যুবক হেঁটে হেঁটে বাদশাহর কাছে চলে এলো। এ দেখে বাদশাহ্ তাকে আবার প্রশ্ন করল, তোমার সঙ্গীগণ কোথায়? সে বলল, আল্লাহ আমাকে তাদের ষড়যন্ত্র হতে রক্ষা করেছেন।
অতঃপর সে বাদশাহকে বলল, তুমি আমাকে হত্যা করতে পারবে না যে পর্যন্ত না তুমি আমার নির্দেশিত পদ্ধতি অবলম্বন করবে। বাদশাহ বলল, সে আবার কি? যুবক বলল, একটি ময়দানে তুমি লোকেদেরকে জমায়েত করে।
অতঃপর একটি কাঠের শুলীতে আমাকে উঠিয়ে আমার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রাখে। এরপর بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ" " "বালকের প্রভুর নামে" বলে আমার দিকে তীর নিক্ষেপ কর। এ যদি কর তবে তুমি আমাকে মেরে ফেলতে পারবে।
তার কথা অনুসারে বাদশাহ লোকেদেরকে এক মাঠে জমায়েত করল এবং তাকে একটি কাষ্ঠের শূলীতে চড়ালো। অতঃপর তার তীরদানী হতে একটি তীর নিয়ে সেটাকে ধনুকের মাঝে রেখে بِاسْمِ اللَّهِ رَبِّ الْغُلاَمِ" " (বালকের প্রভুর নামে) বলে তার দিকে তা নিক্ষেপ করল।
তীর তার কানের নিম্নাংশে গিয়ে বিধল। অতঃপর সে তীরবিদ্ধ স্থানে নিজের হাত রাখল এবং সাথে সাথে প্রাণত্যাগ করল। এ দৃশ্য দেখে রাজ্যের লোকজন বলে উঠল,
(آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ آمَنَّا بِرَبِّ الْغُلاَمِ)
আমরা এ যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান আনলাম।
এ সংবাদ বাদশাহকে জানানো হলো এবং তাকে বলা হলো, লক্ষ্য করেছেন কি? আপনি যে পরিস্থিতি হতে আশঙ্কা করছিলেন, আল্লাহর শপথ! সে আশঙ্কাজনক পরিস্থিতিই আপনার মাথার উপর চেপে বসেছে। সকল মানুষই যুবকের পালনকর্তার উপর ঈমান এনেছে। এ দেখে বাদশাহ সকল রাস্তার মাথায় গর্ত খননের নির্দেশ দিল। গর্ত খনন করা হলো এবং ওগুলোতে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করা হলো।
অতঃপর বাদশাহ আদেশ করল যে, যে লোক তার ধর্মমত বর্জন না করবে তাকে ওগুলোতে নিপতিত করবে। কিংবা সে বলল, তাকে বলবে, যেন সে অগ্নিতে প্রবেশ করে। লোকেরা তাই করল। পরিশেষে এক মহিলা একটি শিশু নিয়ে অগ্নিগহ্বরে পতিত হবার ব্যাপারে ইতস্তত করছিল। এ দেখে দুধের শিশু তাকে (মাকে) বলল, ওহে আম্মাজান! সবর করুন, আপনি তো সত্য দীনের (ধর্মের) উপর প্রতিষ্ঠিত আছেন।
(সহীহ্ মুসলিম- ইসলামিক ফাউন্ডেশন ৭২৩৯, ইসলামিক সেন্টার ৭২৯৩)
#ইসলাম_ই_মুক্তির_দিশা
দাজ্জালের এক চোখ কানা
তওবা (২৭) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
তেসরা রবিউস সানী, শুক্রবার। অদ্যকার মজলিসে তওবা সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল। হযরত শায়খ এরশাদ করিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আন্তরিকভাবে তওবা করিয়া মুখে উচ্চারণ করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তওবা কার্যকর হয় না এবং তওবার আসল উদ্দেশ্যও সাধিত হয় না। নিজের খেয়াল-খুশীমত পাপ করিয়া পরে যদি তওবা করা হয়, তবে সেই তওবাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নহে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন- (يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا) "হে মোমেনগণ! আল্লাহর নিকট তওবা নসুহ কর"।
অর্থাৎ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নিকট তওবা কর। যে পাপ হইতে তওবা করা হইতেছে তাহা যেন পুনরায় করা না হয়। এইভাবে তওবা করিলে আল্লাহ মেহেরবান হইয়া হয়ত তোমার তওবা কবুল করিতে পারেন।
আল্লাহ ও বান্দার মধ্যস্থিত অন্তরায় পাপ এবং অপবিত্রতা। অন্তরঙ্গতার সাথে কৃত পাপ হইতে তওবা করার পর মানুষ যখন আর সেই পাপ না করে তখন এই অন্তরায় দূর হইয়া যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ বিপদমুক্ত হয়। পৃথিবীর প্রতি আসক্তি এবং পাপ- ইহাই অন্তরকে অপবিত্র করিয়া রাখে। তাই অন্তরকে যাবতীয় কামনা-বাসনা ও লোলুপতা হইতে দূরে রাখ, মোশাহাদা মোকাশাফার দ্বার তোমার জন্য উন্মুক্ত হইয়া যাইবে।
অন্তরের তওবার পর মুখের তওবার স্তর। অর্থাৎ খারাপ ও অশ্লীল কথাবার্তা বলা হইতে তওবা করিয়া মুখকে সংযত রাখাই মুখের তওবা। এই জন্য প্রথমে দুই রাকআত নফল নামায আদায় করত কেবলামুখী অবস্থায় কাকুতি-মিনতি করিয়া আল্লাহর নিকট বলিবে, হে পরওয়ারদেগারে আলম! খারাপ কথা বলা হইতে এবং যে কথায় আপনি অসন্তুষ্ট হোন এমন কিছু বলা হইতে আমাকে, আমার জিহ্বাকে সংযত রাখুন। পরনিন্দা হইতেও আমাকে বিরত রাখুন।
প্রতুষে নিদ্রা হইতে উঠার পর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুখকে অনুরোধ করিয়া বলে, ওহে মুখ! তুমি যদি সংযত থাক তবে আমরা ধ্বংস হইব না। আল্লাহ তা'আলা জিহ্বাকে সৃষ্টি করিয়া এরশাদ করিলেন, ওহে জিহ্বা ! আমার স্মরণ, আমার যিকর-আযকার করার জন্যই আমি তোমাকে মানুষের একটি শ্রেষ্ঠ অঙ্গ হিসাবে সৃষ্টি করিয়াছি। আমার কালাম ব্যতীত যেন অন্য কোন কিছু তোমা দ্বারা উচ্চারিত না হয়। তুমি আমার আদেশের অন্যথা করিলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ্যই বিপদাপন্ন হইবে। তাই তোমাদের কর্তব্য তোমাদের জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকর এবং পবিত্র কালাম তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকে।
অতঃপর পীর ও মুরশিদ মানুষের রিযিক বা জীবিকা সম্বন্ধে এরশাদ করিলেন, আল্লাহ তাআলা যাহার ভাগ্যে যেই জীবিকা নির্ধারণ করিয়া রাখিয়াছেন সে তাহা অবশ্যই পাইবে। আর যাহা কাহারও ভাগ্যে রাখেন নাই সে যত চেষ্টাই করুক না কেন কিছুই পাইবে না। সুতরাং যাহার অন্তকরণ জীবিকা অর্জনে লিপ্ত না হইয়া এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে, সে-ই শরীয়ত ও তরীকতের পথের যথার্থ পথিক। সুতরাং তুমি একান্তভাবে দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখ- অনুসন্ধান ব্যতীতই তুমি তোমার ভাগ্যের নির্ধারিত বস্তু পাইবে। তুমি নিজেকে তোমার একচ্ছত্র মালিকের সন্ধানে রাখ, তাহা হইলেই তোমার ভাগ্যে যাহা কিছু আছে তাহা তোমাকে সন্ধান করিয়া ফিরিবে। কোন মুসলমান যখন দুনিয়ার সন্ধানে লিপ্ত হইয়া পড়ে তখন দুনিয়া তাহার নিকট হইতে দূরে সরিয়া যায়। আর যে মালিকের সন্ধানে নিয়োজিত থাকিয়া দুনিয়ার প্রতি উদাসীন থাকে, তখন দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় কিছু স্বেচ্ছায় তাহার নিকটে আসিয়া ধরা দেয়। অথচ সে দুনিয়াকে পূতি দুর্গন্ধময় লাশ মনে করিয়া তাহা হইতে সরিয়া থাকে। ওহে দরবেশগণ! আল্লাহর প্রতি ভরসাকারীগণ জীবিকা বা অন্যান্য কোন কিছুর সম্বন্ধে মোটেই চিন্তিত নহেন। কারণ, তাঁহারা বিশ্বাস করেন, ভাগ্যে লিখিত বস্তু অবশ্যই আল্লাহ দান করিবেন। তবে আর চিন্তা-ভাবনা কেন?
সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাক এবং একাগ্রতার সাথে তাঁহার এবাদত-বন্দেগী কর। তারপর দেখ আল্লাহ তোমাদের জন্য কত নেয়ামত পাঠাইয়া দেন।
ওহে বন্ধুগণ ! শত চেষ্টা করিলেও নির্ধারিত ভাগ্যের কোন প্রকার রদবদল হইবে না। কোন কোন অজ্ঞ লোকের ধারণা, নিজস্ব এলাকা ছাড়িয়া অন্য কোথাও গেলে আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হইবে, অধিক ধন-সম্পদের মালিক হইব। এমন ধারণা করা কবীরা গোনাহের মধ্যে পরিগণিত। যাহারা এমন কথা বলে তাহারা আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী। কারণ, তুমি যেখানেই যাইবে সেখানেই আল্লাহ আছেন এবং তিনিই তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা।
একবার এক ব্যক্তি ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্য নিজের শহর ছাড়িয়া অন্য শহরে যাওয়ার মনস্থ করিল। শহর পরিত্যাগ করার পূর্বে সেই শহরের একজন বুযুর্গের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে গেল। বুযুর্গ জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন যাইবে? সে বলিল, হযরত বড় অভাব-অনটনে পড়িয়া গিয়াছি। সেখানে গিয়া দেখি ভাগ্যের পরিবর্তন হয় কিনা? বুযুর্গ বলিলেন, ভাল কথা। তুমি যখন সেখানে পৌঁছিবে তখন তথাকার খোদাকে আমার সালাম দিও। বুযুর্গের কথা শুনিয়া সে তো হতভম্ব। জিজ্ঞাসা করিল, হযরত। সেই শহরে আবার অন্য খোদা কোথা হইতে আসিবে? বুযুর্গ বলিলেন, নাদান! যখন এতটাই বুঝিতে পারিতেছ যে, ঐ শহর এই শহর এবং সারা বিশ্বের খোদা একই জন এবং এখানে বা সেখানে তুমি তাহাই অর্জন করিতে পারিবে যাহা তোমার ভাগ্যে লিখিত রহিয়াছে, তবে কেন এত চিন্তা। যাও, একাগ্রতার সাথে আল্লাহর কাজে লাগিয়া থাক এবং দেখ তিনি তোমার জন্য কি ব্যবস্থা করেন।
অতঃপর তিনি হাত চুম্বন করা সম্বন্ধে বলিলেন, একে অন্যের হাত চুম্বন করা হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁহার পূর্ববর্তী নবীদের সুন্নত। যেব্যক্তি আন্তরিক ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে কোন বুযুর্গ ও পীরের হাত চুম্বন করে, আল্লাহ তাহার যাবতীয় পাপ ক্ষমা করিয়া দেন, যেন সেব্যক্তি আজই মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ট হইল। তাই ইহকাল পরকালের মঙ্গলার্থই শায়খ ও বুযুর্গদের হাতে চুম্বন করা উচিত।
হযরত দাউদ (আঃ) যখন দরবারে বসিয়া বিচার করিতেন তখন বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের কোন বুযুর্গ সেখানে উপস্থিত হইলে তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া বুযুর্গের সাথে মোসাফাহা করিতেন এবং তাঁহার হাত চুম্বন করত আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া বলিতেন, হে মাবুদ ! এই বুযুর্গের হাত চুম্বনের বরকতে তুমি আমার ইহকাল পরকাল মঙ্গলময় কর।
হযরত ইউসুফ (আঃ) হারাইয়া যাওয়ার পর পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) রাজপথে দাঁড়াইয়া প্রত্যেক গমনাগমনকারীর হাত ভক্তিভরে চুম্বন করিতেন এবং বলিতেন, বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের বুযুর্গদের হাত চুম্বন এবং তাঁহাদের দোআর বরকতেই হয়ত আল্লাহ আমার হারান মানিক ইউসুফকে আমার বুকে ফিরাইয়া দিতে পারেন।
হুযুর আকরাম (সাঃ) প্রত্যহ প্রভাতে এক বৃদ্ধার নিকট যাইতেন এবং বলিতেন, ওহে বৃদ্ধা। তুমি আমার জন্য আল্লাহর নিকট ভাল দোআ কর।
এক বুযুর্গ বলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, কোন ব্যক্তি যদি ভক্তিভরে কোন বুযুর্গের হাত চুম্বন করে তবে আল্লাহ অবশ্যই' তাহাকে পরকালে মুক্তি দান করিবেন। কারণ, যেব্যক্তি কোন বুযুর্গের হাত ধারণ করিল সে যেন হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর মোবারক হাতই ধারণ করিল।
হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইসলামের ইতিহাসে একজন অত্যাচারী, নির্মম, নিকৃষ্ট শাসনকর্তা হিসাবে চিহ্নিত হইয়া রহিয়াছেন। তিনি ইনতেকাল করার পর লোকে তাহাকে স্বপ্নে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার অবস্থা কি?
হাজ্জাজ বলিলেন, ধ্বংসের পথে পা দিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছি। কিন্তু একটি বিষয়ের প্রতি আমার ভরসা রহিয়াছে, হয়ত তাহার বরকতে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন। লোকে জিজ্ঞাসা করিল, সেই কাজটি কি?
হাজ্জাজ বলিলেন, আমাকে বলা হইয়াছে যে, তুমি অমুক দিন হাসান বসরীর দরবারে গিয়া ভক্তিভরে তাঁহার হাত চুম্বন করিয়াছিলে। তাহার বরকতেই তোমাকে ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইবে।
-------------
হুজুর (সঃ) এর বানী (২৬) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
ষষ্ঠ বিংশ মজলিস
হুযুর (সাঃ)-এর বাণী-
দোসরা রবিউস সানী, বৃহস্পতিবার। কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, শরীয়ত আমার বাণী, তরীকত আমার কার্যাবলী এবং হাকীকত আমার অবস্থা। শরীয়ত, তরীকত এবং হাকীকত একই বস্তু না ভিন্ন ভিন্ন বস্তু।
পীর ও মুরশিদ বলিলেন- সকলের মূলেই হইল শরীয়ত। শরীয়তে পাকাপোক্ত না-হওয়া পর্যন্ত তরীকত ও হাকীকত অর্জিত হয় না। শরীয়তের পথে তরীকতে প্রবেশ কর, যেন অবস্থার মনযিল স্বীয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জিত হয়। শরীয়ত ও হাকীকত বিচ্ছিন্ন বিষয় নহে। 'লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্' (لَاَ اِلهَ اِلاَّ اللَّهُ) হলো হাকীকত, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ) হলো শরিয়ত কেহ শুধু 'লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্' বলে এবং 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' না বলে, তবে সে মুসলমান হইবে না। ইহাতে মনে হয় শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকত একই বস্তু এবং শরীয়ত হইতে পৃথক নহে। ইহার তারতম্যও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, শরীয়ত আমার নির্দেশ। অর্থাৎ যাহা কিছু আমার নির্দেশ তাহা সহজতর এবাদত, জনসাধারণ সহজে আদায় করিতে সক্ষম হয়। তরীকত আমার কার্যাবলী, যাহা কষ্টকর এবং নিজেকে সাধনার অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। ওযু করা শরীয়ত, কিন্তু দিন-রাত ওযু সহকারে থাকা তরীকত। এই শক্তি জনসাধারণের মধ্যে কোথায়? কিন্তু হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) যাহাকে তরীকত বলিয়াছেন তাহা জনসাধারণকে করার নির্দেশও দেন নাই; আবার করিতে নিষেধও করেন নাই। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্তর মোবারক আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। এই রহস্য সম্বন্ধে কেহই কিছু অবগত নহে।
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি একবার এরশাদ করিয়াছেন যে, অনুকরণীয় ঈমান এবং আমাদের ঈমান একই সমতুল্য। কোথায় আরেফদের ঈমান আর কোথায় অনুকরণকারীদের ঈমান 'ইহা বুঝিতে পারিলাম না।
এরশাদ করিলেন, ইহার অর্থ হইল, অনুকরণকারীর ঈমান কাফেরের কুফরীর দিক হইতে ঈমান এবং বেহেশতে প্রবেশ করা তাহার পরিণতি। কিন্তু তাহাতে সন্তুষ্ট থাকা সামান্য পর্যায়ের সন্তুষ্টি। এই সম্প্রদায়ের মতে, তাহাদের এই সামান্য পর্যায়ের সন্তুষ্টি হারাম। তালেবের কোন কিছু অর্জিত হইলে তাহাতে স্থির-স্থিত থাকা ঠিক নহে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুকে তাঁহারা প্রতিমা এবং পৈতা মনে করেন। উচ্চ ধারণা ও শক্তি রাখিয়া আসল উদ্দেশ্য সাধনে লিপ্ত থাকিবে।
আরেফের ঈমানও ঈমানই। আরেফ আসল উদ্দেশ্যস্থলে না পৌঁছার দরুন নিজের ঈমানকে অনুকরণকারীর ঈমানের ন্যায়ই মনে করেন। মোশাহাদা না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়েই সমান। যেমন- এক দেরহামের সম্মুখে দশ দেরহাম অনেক বেশী। দশ হাজার দেরহাম একহাজার দেরহামের চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু অপরিমিতের সামনে কোথায় দশ আর কোথায় হাজার দেরহাম; বরং উভয়ই সামন। রাস্তা খুবই কঠিন। পথপ্রদর্শক ব্যতীত এই পথে চলা দুঃসাধ্য। হাঁ, দেখ ! এই পথে চিন্তা-ভাবনার সাথে পা রাখিও। কারণ, এই পথ বাধা-বিঘ্নে পরিপূর্ণ।
তারপর বলিলেন- সিদ্দীকে আকবর বলেন- ঈমান কি? সুতরাং অন্যে আর কি বলিবে? কিভাবে এরূপ ঈমানের প্রতি ভরসা করা যায়। এতটা হিম্মত থাকিতে হইবে যেন ঈমানের পথের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করা যায় এবং আশান্বিত থাকিবে যেন উদ্দেশ্যস্থলে পৌঁছা যায়।
তারপর বলিলেন, যে প্রেমের দাবী করে তাহার পক্ষে উচিত দুইটি বিপদের জন্য তৈয়ার থাকা। প্রথম- আল্লাহ তাআলার পক্ষ হইতে যে বিপদাপদ অবতীর্ণ হয় তাহার জন্য তৈয়ার থাকা। দ্বিতীয়- সৃষ্টির তরফ হইতে যে বালা-মসিবত আসিতে পারে তাহার জন্যও সদা তৈয়ার থাকা। তাই এই সম্প্রদায় কখনও ভালবাসার দাবী করেন না। কারণ, তাঁহারা উভয় প্রকার বিপদের নমুনাই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তাঁহারা জানেন, প্রেমের দাবী করিলে অবশ্যই প্রমাণ চাওয়া হইবে। এতদসত্ত্বেও তাঁহারা প্রেমের কারবার করেন না। আশা রাখেন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার। মানুষের কর্তব্য, যতদিন জীবিত থাকে ততদিন চেষ্টা হইতে ক্ষান্ত না থাকা। বাদশাহ হওয়ার দাবী করিও না। প্রভুর দাস হইয়া সাক্ষাত লাভের অপেক্ষা কর। প্রেমের ধর্ম হইল, বিপদ যতই হউক ধৈর্যধারণ করা।
হযরত নূহ (আঃ) সাড়ে নয়শত বৎসর জীবিত ছিলেন। তিনি যখনই লোকদিগকে আল্লাহর পথে আহ্বান করিতেন তখনই তাহারা তাঁহাকে ইট-পাথর নিক্ষেপ করিত। একদিন তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে সত্তর বার ইট-পাথর নিক্ষেপ করে। তিনি প্রতিবারই অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া যান। যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিত তখন আবার সকলকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করিতেন। নবী ব্যতীত এমন সহ্য শক্তি আর কাহারও থাকিতে পারে না।
এক বন্ধু বলিয়াছেন- জানি না, এই পথের বীরগণ কোন্ উচ্চ মর্যাদায় আসীন ছিলেন। কারণ, তাঁহারা আমল দ্বারা কখনও তৃপ্তি লাভ করেন নাই। পরিশেষে সত্যের গোলামী করার পর্যায়ে আসিয়াছেন এবং শাহানশাহে পরিণত হইয়াছেন। সমস্ত সৃষ্টির নেতায় পরিণত হইয়াছেন। সত্য বলিতে কি, তাঁহাদের ব্যথা নিজেদের সৃষ্টি নহে; বরং খোদার দান। এমন ব্যথা কষ্টে অর্জিত হইতে পারে না। সহ্য করার ক্ষমতা অনুযায়ী বিপদ সকলের উপরই অবতীর্ণ হয়। যেমন- হযরত মূসা (আঃ)-কে মায়ের নিকট হইতে সকালে পৃথক করিয়া আবার সন্ধ্যায় মায়ের মানিক মায়ের কোলে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। পক্ষান্তরে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া চল্লিশ বৎসর পর পিতার হৃদয়ের ধন পিতার নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন।
ইহার রহস্য এই যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর মা দুর্বলচেতা রমণী ছিলেন। পুত্রের বিচ্ছেদ যাতনা সহ্য করার মত ক্ষমতা তাঁহার খুবই কম ছিল। তাই তাঁহার পুত্রকে সকালে বিচ্ছিন্ন করিয়া আবার সন্ধ্যায় ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) পুরুষ ছিলেন। তাঁহার ধৈর্যধারণ ক্ষমতাও অধিক ছিল। তাই চল্লিশ বৎসরের ব্যবধানে পিতা-পুত্রের মিলন হইয়াছিল। কঠিন বিপদ নবীর উপর অবতীর্ণ হয়। তারপর তাঁহাদের সাথে যাঁহাদের সাদৃশ্য থাকে তারপর নবীর সাথে সাদৃশ্যশীলদের সাথে যাঁহাদের সাদৃশ্য থাকে। এইরূপ পর্যায়ক্রমে বিপদ অবতীর্ণ হইয়া থাকে।
হযরত আইউব (আঃ)-এর দেহে যখন পোকায় আক্রমণ করিল তখন দেহের গোশত শেষ করিয়া হাড় পর্যন্ত চলিয়া গেল। এই অবস্থায়ও তিনি আল্লাহর নিকট কোন প্রকার ফরিয়াদ করেন নাই। বরং আল্লাহ যাহা করিতেছিলেন তাহাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকিয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করিতেছিলেন। দেহে গোশত না থাকায় কীটের দল তাঁহার জিহ্বা ও অন্তরের দিকে ধাবিত হইল। তখন তিনি ক্রন্দন করিয়া আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করিলেন। কিন্তু বিপদে অধীর হইয়া তিনি ফরিাদ করেন নাই; বরং তাঁহার জিহ্বা ও অন্তর নষ্ট হইয়া যাইবে এই ভয়ে তিনি ফরিয়াদ করিয়াছিলেন। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করিলেন, হে খোদা ! আমার অন্তর ও জিহ্বা যদি কীটের খাদ্যে পরিণত হয় তবে তোমার নাম আমি কি উপায়ে স্মরণ করিব? এই অবস্থায় তিনি মোনাজাত করিলেন-
"হে প্রভু! আমি বিপদাপন্ন। আমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন। আপনি অত্যন্ত মেহেরবান"।
তারপর হযরত মূসা ও হযরত খিযির (আঃ) প্রসঙ্গে বলিলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) মিম্বরে দাঁড়াইয়া ওয়ায করিতেছিলেন। এমন সময় সেখানে এক পাগল আসিয়া উপস্থিত হইল এবং প্রশ্ন করিল, (مَنْ اَعْلَمِ النَّاسِ) শ্রেষ্ঠ আলেম কে ? হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, (যেহেতু আমি নবী) আমিই শ্রেষ্ঠ আলেম। অতঃপর তিনি পাহাড়ে গমন করিয়া আল্লাহর নিকট জানিতে চাহিলেন, হে আল্লাহ! সত্যই কি আপনি আমাকে সকলের চেয়ে বেশী জ্ঞান দান করিয়াছেন?
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, খিযির নামে আমার এক বান্দা আছে, সে তোমার চেয়ে বড় আলেম।হযরত মূসা (আঃ) আরয করিলেন, হে প্রভু ! আমাকে আপনি তাঁহার সাথে সাক্ষাত করাইয়া দেন যেন আমি তাঁহার নিকট হইতে জ্ঞানার্জন করিতে পারি। আল্লাহ তা'আলা প্রার্থনা কবুল করিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে জ্ঞানার্জন করার সুযোগ দান করিলেন। তিনি বহু সন্ধানের পর হযরত খিযির (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলেন। পবিত্র কোরআনে এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ ত'আলা বলেন,- "আমার বান্দাদের মধ্যে আমার খাস রহমত প্রাপ্ত এক বান্দার সাক্ষাত সে পাইল এবং তাহাকে আমি এক বিশেষ প্রকারের এলম (এলমে লাদুনী) দান করিয়াছি।"
সন্ধান করার পর যখন তিনি বাঞ্ছিত জনের সাক্ষাত পাইলেন তখন হযরত খিযির (আঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আল্লাহর নবী ! কি প্রয়োজনে আপনি এই কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন? হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, আপনার নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। খিযির (আঃ) বলিলেন, আপনি কি আমার কার্যকলাপ সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করিতে পারিবেন? এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন- "খিযির বলিল, নিশ্চয়ই আপনি আমার সাথে থাকিয়া ধৈর্যধারণ করিতে পারিবেন না। মূসা বলিলেন, আমি ধৈর্যধারণ করিব। উভয়ে সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া এক নদীর তীরে উপস্থিত হইলেন এবং নদী অতিক্রম করার জন্য নৌকায় আরোহণ করিলেন। নৌকা যথাস্থানে পৌঁছার কিছু পূর্বেই খিযির (আঃ) নৌকাখানি ছিদ্র করিয়া ফেলিলেন। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, অযথা কেন আপনি, গরীব বেচারাদের নৌকা ছিদ্র করিয়া ফেলিলেন?"
এই ঘটনার বর্ণনায় আল্লাহ তাআলার ভাষায় হযরত খিযির (আঃ) বলেন- আমি কি প্রথমেই বলি নাই যে, আপনি আমার কাজে ধৈর্যধারণ করিতে পারিবেন না। মূসা (আঃ) বলিলেন, আমার ভুল হইয়া গিয়াছে। আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর উভয়ে আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। কিছুদূর গিয়া দেখিলেন সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট একটি বালক অন্য বালকদের সাথে আনন্দ চিত্তে খেলা করিতেছে। হযরত খিযির (আঃ) খেলারত বালকদের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট ছেলেটিকে ধরিয়া আনিয়া হত্যা করিলেন। হযরত মূসা (আঃ) তাঁহারই সম্মুখে একটি নিষ্পাপ খেলারত শিশুকে হত্যা করিতে দেখিয়া অধৈর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- আপনি কেন এই অবোধ বালকটিকে হত্যা করিলেন? হযরত খিযির (আঃ) বলিলেন, আমার কথা কি সত্যে পরিণত হইল না যে, আপনি আমার কাজে ধৈর্যাবলম্বন করিতে পারিবেন না? আপনি আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যান। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, অতঃপর যদি কোন প্রশ্ন করি তবে আপনার নিকট হইতে বিদায় করিয়া দিবেন। আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে বলেন-
"ইহার পর যদি আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করি তবে আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখিবেন না।"
আবার তাঁহারা পথ চলা আরম্ভ করিয়া এক গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গ্রামে একটি ভাঙ্গা প্রাচীর ছিল। হযরত খিযির (আঃ) বিনা পারিশ্রমিকেই সেই ভাঙ্গা প্রাচীরটি মেরামত করিয়া দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, বিনা পারিশ্রমিকে আপনি কেন এই প্রাচীরটি মেরামত করিয়া দিলেন। হযরত খিযির (আঃ) (কোরআনের ভাষায়) বলিলেন- "এখন আপনার ও আমার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সময় হইয়া গিয়াছে"।
হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, হে খিযির (আঃ)। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার উপরোক্ত তিনটি কাজের ব্যাখ্যা না দিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার নিকট হইতে যাইব না। আপনার এই সমস্ত কাজের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। সুতরাং আপনি ঐ সমস্ত কাজের কারণ বলার পরই আমি আপনার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব।
হযরত খিযির (আঃ) বলিলেন, আমরা যেই নৌকায় নদী পার হইয়াছি তাহা ছিল কিছু সংখ্যক গরীব শ্রমিকের। শ্রমিকরা ঐ নৌকার আয় দ্বারাই সংসারযাত্রা নির্বাহ করে। আমাদের পিছনেই এক অত্যাচারী বাদশাহ আসিতেছিল। সে অক্ষত নৌকা দেখিলেই জোরপূর্বক লইয়া যায়। তাই আমি নৌকা ছিদ্র করিয়া দিলাম যাহাতে সে নৌকা লইয়া না যায়। আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে এরশাদ করিয়াছেন-
"নৌকাটি ছিল কিছুসংখ্যক গরীব শ্রমিকের যাহারা নদীতে মাঝিগিরি করিত। আমি উহাকে এইজন্য ত্রুটিযুক্ত করিয়া দিলাম যে, পিছনে এক বাদশাহ আসিতেছিল যে ভাল ভাল নৌকা লইয়া যায়"।
বালকটি হত্যা করার কারণ এই যে, উক্ত বালকের পিতা-মাতা নেকবখত মুসলমান। আর বালকটি কুফরীর প্রতি আসক্ত। পিতা-মাতার ইচ্ছা বালকটিকে হত্যা করিয়া ফেলা। তাই আমি তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলাম যেন তাহারা এমন কুসন্তান হইতে পরিত্রাণ পায়। আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে মেহেরবান এবং সৎ পুত্র দান করিবেন। কোরআন পাকে বর্ণিত আছে: সন্তানের পিতা-মাতা মোমেন ছিল। আমার ভয় হইল, ভবিষ্যত জীবনে স্বীয় অবাধ্যতা ও কুফরীর দরুন পরকাল বরবাদ হইয়া যায় কিনা।
আমি যেই প্রাচীর মেরামত করিয়া দেই উহার মধ্যে দুই জন ইয়াতীমের ধনভাণ্ডার ছিল। প্রাচীর ধ্বংস হইয়া গেলে সেই সম্পদ বাহির হইয়া পড়িত এবং অন্য লোকে লইয়া যাইত। ফলে ইয়াতীমদ্বয় তাহাদের সম্পদ হইতে বঞ্চিত হইয়া পড়িত।
আল্লাহ তাআলা কোরআন পাকে এই সম্বন্ধে বলেন- "শহরে দুই জন নাবালেগ ইয়াতীম বাস করে। এই প্রাচীরদ্বয়ের নিচে তাহাদের সম্পদ লুকানো রহিয়াছে। তাহাদের পিতা সৎ ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় বালকদ্বয় বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহাদের সম্পদ বাহির করিয়া লইবে। ইহা তোমার প্রভুর রহমতের ব্যবস্থাপনা"।
আমি আমার ইচ্ছায় কিছুই করি নাই। ইহাই ঐ ঘটনাত্রয়ের ব্যাখ্যা, যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করিতে সক্ষম হন নাই। এই প্রাচীরের নিচে কি সম্পদ লুক্কায়িত ছিল এই সম্বন্ধে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রহিয়াছে। কেহ বলেন, টাকা-পয়সা ছিল। আবার কেহ কেহ বলেন, পাথরের টুকরা ছিল। তাহাতে দুইটি বাক্য লেখা ছিল। প্রথম বাক্য-
"যে তকদীরে বিশ্বাসী সে কিভাবে চিন্তিত হইতে পারে"?
"যেব্যক্তি মাওলার উপর বিশ্বাসী সে কিভাবে নিশ্চিন্তে আনন্দ উপভোগ করিতে পারে? ইহার পর মূসা (আঃ) বিদায় গ্রহণ করিলেন।
অতঃপর আত্মদর্শন ও আত্মগর্ব সম্বন্ধে বলিলেন, হে ভ্রাত! তোমরা লক্ষ্য করিয়াছ কি, অভিশপ্ত শয়তান কিভাবে বলিল, (اَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ) আমি তাহার চেয়ে ভাল। অথচ সকলেই জানে, এই অহংকারীর পরিণতি কি হইয়াছিল? সুতরাং হে বন্ধুগণ। আর কতদিন আত্মদর্শনে আত্মগর্বে লিপ্ত থাকিবে। যাও, শয়তানের কাহিনীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখ যে, আত্মদর্শনের অহমিকায় তাহার পরিণতি কি হইয়াছিল?
চরিত্রের পরিবর্তন (২৫) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২৫- পঞ্চবিংশ মজলিস
চরিত্রের পরিবর্তন-
পহেলা রবিউস সানী, বুধবার। পবিত্র দরবার শরীফে সেই দিন চরিত্র পরিবর্তন সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল। পীর ও মুরশিদ এরশাদ করেন, সূফীগণ গুণের পরিবর্তনকে বিবর্তন বলিয়া থাকেন। মুরীদের প্রথম কর্তব্য হইল খারাপ স্বভাবকে সৎস্বভাবে, ক্রোধকে সহনশীলতায়, কৃপণতাকে বদান্যতায় ও অহংকারকে বিনয়ে পরিণত করা, রূঢ় কথার পরিবর্তে মিষ্টি ভাষা প্রয়োগ করা, অন্যায় কিছু না করিয়া ন্যায়নিষ্ঠ হওয়া ইত্যাদি বিষয়ের প্রতি মনোনিবেশ করা।
এই সমস্ত কাজ মুরীদের পক্ষে ওযু করার ন্যায়। যেমন ওযু ব্যতীত নামায হয় না। তেমনি ঐ সমস্ত বিষয়বস্তু আয়ত্তে আনিতে না পারিলে তাহার পক্ষে তরীকতের পথে চলা সম্ভবপর হয় না। সাধন-ভজনের মূলই হইল ঐ সমস্ত বিষয়ের অধিকারী হওয়া।
সূফী সম্প্রদায় বলেন, এই সমস্ত গুণ আয়ত্তাধীন হইলে পূর্ণ পবিত্রতা অর্জিত হয়। ইহার পর যেকোন এবাদত-বন্দেগীই করা হয় তাহা সার্বিক হয় এবং আল্লাহ কবুল করেন। পরকালে তাহা ফলপ্রসূ হইবে।
যেই দুর্ভাগা এই গুণাবলীর সামান্যতম কিছুও অর্জন করিতে না পারে সে যত নামায পড়ুক, রোযা রাখুক আর স্বার্থান্বেষী আলেমগণ ঐ সমস্ত এবাদত-বন্দেগী দুরস্ত হওয়ার যত ফতওয়াই দিক না কেন, এই দুর্ভাগা যেইসব কর্তব্য কাজ সমাধা করিয়াছে, পরকালে সেইসব তাহার কোন কাজেই আসিবে না। তাই সূফী সম্প্রদায় এই বিবর্তনকে ফরযে আইন বলিয়া থাকেন। এই সমস্ত গুণ অর্জিত হইলে নফস পরাভূত হইয়া যায়। আর যে নফস পরাভূত হয় না, অন্তর সেই কাফের নফসের কয়েদী। নফস যে আদেশ দেয় অন্তর কয়েদীর ন্যায় সেই আদেশই পালন করে।
এইভাবে বুঝিয়া লও যে, মুসলমানী কাফেরীর হাতে বন্দী। তাই কাফের নফস যাহা বলে, মুসলমান (অন্তর) তাহার আদেশ পালনে 'হাঁ' না বলিয়া তবে কি করিবে?
অন্তর এবং নফসের ইহাই পরিচয়। অন্তর কখনও এমন কথা বলে না যে. দোযখের দিকে যাইতে হইবে। অন্তরের সিংহাসনে নফস উপবিষ্ট হইয়া বলে, 'আমিই তোমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রভু'।
আর অন্তরের পরিচয় হইল, মোমেনের কলব আল্লাহর আরশস্বরূপ। মোমেনের অন্তকরণ আল্লাহর ঘর। মোমেনের অন্তকরণ তাহাতেই শান্তি পায়।-
কাফের নফস আমাদের অন্তরে বাসা বাঁধিয়াছে এবং অন্তরকে তাহার বন্দী দাসে পরিণত করিয়াছে।
অন্তরে দেবদেবী প্রকাশ্যে মোনাজাত। হে অন্তকরণ। এখন মুসলমান হও, পৈতা ছিঁড়িয়া ফেল। কাফেরী তোমার অন্তরে বাসা বাঁধিয়াছে। এই কারণেই আজ পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা কম।
স্বভাব পরিবর্তনে নফস যখন বাহির হইয়া যায় তখনই অন্তর বাদশাহ হইয়া নফসকে বন্দী করে। অন্তর বাদশাহ হওয়ার সাথে সাথেই ঈমানের সূর্যোদয় হয় এবং ইসলাম স্বীয় সৌন্দর্য প্রদর্শন করে। মারেফাতের দ্বার তাহার বক্ষস্থল উন্মুক্ত করিয়া দেয়।
তারপর হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন- অসদগুণাবলী যখন পরিবর্তন হইয়া যায় তখন তোমার সমস্ত সমস্যারও সমাধান হইয়া যায়। তোমার অস্তিত্ব যখন বিলীন হইয়া ফানার অবস্থা প্রকাশ পায় তখন তোমার মধ্য হইতে আনাল হক (আমি সত্য) শব্দ উত্থিত হইতে পারে। ইহার অর্থ এই যে, তোমার পক্ষে যতটা সম্ভব তুমি যেন নফসের নির্দেশমত না চল, অন্যথায় ধ্বংস হইয়া যাইবে। সমস্ত বুযুর্গই নফসের এই অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞাত। তাঁহারা নফসের ধোঁকা হইতে কান্নার সাথে আল্লাহর নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করিয়া বলেন- "আহ! আমার মা যদি আমাকে প্রসবই না করিতেন তবে কাফের নফস আমাকে ধ্বংস করিতে পারিত না। আমার জন্মের পর জীবিত দেখিয়া যদি আমার নামই না রাখিত, তবে পার্থিব কাজকর্ম এবং আরাম-আয়েশের জন্য আমাকে প্রশ্নই করা হইত না"।
একদিন কোন বুযুর্গের ইচ্ছা হইল তিনি মুরগীর ডিম খাইবেন। তিনি নফসকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন, আমি যতদিন জীবিত আছি মুরগীর ডিম খাইব না। এই ওয়াদা স্মরণ রাখিয়াই তিনি বিদেশ ভ্রমণে বাহির হইলেন। এক যুগ অর্থাৎ বার বৎসর পর্যন্ত তিনি সফরে থাকেন। একদিন তিনি কোন এক শহরে উপস্থিত হইলেন। তথাকার এক বুযুর্গ আসিয়া বলিলেন, ওহে শায়খ ! আজ আপনি আমার গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করুন। বুযুর্গ দাওয়াত কবুল করিলেন এবং মেজবানের সাথে তাঁহার গৃহে উপস্থিত হইলেন। এই সময় মেজবানের গৃহে মুরগীর ডিম এবং রুটি ব্যতীত আর কিছুই ছিল না। তিনি তাহা আনিয়া মেহমানের সম্মুখে রাখিলেন। মেহমান খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হইলেন। এমন সময় তাঁহার নফস বলিয়া উঠিল, পরিশেষে এক যুগ পর আমার ইচ্ছা পূরণ করিতে যাইতেছি। বুযুর্গ উপলব্ধি করিতে পারিলেন, নফসের আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থ হইতে যাইতেছে। তিনি বলিলেন, খোদার কসম। এখনও তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হয় নাই। এই কথা বলিয়াই তিনি উঠিয়া দাঁড়াইলেন এবং আহার না করিয়াই চলিয়া গেলেন।
বুযুর্গগণ নফসকে এইভাবেই পরাস্ত করিতেন এবং এইভাবেই তাঁহাদের উদ্দেশ্য সাধন হইত। আর তোমাদের ধারণা, পিতা-মাতার অনুসরণ করত শুধু রোযা-নামায দ্বারাই বৈতরণী পার হইয়া যাইবে। কখনও নহে। এইভাবে লক্ষ্যস্থল পৌঁছা সম্ভবপর হইবে না। ইহার পূর্বের যত কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে তাহা তো স্বভাবসিদ্ধ। তাহাকে ধর্ম বলা যাইতে পারে না।
------------
মিলন সেতু (২৪) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২৪- চতুর্বিংশ মজলিস
মিলন সেতু
ঊনিত্রিশে রবিউল আউয়াল, সোমবার। দরবারে উপস্থিত মুরীদদের মধ্য হইতে কাযী যাহেদ বলিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন-
"যেব্যক্তি আমাকে সফর মাস গত হওয়ার সুসংবাদ দিবে আমি তাহাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিব।" পয়গম্বরদের নিকট মাসের কোন প্রকার ভাল-মন্দ বা কোন বস্তুর কোন প্রকার কঠোরতা নাই। বরং সকল মাসই তাঁহাদের নিকট সমান। সুতরাং হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) কোন উদ্দেশ্যে এমন কথা বলিলেন?
পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, এই হাদীসের অনেক প্রকার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। প্রথমত সফর মাসে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) অসুস্থ হন। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে কথা দিয়াছিলেন, হে বন্ধু। সফর মাস অতিবাহিত হওয়ার পরই আপনি আমার সাথে মিলিত হইবেন। তাই সফর মাস হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য কষ্টকর কোন কিছু ছিল না। বরং সফর মাস অতিবাহিত হইতে যে বিলম্ব হইতেছিল এবং যে বিলম্বের ফলে বন্ধুর সহিত মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, তাহাই তাঁহার জন্য কষ্টকর ছিল। তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন, কখন সফর মাস শেষ হইবে আর আমি আমার আরাধ্য জনের সহিত গিয়া মিলিত হইব।
ইহার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এরশাদ করিয়াছেন, যে আমাকে সফর মাস শেষ হওয়ার সংবাদ দিবে আমি তাহাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিব।
ইমাম যাহেদ (রঃ) তাফসীরে লিখিয়াছেন, বারই রবিউল আউয়াল সোমবার হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করিয়া পরম বন্ধুর সাথে গিয়া মিলিত হন। ইহার রহস্য হইল- 'মৃত্যু' বন্ধুর সাথে বন্ধুর 'মিলন সেতু'।
এখানে তিনি বলিয়াছেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় সাহাবাগণ যে সমস্ত কাজ-কারবার করিতেন তাঁহার ইনতেকালের পর আর সেই সবে তেমন বরকত ও সুযোগ-সুবিধা পাইতেছিলেন না। তাঁহারা ভয় পাইলেন, নিশ্চয়ই আমাদের ধর্মীয়কাজে শিথিলতা আসিয়াছে। এই ধারণা হইতে তাঁহারা ঘর-বাড়ী, স্ত্রী-পুত্রের মায়া পরিত্যাগ করত ধর্মীয় কাজের জন্য নির্জনতা অবলম্বন করিলেন। "পাহাড় জঙ্গলের ঐ সমস্ত জীব-জন্তুর ন্যায় জীবিকানির্বাহ কর যাহারা সব কিছু দেখিয়া ভয় পায় এবং বাড়ী-ঘর ইঁদুর-বিড়ালের জন্য ছাড়িয়া দাও"। ধর্মের চিন্তা যাহার অন্তরে স্থায়ী হইয়া যায়, ঘর-বাড়ী, সন্তান-সন্ততি তাহার চলার পথে বাধা সৃষ্টি করিতে পারে না।
উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত হাসান বসরী (রঃ) সাহাবী ছিলেন কিনা?
তিনি বলিলেন, সাহাবী নহেন, কিন্তু সাহাবীদের তিনি দেখিয়াছেন। তিনি ছিলেন তাবেয়ী। তিনি যত সাহাবী দেখিয়াছেন অন্য কোন তাবেয়ীর সেই ভাগ্য হয় নাই।
তারপর বলিলেন, একদিন তিনি বহু লোকের সাথে বসা ছিলেন। তাহাদেব মধ্য হইতে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত। সাহাবীদের দৃষ্টিতে আমরা কেমন? তিনি উত্তর করিলেন, তোমাদিগকে তাঁহারা দেখিলে বলিতেন তোমরা শয়তান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি তোমরা তাঁহাদিগকে দেখিতে এবং তাঁহাদের আচার-ব্যবহার প্রত্যক্ষ করিতে তবে বলিতে, ইহারা তো উন্মাদ ! বোধ শক্তি বিবর্জিত পাগল।
হযরত হাসান বসরীর বর্ণনামতে এই ছিল তাবে তাবেয়ীদের অবস্থা। অথচ হিজরতের পর তখনও একশত চল্লিশ বৎসর অতিবাহিত হয় নাই। আজ আমরা শত শত বৎসর পরের লোক। অথচ আমরা আমাদিগকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দান করি। প্রতিমার উদ্দেশে সেজদা করিয়া কপালে দাগ পড়িয়া গিয়াছে। এই অবস্থায় মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিয়া নিজেকে আর কতকাল দোষারোপ করিব? যাহারা পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণ করিবে (যমন আমরা) তাহাদের জন্য পরিতাপ। আল্লাহ জানেন তাহাদের কি অবস্থা হইবে?
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, ধৈর্যধারণ করা কি ঈমানের শর্ত? এরশাদ করিলেন, হাঁ, ধৈর্যধারণ করা ঈমানের শর্তাবলীর মধ্যে একটি শর্ত।
তাহা হইলে যেব্যক্তি ধৈর্যশীল নহে তাহার অবস্থা কি হইবে?
বলিলেন, এমন কথাই হইতে পারে না। প্রতিটি লোক তাহার ঈমান অনুযায়ী ধৈর্যশীল। কাহারও ধৈর্য প্রকাশ পায় আবার কাহারও ধৈর্য গোপন থাকে। শোন ! হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন- "ঈমানের দুইটি অংশ ! একাংশ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং অন্যাংশ ধৈর্যাবলম্বন"। ইহাতে প্রমাণিত হয়, যেব্যক্তি "লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্ মুহম্মদুর রসুলুল্লাহ্" বলে সে-ই ধৈর্যশীল। কোন মোমেনই ধৈর্যহীন নহে এবং হইবেও না। ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আল্লাহই দান করেন। বান্দার কর্তব্য সর্বদা আল্লাহর নিকট ধৈর্যধারণের ক্ষমতা প্রার্থনা করা। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন- "হে মোমেনগণ! নামায ও ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথী"।
সমস্ত লোকই দুইটি অবস্থার সাথে জড়িত। হয় সে সুখে-সম্পদে থাকে অথবা বিপদে জড়িত হয়। যদি সুখে-সম্পদে থাকে তবে আল্লাহ তাহার নিকট কৃতজ্ঞতা চাহেন। আর যদি বিপদে জড়িত হয় তখন তাহার নিকট ধৈর্যধারণের প্রত্যাশা করেন। যেব্যক্তি এই দুই প্রকার গুণে গুণান্বিত নহে, তাহার পক্ষে ঈমানের দাবী করা বাতুলতা ব্যতীত আর কিছুই নহে। ওয়াস সালাম।
-----------
শরীয়ত ও হাকীকত (২৩) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
আঠাশে রবিউল আউয়াল, রবিবার। খানকা শরীফে উপস্থিত মুরীদদের মধ্য হইতে কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন,
এরশাদ করিলেন, হাকীকত এই যে, তাহাতে কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন জায়েয নাই। হযরত আদম (আঃ) হইতে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত ইহার ব্যতিক্রম হইবে না। যেমন- আল্লাহর মারেফাতের হাল বা অবস্থা।
শরীয়তে রদবদল জায়েয। শরীয়তের আদেশ-নিষেধ রদবদল হইয়া থাকে। শরীয়তের আভিধানিক অর্থ মুসলমানদের পথ ও মত।
কাযী সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তবকায়ে ওয়াক্ত এবং হাল কাহাকে বলে?
এরশাদ করিলেন, একই সময়ে অতীত এবং বর্তমান হইতে অজ্ঞাত হইয়া যাওয়া। এই অবস্থা কাহারও মধ্যে সৃষ্টি হইলে তাহাকে ওয়াক্ত বলে। ঐ সময় যদি কেহ অন্য পথে অতিক্রম করে এবং ঐ পথকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করিয়া ওয়াক্তকে স্থায়ী ও আরামদায়ক করে তবে তাহাকে হাল বলা হয়।
কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন, তামকীন ও মাকাম কাহাকে বলে?
এরশাদ করিলেন, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়া যদি আরাম পায় তবে তাহাকে তামকীন বলে। যেমন- নদী ও সাগরের পানি সর্বদিকে চঞ্চলতার সাথে প্রবাহিত হইয়া থাকে। কিন্তু সমুদ্রে পৌছার পর সমস্ত চঞ্চলতা হারাইয়া আরামে নিশ্চুপ থাকে। স্রোতধারায় চঞ্চলতা থাকিলেও সমুদ্রে পৌছিয়া স্থির হইয়া যায়। নদী একটি স্রোতধারা বুকে করিয়াই শব্দ করে; আর সমুদ্র হাজার নদী বুকে ধারণ করিয়াও চুপ থাকে।
যখন কাহারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হইয়া পড়ে, সে যদি কান্নাকাটি করিয়া তওবা করে আর বলে-
"হে আমার প্রভু ! আমি আমার নফসের প্রতি বহু যুলুম করিয়াছি। আমায় ও আমার পাপকে ক্ষমা করুন। কারণ, আপনি ব্যতীত পাপ ক্ষমাকারী আর কেহ নাই"। ইহাকে মাকাম বলা হয়। যেমন- হযরত আদম (আঃ) ভুল করার পর তিন শত বৎসর পর্যন্ত তওবা ও কান্নাকাটি করিয়াছিলেন আর বলিয়াছিলেন-
"হে প্রভু ! আমি আমার নফসের উপর যুলুম করিয়াছি। যদি আপনি ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন তবে আমি ধ্বংস হইয়া যাইব"।
মোটকথা, মোমেনের কর্তব্য কোন অবস্থায়ই পাপ না করা। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলিকে মূল্যবান মনে করিয়া সর্বক্ষণ তওবা-এস্তেগফার করিতে থাকিবে। বুযুর্গগণ বলেন,
হে বৃদ্ধ পাপী ! তওবার দ্বার উন্মুক্ত। নানা প্রকার নেয়ামত তোমার জন্য তৈয়ার। তাড়াতাড়ি তওবা কর। কারণ, বিলম্বে তোমার ক্ষতির উপর ক্ষতিই হইবে।
হে ভ্রাত! এই সুফী সম্প্রদায় প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি স্থানের জন্য একটি নাম ও একটি পরিভাষা নির্দিষ্ট করিয়া লইয়াছেন, যাহা একমাত্র এই সম্প্রদায়ের লোকই বুঝিতে সক্ষম। যে বুঝার সে বুঝে আর যে না বুঝার সে অবুঝ থাকে।
কাযী যাহেদ আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, এমন কেন করা হইল আর এমন কেন হইল না, এই প্রশ্ন করার বান্দার অধিকার আছে কি?
এরশাদ করিলেন, এই ভাবের কোন কথা বলার অধিকারই বান্দার নাই। আল্লাহ ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার কাজ সম্বন্ধে প্রশ্ন করার কাহারও কোন অধিকার নাই। কাহার ক্ষমতা আছে যে তাঁহার কারখানার দিকে ফিরিয়া তাকায়, তাঁহার কাজ সম্বন্ধে মুখ খোলে। আল্লাহ যাহা ইচ্ছা করেন এবং যাহা ইচ্ছা আদেশ করেন। কবি ঠিকই বলিয়াছেন- (ভাবার্থ) "কাহার এত বড় সাহস যে, তোমার প্রতাপের সামনে মাথানত করা ব্যতীত মুখ খোলার সাহস পায়"।
ইহা অমুখাপেক্ষীর দরবার। কাহারও কিছু জিজ্ঞাসা করার হক নাই। যাহাকে গ্রহণ করার বিনা কারণেই করিয়াছেন এবং যাহাকে প্রত্যাখ্যান করার বিনা কারণেই প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। যাহা ইচ্ছা করেন কথার ইহাই রহস্য।
কোন কবি বলিয়াছেন- (ভাবার্থ) "অনাদিকালে কি নির্ধারণ করা হইয়াছে আমি কিছুই জানি না। কাহার পরিণতি গ্রহণযোগ্য তাহাও জানি না। তোমার কার্যাবলী কেহই অবগত নহে। তোমার অমুখাপেক্ষিতাকে ভয় না পায় এমন কে আছে"?
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, যাহা সহ্য করার বা মোকাবিলা করার ক্ষমতা নাই তাহা হইতে পশ্চাদপসরণ কি পয়গম্বরদের সুন্নত।
এরশাদ করিলেন, হাঁ! হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর পক্ষে যখন মক্কায় বসবাস করা অসম্ভব হইয়া উঠিল তখন তিনি হযরত আবু বকরকে সাথে লইয়া মদীনার পথে হিজরত করিলেন। তিনি চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথেই তাঁহার শত্রুগণ পিছনে ধাওয়া করিল। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ও হযরত আবু বকর পর্বত গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। গুহা মুখে মাকড়সা জাল বুনিয়া রাখিল। শত্রুরা গুহা মুখে মাকড়সার জাল দেখিয়া মনে করিল- ইহার মধ্যে কোন লোক যাইতে পারে না। তাহারা বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া গেল।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) গুহা হইতে বাহির হইয়া মদীনার পথে রওয়ানা হইলেন এবং নিরাপদে মদীনায় উপস্থিত হইলেন। এই কাহিনী বলার উদ্দেশ্য এই যে, কোন কিছুর মোকাবিলা করায় অসমর্থ হইয়া পশ্চাদপসরণ করা যে সুন্নত, ইহাই তাহার প্রমাণ।
তারপর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, বালা-মসিবত দেখিয়া পলায়ন করাও কি সুন্নত?
এরশাদ করিলেন, হাঁ! ইহাও পয়গম্বরদের সুন্নত। হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি নির্দেশ আসিল-
আল্লাহ বলিলেন, হে মূসা! লাঠি মাটিতে ফেলিয়া দাও। লাঠি ফেলিয়া দিতেই উহা ধাবমান সাপে পরিণত হইল। লাঠি সাপ হইয়াই হযরত মূসা (আঃ)-কে আক্রমণ করিত উদ্যত হইল। তিনি ভয়ে দৌড় দিলেন।
আল্লাহ পাক এরশাদ করিলেন, উহা ধর এবং ভয় করিও না। উহা আসল আকৃতিতে ফিরিয়া আসিবে। হযরত মূসা (আঃ) ধরিতেই উহা পূর্ববর্তী রূপ লাঠিতে রূপান্তরিত হইল।
সুতরাং দেখা গেল, বিপদ দেখিয়া মূসা (আঃ) ভাগিয়াছিলেন। অন্যান্য পয়গম্বরের জীবনেও এমন নিদর্শন রহিয়াছে। সুতরাং ইহাও পয়গম্বরদের সুন্নত। কেহ যদি ধৈর্যধারণ না করে, আল্লাহর সিদ্ধান্তে রাযী না থাকে, তাহার সম্বন্ধে নিম্নরূপ ধমক আসিয়াছে-
"নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন আল্লাহ নাই। আমার কাজে যে সন্তুষ্ট নহে; আমার দেওয়া বিপদে যে ধৈর্যধারণ না করে এবং যে আমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, সে যেন আমার রাজ্য হইতে চলিয়া যায় এবং আমা ব্যতীত অন্যকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করে।" তারপর বলিলেন, বিপদ দেখিয়া পলায়ন করার আদেশ আছে এবং ইহা ধৈর্যের প্রতিবন্ধক নহে। বিপদে ধৈর্যধারণ কাহাকে বলে জান? বিপদ আসিলে অসন্তুষ্ট না হওয়াই ধৈর্যধারণ। খোদা প্রেমিকদের যত বিপদই আসে তাঁহারা সাদরে গ্রহণ করেন এবং হাসিমুখে বিপদের তিক্ততা বরণ করিয়া লন; বরং আরও বিপদ আসার অপেক্ষায় থাকেন এবং বলেন-
"একটিই তো মাত্র প্রাণ আমার, যে তোমার প্রেমের বোঝা বহন করিবে। যতক্ষণ তোমার কাজ না আসে পশ্চাদপসরণের নাম নাই। তোমার প্রেমে যে বিপদ জীবনের উপর আসে তখন তো এই আশা যে, একের পরিবর্তে যেন হাজার বিপদ আসে।"
------------
সবেবরাত (22) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
শবে বরাত
সাতাইশে রবিউল আউয়াল, শনিবার আমরা দরবারে উপস্থিত ছিলাম। সৈয়দ খালছার পুত্র বলিলেন, 'রওযাতুল ইসলাম' কিতাবে লিখিত আছে, যে মুসলিম রমণী কপালে সিঁদুর লাগায় সে কাফের। বহু মহিলা এই কাজ করিয়া থাকে; তাহাদের উপায় কি?
হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, কাফেরদের মহিলারা কপালে সিঁদুর লাগায়। এখন দেখিতে হইবে, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য না ধর্মীয় নীতি পালনার্থ এই সিঁদুর লাগায়। যদি সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য লাগায় তবে কুফরী নহে। আর যদি তাহাদের ধর্মের অঙ্গ হিসাবে লাগায় এবং মুসলমান মহিলারাও লাগায় তবে ইহা কুফরী হইবে। কারণ, কাফেরদের অনুসরণ করাই কুফরী।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন- "যে যে সম্প্রদায়ের অনুসরণ করে সে উক্ত সম্প্রদায়ভুক্ত"।
যদি কপালে সিঁদুর লাগানো কুফরী হইত তবে 'কানযুল মাসায়েল' গ্রন্থের গ্রন্থকার অবশ্যই তাহা প্রকাশ করিতেন। এই সময় আশরাফুদ্দীন রোকন বলিলেন, ইহার পূর্বেও বহু আলেম এই মাসআলা সম্বন্ধে বহু ঘাঁটাঘাঁটি করিয়াছেন। কিন্তু কোথাও কিছু পাওয়া যায় নাই। কপালে সিঁদুর লাগানো যদি কাফেরদের ধর্মীয় অনুশাসন হইত তবে অবশ্যই পাওয়া যাইত এবং আলেমগণও প্রচার করিতেন।
ইহার পর মাখদুম জাহা বলিলেন, কপালে সিঁদুর লাগানো দ্বারা কাফেরদের অনুসরণ করা হয় না। কারণ, আমরা এমন বহু কাজ করিয়া থাকি যাহা কাফেরও করিয়া থাকে। যেমন- কাফের পানাহার করে আমরাও করি, তাহারা কথাবার্তা বলে আমরাও বলি, তাহারা কাপড় পরিধান করে আমরাও করি।
এরূপ আরও অনেক কাজই আমরা করিয়া থাকি, তাহাতে কুফরী হয় না। তাই সিঁদুর লাগানোও এই জাতীয় কাজ। যাহা তাহাদের ধর্মীয় নীতি তাহাতে যদি আমরা তাহাদের অনুসরণ করি তবে কুফরী হইবে।
এক বন্ধু আরয করিলেন, হিন্দু সম্প্রদায় যে প্রতি বৎসর এক নির্দিষ্ট সময়ে আবীর খেলে অর্থাৎ একে অন্যকে রং ছিটায়, আমাদের মধ্যে যদি কেহ তাহা করে তবে তাহার হুকুম কি হইবে।
এরশাদ করিলেন, ইহা কুফরী। কারণ, তাহারা পরস্পর যে রং ছিটায় ইহা তাহাদের ধর্মীয় কাজ এবং ধর্মের অনুশাসন। আমাদের মধ্যে যে কেহ তাহা করিবে তাহাদের অনুসরণেই করা হইবে। আর যে ধর্মীয় বিষয়ে তাহাদের অনুসরণ করিবে সে কাফের। অধিকন্তু কোন মুসলমান যদি তাহার উপর রং ছিটাইবার অনুমতি দেয় তবে সে কাফের হইবে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেন কুফরী কাজে রাযী থাকিলে কাফের হইবে।
এরশাদ করিলেন, বহু লোক বহু প্রকারে শবে বরাতের অর্থ করিয়াছেন। কেহ বলেন, এই রাতে আল্লাহ তাআলা পুণ্যশীলদিগকে দোযখ হইতে মুক্তি দান করেন এবং দুর্ভাগা পাপীদিগকে বেহেশত হইতে বঞ্চিত করেন। কারণ, পুণ্যবানদের দোযখের সাথে কোন সম্পর্ক নাই।
এক বুযুর্গ বলেন- এই রাতে বাদশাহ যখন রাজস্ব আদায় করেন তখন তিনি বরাত দান করেন। এই শবে বরাতে যখন তিনি তাঁহার বান্দাদিগকে দান করেন তখন দুই প্রকার বরাত দান করেন। মোমেনদিগকে আযাব হইতে বরাত দেন এবং যালেম ও কাফেরদিগকে রহমত ও পুণ্য হইতে বঞ্চিত করেন।
আবার কেহ বলেন, এই রাতে লওহে মাহফুয হইতে ফেরেশতাদের কর্ম- তালিকা আনিয়া তাহাদের নিকট দেওয়া হয়। তাহারা সেই তালিকা মোতাবেক আল্লাহর আদেশ-নিষেধ কার্যকর করিয়া থাকেন। আবার শবে বরাতকে ভাগ্য বণ্টনের রাতও বলা হয়।
বর্ণিত আছে, এই রাতে হযরত জিবরাঈল (আঃ) হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আগমন করিয়া আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক এই রাতের ফযীলত বর্ণনা করেন। তিনি বলিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! এই রাতে আল্লাহ তাআলা তিন হাজার রহমতের দ্বার খুলিয়া দেন। এই রাতে যেব্যক্তি সোবহে সাদেক পর্যন্ত এবাদত-বন্দেগী করে, মেহেরবান আল্লাহ তাহাকে তাঁহার রহমতের জন্য নির্দিষ্ট করিয়া নিরাপদ করিয়া রাখেন। শবে বরাতের ফযীলতের বিষয় হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) জিবরাঈল (আঃ)-এর নিকট শুনিয়া জান্নাতুল বাকী নামক কবরস্থানে গমন করেন এবং সারারাত জাগ্রত থাকেন। অতঃপর তাঁহার উম্মতদিগকে বলেন, এই রাতে তোমরা জাগ্রত থাকিয়া আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করিবে যেন আল্লাহর রহমত হইতে বঞ্চিত না হও।
সকল লোক চলিয়া গেলে আমাকে ডাকিয়া পাঠান। আমি খেদমতে উপস্থিত হইলে তাঁহার মাথার পাগড়ী উঠাইয়া আমার মাথায় পরাইয়া দিলেন। ইহা ছাড়াও অনেক কিছু আমাকে দান করিলেন।
পাপী বান্দা ও দয়ালু আল্লাহ্ (২১) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২১-একাবিংশ মাজলিশ
ছাব্বিশে রবিউল আউয়াল, শুক্রবার। আমি আরয করিলাম, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন- দোযখের আগুনে আমার উম্মতের ভাগ্য এমন যেমন নমরুদের অগ্নিতে ইবরাহীম খলীল (আঃ)-এর ভাগ্য প্রসারিত হইয়াছিল। হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন- কেয়ামতের দিন পাপী উম্মতদিগকে পাপ হইতে পবিত্র করার জন্য দোযখে শাস্তি দেওয়া হইবে। যেমন নমরুদের অগ্নি দ্বারা হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর অপ্রশস্ততা ইত্যাদি প্রশস্তরূপে পাওয়ার ভাগ্য হইয়াছিল। ঠিক তেমনি দোযখের শাস্তিতে পাপী মোমেনদের পাপ দূর হইয়া যাইবে। এই পাপ বেহেশতে প্রবেশ হওয়ার পক্ষে অন্তরায় বা বাধাস্বরূপ। মোমেনের প্রতি এই আযাব ফযীলতের আযাব, ক্রোধের আযাব নহে যেখানে আল্লাহর মেহেরবানী বিদ্যমান সেখানে পাপ কি করিতে পারে? এই উম্মতকে উম্মতী ফযলী বা মর্যদাসম্পন্ন উম্মত বলা হয়। আল্লাহ তাআলার অনন্ত-অসীম মেহেরবানী এই উম্মতের উপর। পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর আল্লাহর এতটা মেহেরবানী ছিল না। পূর্ববর্তী পয়গম্বরগণ নিজ নিজ দেশবাসীকে ইসলাম গ্রহণ করার আমন্ত্রণ জানাইতেন। কেহ ইসলাম গ্রহণ করিয়া মুসলমান হইত আবার কেহ কাফেরই থাকিয়া যাইত। এই মুসলমানই তাহাদের নবীর মৃত্যুর পর ইসলাম ত্যাগ করিয়া কুফরীতে ফিরিয়া যাইত। ইহা হইতেই প্রমাণিত হয় যে, এই উম্মতের প্রতি আল্লাহর যতটা মেহেরবানী, পূর্ববর্তী উম্মতদের উপর ততটা ছিল না। তুমি কি লক্ষ্য করিয়া দেখ নাই যে, যেদিন আমাদের প্রিয় নবীর নিকট অহী অবতীর্ণ হইল এবং দ্বীন ইসলাম প্রচার করার নির্দেশ দেওয়া হইল, সেদিন হইতে তাঁহার আমন্ত্রণে দলে দলে লোক ইসলাম গ্রহণ করিয়া মুসলমান হইতে আরম্ভ করিল। ইহার পর শত শত বৎসর চলিয়া গিয়াছে। কিন্তু মনে হয় তিনি যেন আজও আমাদের মধ্যে বিদ্যমান। এমনিভাবে কেয়ামত পর্যন্ত মুসলমানের সংখ্যা বাড়িতেই থাকিবে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় মাত্র কয়েক হাজার লোক ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিলেন। আর আজ পৃথিবীর সর্বত্র ইসলাম ধর্মের পতাকা উড্ডীন হইয়াছে। উম্মতে মুহাম্মদীর ইহা কত বড় সৌভাগ্য!
আল্লাহ তাআলা অন্যভাবেও উম্মতে মুহাম্মদীর প্রতি অতি করুণাময়। আল্লাহ তাআলা কলমকে নির্দেশ দিলেন লিখ। নূহের উম্মত অমুক পাপ করিবে আর আমি তাহাদিগকে অমুক শাস্তি দিব। মূসার উম্মত অমুক অমুক নাফরমানী করিবে আর আমি এমনভাবে শাস্তি দিব। লুতের সম্প্রদায় এইরূপ অন্যায় করিবে আমি এইরূপ শাস্তি দিব। এইভাবে সমস্ত পয়গম্বরের উম্মতের পাপের তালিকা করিয়া পাশে শাস্তির তালিকাও কলমকে লিখিয়া রাখার নির্দেশ দিলেন।
তারপর খাতেমুন নাবীঈন সাইয়্যেদুল মুরসালীন (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর নাম আসিল। আল্লাহ নির্দেশ দিলেন, লিখ, উম্মতে মুহাম্মদী পূর্ববর্তী উম্মতদের কৃত সকল পাপ করিবে। কলম এতটা লিখিবার পর অপেক্ষায় রহিল দেখি আল্লাহ ইহাদের জন্য কি কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আল্লাহ তাআলা নির্দেশ দিলেন- এই উম্মত পাপী আর আল্লাহ ক্ষমাশীল। আল্লাহ তাআলা আরও এরশাদ করিয়াছেন- আল্লাহ তাআলা সমস্ত পাপ ক্ষমাকারী।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বিদায় হজ্জ ও দুই তিনবার ওমরা করার পর আরাফাত ময়দানে। উপস্থিত হইলেন। সেখানে গিয়া উম্মতের জন্য দোআ করিলেন। আল্লাহ এরশাদ করিলেন-
হে নবীবর! আপনার পাপী উম্মতদিগকে ক্ষমা করুন এবং তাহাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করুন।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) দোআ করিলেন, প্রভু! আপনার হক তো আপনি ক্ষমা করিয়াছেন। কিন্তু বান্দার হকও তো আপনি ক্ষমা করিতে পারেন। হকদারের যে হক আমার উম্মত নষ্ট করিয়াছে এবং যাহা সে পূর্ণ করিতে পারে নাই, আপনার রহমতের ভাণ্ডার হইতে উহা আদায় করিয়া ঋণীকেও ঋণমুক্ত করিতে পারেন। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, তাহাও আমি ক্ষমা করিয়া দিলাম।
পীর ও মুরশিদ বলিলেন, না চাহিতেই যখন তিনি দেন তবে চাহিলে কি না দিবেন? তিনি বাদশাহ, ইচ্ছা করিলে দোজাহানই এক ফকীরকে দান করিয়া দিতে পারেন।
একদিন হযরত জিবরাঈল (আঃ) হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিকট আয়াত- "অতি শীঘ্রই আপনার প্রভু আপনাকে দান করিবেন এবং আপনি সন্তুষ্ট হইবেন" লইয়া আগমন করেন। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মহান প্রভুর এই বাণী শ্রবণ করিয়া আনন্দে আত্মহারা হইয়া বলিলেন, আল্লাহ তাআলা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার পাপী উম্মতদিগকে ক্ষমা না করিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি সন্তুষ্ট হইব না।
কোরআন শরীফে মোমেনদের জন্য যত সুসংবাদ দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে কোন প্রকার শর্ত নাই। বরং সাধারণ ওয়াদা। আর সমগ্র কোরআনে যত আযাবের সংবাদ মোমেন পাপীদের জন্য দেওয়া হইয়াছে তাহা সবই আল্লাহর ইচ্ছার সাথে আবদ্ধ। অর্থাৎ আল্লাহ ইচ্ছা করিলে সবই ক্ষমা করিয়া দিতে পারেন। এমন নহে যে, এই আযাব অবশ্যই হইবে। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন-
"যাহাকে ইচ্ছা আল্লাহ স্বীয় নূর দ্বারা হেদায়াত করেন। ইহা আল্লাহর মেহেরবানী, তিনি বড় মেহেরবান।" ইহা তাঁহার ইচ্ছাধীন, ইচ্ছা করিলে ক্ষমা করিবেন আবার ইচ্ছা করিলে শাস্তি দিবেন। এই ভয়েই শিরদাঁড়া ভাঙ্গিয়া যায়। কিন্তু যেকোন অবস্থায়ই তাঁহার পবিত্র দরবার হইতে নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নাই। আল্লাহ তাআলা বলেন- "আল্লাহর রহমত হইতে কখনও নিরাশ হইও না"। আমি পাপী ! আমি সীমাহীন পাপী। কিন্তু তিনি নিরাশ না হওয়ার যে বাণী এরশাদ করিয়াছেন, তাহাই আমার একমাত্র ভরসা। একদিন এক গ্রাম্য আরব দরবারে নববীতে উপস্থিত হইয়া আরয করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা কাহাকে হিসাব লইতে আদেশ দিবেন? এই প্রশ্ন শুনিয়া হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) চুপ করিয়া রহিলেন। আল্লাহ তাআলা সংবাদ দিলেন, হে বন্ধু ! আমিই আমার বান্দাগণের হিসাব-কিতাব গ্রহণ করিব। অন্য কাহারও যিম্মায় এই দায়িত্ব দিব না। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মনে মনে ভাবিলেন, আমার উম্মতের হিসাব-কিতাব গ্রহণের, দায়িত্ব যদি আমাকে দিতেন তবে তাহাদের পাপের কথা আমি ব্যতীত অন্য কোন লোক জানিতে পারিত না। এরশাদ হইল, "হে বন্ধু! আপনার উম্মতের হিসাব আমিই গ্রহণ করিব, যাহাতে আপনিও তাহাদের পাপের বিষয় অবগত হইতে না পারেন।" প্রেমিক যদি পাপে আবদ্ধ হয় এবং শরাবের প্রতি আসক্ত থাকে, কিন্তু সেই পাপও যদি ক্ষমা পাইতে পারে তবে আর ভয় কিসের? তদুপরি প্রেমাস্পদ যদি পর্দার অন্তরালে থাকে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর মৃত্যুক্ষণ ঘনাইয়া আসিলে আল্লাহর নিকট আরয করিলেন, প্রভু! আমার উম্মতদিগকে আমি কাহার আশ্রয়ে রাখিয়া যাইব? এমন সময় হযরত জিবরাঈল (আঃ) আগমন করিয়া বলিলেন, ইয়া রাসূলে খোদা (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)! আল্লাহ বলেন, আপনার উম্মত আমার দায়িত্বে রাখিয়া আমার নিকট চলিয়া আসুন। তাহা হইলে আপনার পরও আপনার ধর্ম কায়েম থাকিবে। কেয়ামত পর্যন্ত এই ধর্মকে আমি স্থায়ী করিয়া রাখিব। প্রতিদিন ইসলাম বিস্তার লাভ করিবে এবং মুসলমানের সংখ্যা বাড়িতে থাকিবে।
অতঃপর হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবাগণকে ডাকিয়া এরশাদ করিলেন, আমার পর আল্লাহ তোমাদের মধ্যে আমার স্থানে থাকিবেন। তাঁহার নিকট তোমাদিগকে সোপর্দ করিয়া গেলাম।
দাজ্জাল আবির্ভূত হইয়া সমস্ত দুনিয়া ভ্রমণ করার পর মক্কা ও মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হইবে। এই সময় হযরত ঈসা (আঃ) আল্লাহর নির্দেশ মোতাবেক চতুর্থ আসমান হইতে পৃথিবীতে অবতরণ করিবেন এবং অভিশপ্ত দজ্জালকে হত্যা করিবেন। অতঃপর তিনি চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর প্রতিনিধিত্ব করিবেন। দুনিয়াবাসীকে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর ধর্মে দীক্ষিত করিবেন। দুনিয়ার কোথাও কাফের, ইহুদী ও খৃস্টান অবশিষ্ট থাকিবে না। কেহ লুকাইয়া থাকিতে চেষ্টা করিলেও ইট, পাথর এবং গাছ তার স্বরে চিৎকার করিয়া বলিবে: এই ব্যক্তি ইহুদী, ইহাকে হত্যা কর, এই ব্যক্তি খৃস্টান, ইহাকে হত্যা কর। এই ব্যক্তি কপট, ইহাকে হত্যা কর। ইহার পর হযরত ঈসা (আঃ) ইনতেকাল করিবেন। তাঁহার মৃত্যুর পর মুসলমানের সংখ্যা কমিতে কমিতে একেবারে শূন্যের কোঠায় আসিয়া দাঁড়াইবে। বর্ণিত আছে, যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ায় একজন লোকও কালেমা বলার মত থাকিবে ততদিন কেয়ামত হইবে না। যখন একটি লোকও কালেমা তাওহীদ পাঠ করার মত থাকিবে না তখন আল্লাহ তাআলা হযরত ইসরাফীল (আঃ)-কে বলিবেন, এইবার মহাপ্রলয়ের শিঙ্গা বাজাও। হযরত ইসরাফীল (আঃ)-এর প্রথমবার শিঙ্গা বাজানোর সাথে সাথে সমস্ত সৃষ্টি বিলীন হইয়া যাইবে। দ্বিতীয়বার শিঙ্গা বাজানোর পর আবার সব কিছু জীবিত হইয়া উঠিবে। সোবহানাল্লাহ! আল্লাহ কত বড় কুদরতের অধিকারী! একই শিঙ্গা একবার ফুঁকিলে সব কিছু ধ্বংস হইয়া যাইবে। আবার দ্বিতীয়বার ফুঁকিলে সব কিছু পুনর্জীবিত হইবে।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, হযরত ! কেয়ামত কি বস্তু এবং কাহাকে বলে? এরশাদ করিলেন, প্রথমবার শিঙ্গা ফুঁকার নাম কেয়ামত এবং দ্বিতীয়বার ফুঁকার নাম হাশর। এই দুইবার শিঙ্গা ফুঁকার আওয়ায প্রতিটি প্রাণীর কানে এমনভাবে পৌঁছিবে যেন প্রত্যেকের কানেই একটি করিয়া শিঙ্গা বাজানো হইতেছে। দুইবার শিঙ্গা ফুঁকার মধ্যে চল্লিশ বৎসরের ব্যবধান হইবে। এই চল্লিশ বৎসর সকলেই মৃতাবস্থায় থাকিবে। ফেরেশতাদের মৃত্যু মানুষের মৃতুর ন্যায় হইবে না। তাহাদের মৃত্যু ঘুমের ন্যায় হইবে। দৈত্য-দানব এবং শয়তানের কেয়ামত ব্যতীত আর মৃত্যু নাই; বরং প্রতিদিন ইহাদের সংখ্যা বাড়িতেই থাকে। কিন্তু জ্বিনদের জন্ম-মৃত্যু আছে। হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর সময় দানব, দৈত্য এবং শয়তান মাত্রারিক্ত অবাধ্য হইয়া পড়িয়াছিল। তিনি ভাবিলেন, আমার জীবদ্দশায়ই যখন ইহারা এত অত্যাচারী হইয়া উঠিয়াছে, আমার পর ইহারা মানুষকে শান্তিতে থাকিতে দিবে না। তাই তিনি সকলের হাতে-পায়ে বেড়ি লাগাইয়া দ্বীপে দ্বীপে কয়েদ করিয়া রাখিলেন। কোন কোন কিতাবে লিখিত আছে, শেষ যমানায় ইহারা মুক্ত হইয়া যাইবে। লোকদের ক্ষতি সাধন করিবে। কাহারও উপর একবার চড়াও হইয়া বসিলে কোন মতেই আর দূর করা যাইবে না। আজকাল দেখা যায়, দেও-দৈত্য কাহারও উপর চড়াও হইলে কোন মতেই দূর করা সম্ভবপর হইয়া উঠে না।
প্রথম- কাহারও উপর অত্যাচার না করা। অত্যাচার-উৎপীড়ন খুবই খারাপ কাজ। দ্বিতীয়- ইসলামের শুকরিয়া আদায় করা। তৃতীয়- ঈমান চলিয়া যাওয়ার ভয় করা। এই গুণাবলী কাহারও মধ্যে দেখিলে মনে করিবে, তাহার পরিণাম আল্লাহ চাহে ত অবশ্যই ভাল হইবে। যদি কেহ অত্যাচারী হয়, মুসলামান হওয়ার শুকরিয়া আদায় না করে এবং ঈমান চলিয়া যাওয়ার ভয় না থাকে, তবে মনে করিবে তাহার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। আল্লাহর শুকরিয়া যে, আমাদের এই যুগে আমরা শুনি নাই আমাদের প্রিয় নবীর উম্মতের মধ্যে অমুক ব্যক্তির পরিণতি খারাপ হইয়াছে।
পক্ষান্তরে বনী ইসরাঈলের বুযুর্গদের মধ্যে- যেমন- বালআম বাউরা এমন এক বুযুর্গ ছিল, যে আকাশের দিকে মাথা উত্তোলন করিলে আরশ এবং মাথানত করিলে তাহতাসারা দেখিতে পাইত। তাহার পরিণতি ভয়ানক খারাপ হইয়া গিয়াছিল।
আশেকের দল মায়ের উদর হইতে আরম্ভ করিয়া সারাজীবন কঠিন পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে অতিবাহিত করেন। কারণ, তাহারা জানেন না পরিণতি কি হইবে? যদি ভাল হয় তবে প্রতিশ্রুত সকল কিছুই তাঁহারা পান। আর যদি খারাপ হয় এবং ভাগ্যের লিখিত বস্তু প্রকাশ পায়, তবে তাহাতে ইহকাল পরকাল উভয়ই নষ্ট হইয়া যাইবে। অর্থাৎ কঠোর শাস্তি ভোগ করিতে হইবে।
মহব্বত 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
পঁচিশে রবিউল আউয়াল, বৃহস্পতিবার। আমরা অনেকেই হুজ্জাতুল ইসলামের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। তিনি বিশেষ কোন কারণে তখনও দরবারে উপস্থিত হইতে পারেন নাই। মহব্বত বা খোদা প্রেম সম্বন্ধে আমরা আলাপ-আলোচনা করিতেছিলাম। এমন সময় তিনি দরবারে উপস্থিত হইয়া সকলকে সালাম করিলেন। আমরা সকলেই সালামের উত্তর দিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। তিনি সকলের দিকে চাহিয়া হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করিলেন, দরবেশগণ কি সম্বন্ধে আলাপ করিতেছিলেন? আমি বলিলাম, খোদা প্রেম সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।
তিনি এরশাদ করিলেন, ভাইসব! খোদা প্রেম বা মহব্বতের সাতটি সোপান বা স্তর রহিয়াছে। ইহার সর্বপ্রথম স্তর হইল বিপদে ধৈর্যাবলম্বন করা। অর্থাৎ বন্ধুর পক্ষ হইতে যে বিপদ অবতীর্ণ হয় তাহা প্রশান্ত চিত্তে বরণ করিয়া ধৈর্যাবলম্বন করা।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, মহব্বত এমনই একটি স্তর যেখানে শুধু ঐ সমস্ত প্রেমিকই পদ স্থাপন করিতে পারেন যাহারা বন্ধুর মহব্বত ব্যতীত আর কিছুই দেখিতে পান না। সাথে সাথে অন্যান্য যাবতীয় কিছু হইতে দূরে সরিয়া থাকেন।
একবার হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) প্রেমের জগতে বন্ধুর দরবারে একাকী উপবিষ্ট ছিলেন। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করিলেন, বায়েজীদ! বন্ধু বন্ধুর সাথে সাক্ষাত করিতে আসিলে নিশ্চয়ই কিছু লইয়া আসে। তুমি আমার জন্য কি উপঢৌকন আনিয়াছ?
হযরত বায়েজীদ (রঃ) বিনীতভাবে আরয করিলেন, মহব্বত এবং আপনার সন্তুষ্টি। আপনার বন্ধুগণ বলেন, এই দুইটি বস্তুই নাকি আপনার পছন্দনীয়।
আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, উপঢৌকনস্বরূপ তুমি উপযুক্ত বস্তুই সাথে লইয়া আসিয়াছ, ইহা আমার খুবই পছন্দনীয়।
একবার হযরত রাবেয়া বসরী আল্লাহর দরবারে বার বার সেজদা করিতেছিলেন আর বলিতেছিলেন, হে মাবুদ ! আমি যদি দোযখের ভয়ে আপনার এবাদত-বন্দেগী করি তবে আমাকে দোযখের অতল তলে নিক্ষেপ করিয়েন। আর যদি বেহেশতের লোভে আপনার অরাধনা-উপাসনা করি তবে বেহেশত আমার জন্য হারাম করিয়া আমাকে দোযখের ইন্ধন করিয়েন। আর যদি আপনার মহব্বতে আপনার জন্যই এবাদত করি তবে পরকালে আপনার দর্শন লাভ হইতে আমাকে বঞ্চিত করিয়েন না।
তিনি বলিলেন, যেব্যক্তি লোভ-লালসার মোহে পতিত হইয়া স্বীয় অন্তকরণকে নিষ্প্রভ করে, তাহাকে লানতের কাফন পরিধান করাইয়া লজ্জার যমীনে সমাধিস্থ করা হয়। খোদা প্রেমিক একমাত্র খোদা ব্যতীত অন্য আর কোন কিছুতেই শান্তি পাইতে পারেন না। খোদা প্রেমিক যতক্ষণ পর্যন্ত লোক সংস্রব পরিত্যাগ না করে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রেমাস্পদের নৈকট্যলাভে সমর্থ হয় না। বন্ধুকে শত্রু, পরিবার-পরিজনকে ইয়াতীম মনে না করা পর্যন্ত বন্ধুর সান্নিধ্য লাভ হইতে বঞ্চিত থাকে।
তারপর তিনি এরশাদ করিলেন, খোদা প্রেম ও খোদা-ভীতি এই দুইটি বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িত। একটি ব্যতীত অন্যটি সাধন হয় না। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে- "যাহার মধ্যে আল্লাহর ভয় নাই সে মুসলমান নহে। তাই যে খোদাভীরু সে-ই প্রকৃত মুসলমান।" যেব্যক্তি রোযা রাখার জন্য কম খায় নামায পড়ার জন্য কম কথা বলে এবং এবাদত করার জন্য কম ঘুমায়, সে-ই খোদাভীরু। এই তিনটি গুণ যাহার মধ্যে নাই, সে কখনও খোদাভীরু হইতে পারে না।
দরবেশের মধ্যে ইহা ব্যতীত আরও তিনটি গুণ বেশী থাকিতে হইবে।প্রথম- ভয়। অন্তরে ভয় থাকিলে পাপ হইতে বিরত থাকা যায় এবং দোযখের আগুন হইতে মুক্তি পায়। দ্বিতীয়- খোদার প্রতি সন্তুষ্টি। ইহা এবাদত-বন্দেগী করিতে লোককে উৎসাহ দান করে, আসক্তি জন্মায়। ফলে উচ্চ মর্যাদা এবং বেহেশত প্রাপ্ত হয়। তৃতীয়- মহব্বত। অর্থাৎ খারাপ কাজ পরিতাগ করা। ইহাতে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়।
খোদার ভয়ে এক যুবকের দেহ অস্থিসর্বস্ব হইয়া পড়িয়াছিল। যুবক এশার নামাযের পর গলায় রশি লাগাইয়া নিজেকে কড়ি কাঠের সাথে বাঁধিতেন এবং সারারাত দাঁড়াইয়া আল্লাহর নিকট কান্নাকাটি করিতেন আর বলিতেন, হে আমার আল্লাহ মহান ! কেয়ামতের দিন যখন আমার অগণিত পাপ লোকের সম্মুখে প্রকাশ করা হইবে তখন আমি কিভাবে মুখ দেখাইব? কিছুদিন পর তিনি অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। তিনি বালিশের পরিবর্তে এক খণ্ড ইট মাথার নিচে দিয়া শুইয়া বৃদ্ধা মাতাকে ডাকিয়া বলিলেন, মা ! আমি মৃত্যুবরণ করিলে আমার গলায় রশি বাঁধিয়া বাড়ীর চারিদিকে ঘুরাইবেন এবং বলিবেন, এই ব্যক্তি তাহার মহান প্রভু হইতে পালাইয়া ফিরিত, তাই সে এইরূপ শাস্তি পাওয়ার যোগ্য। দ্বিতীয়ত- আমার জানাযা রাতের অন্ধকারে বাহির করিবেন যেন লোকে না দেখে। কারণ, যে দেখিবে সে-ই আমার কথা স্মরণ করিয়া পরিতাপ করিবে। তৃতীয়ত- আমাকে দাফন করার পর আপনি আমার কবরের পাশে বসা থাকিবেন। হয়ত আপনার পদধূলির বরকতে আল্লাহ আমার শাস্তি কমাইয়া দিতে পারেন।
যুবকের মৃত্যুর পর মা তাহার গলায় রশি লাগাইতে উদ্যত হইতেই আওয়ায হইল, হে বৃদ্ধা ! আমার বন্ধু আমার সান্নিধ্যে পৌঁছিয়া গিয়াছে। আল্লাহর বন্ধুর সাথে কি কেহ এমন ব্যবহার করে? সে আমার বন্ধু, আমি তাহাকে ক্ষমা করিয়াছি।
একজন বুযুর্গ আল্লাহর ভয়ে এত ক্রন্দন করিতেন যে, চোখের পানি পড়িতে পড়িতে তাঁহার গালের চামড়া এবং গোশত উধাও হইয়া গিয়াছিল। লোকে বলে. তাঁহার গোশতবিহীন গালে টুনটুনি পাখি বাসা বাঁধিয়াছিল। অথচ তিনি আল্লাহর ভয়ে এত ভীত-সন্ত্রস্ত ছিলেন যে, পাখির আসা যাওয়ার কোন খবরই রাখিতেন না। তিনি যখন কেয়ামত ও কবরের ভীষণ অবস্থার কথা শুনিতেন তখন ভয়ে মাছের ন্যায় ছটফট করিতেন। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তাঁহার এই অবস্থা ছিল
অতঃপর পীর ও মুরশিদ তাওয়াক্কোল বা আল্লাহর প্রতি ভরসা রাখা সম্বন্ধে এরশাদ করিলেন, জ্ঞানবান ব্যক্তিগণ যেকোন অবস্থায় আল্লাহর উপর ভরসা করিয়া থাকেন। অন্যের প্রতি তাহাদের কোন ভরসা থাকে না। আল্লাহ তাআলা বলেন-
এবং তাঁহারই উপর মোমেনদের ভরসা কর। উচিত।
একবার হযরত রাবেয়া বসরী হজ্জ করার উদ্দেশে একটি গাধায় আরোহণ করিয়া মক্কার পথে রওয়ানা হন। এক নির্জন মরুভূমিতে পৌছার পর তাঁহার একমাত্র বাহন গাধাটি মারা যায়। ফলে তাঁহার আসবাবপত্র এদিক-সেদিক ছড়াইয়া পড়িয়া থাকে। সে পথে এক কাফেলা মক্কায় হজ্জ করিতে যাইতেছিল। তাহারা হযরত রাবেয়াকে চিনিতে পারিল এবং তাঁহার অসহায় অবস্থা দেখিয়া কিছুসংখ্যক লোক আসিয়া বিনীভাবে বলিল, আপনি যদি অনুমতি দেন তবে আমরা আপনার আসবাবপত্র আমাদের বাহনে উঠাইয়া লই এবং আপনিও আমাদের সাথে চলুন।
হযরত রাবেয়া গর্জিয়া বলিলেন, আমি তোমাদের উপর ভরসা করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হই নাই। আমি যাঁহার উপর ভরসা করিয়া গৃহত্যাগ করিয়াছি তিনি আমাকে সেখানে পৌছার ব্যবস্থা করিয়া দিবেন। কাফেলা চলিয়া গেল। হযরত রাবেয়া তখন আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া বলিলেন, হে আল্লাহ! আমি কি লোকের উপর ভরসা করিয়া বাড়ী হইতে বাহির হইয়াছিলাম যে, তুমি আমার সাহায্যার্থ লোক পাঠাইয়াছ? তুমিই তো আমার একমাত্র ভরসার পাত্র। সুতরাং জনমানবহীন এই মরুভূমিতে তুমি কেন আমাকে এই বিপদে ফেলিলে? তাঁহার মুখের কথা শেষ না হইতেই মৃত গাধাটি গা ঝাড়া দিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। হযরত রাবেয়া গাধার পিঠে মালপত্র উঠাইয়া রওয়ানা হইলেন।
যোহরের আযান হইল। সকলে উঠিয়া মসজিদে রওয়ানা হইলাম।
__
-
৬ই রজব হযরত খাজা গরীব নেওয়াজ মঈনুদ্দিন চিশতী আজমীরী (রহঃ)-এর ওফাত দিবশ -------------------------- #রসুল_সঃ_এর_সুন্নত_ই_আদর্শ ========...
-
পবিত্র ফাতিহা-ই-ইয়াজদহম ---------------------- #রসুল_সঃ_এর_সুন্নত_ই_আদর্শ ---------------------- #ফাতিহা_ইয়াজদহম ১১ই রবিউস সানী অর্...
-
তাওবাতান নাসূহা # রসুল_সঃ_এর_সুন্নত_ই_আদর্শ ----------------------------- # _তাওবাতান_নাসূহা আল্লাহ বলেন, ইয়া আইয়ুহাল্লাজীনা আমানু তূবূ ই...
-
হাদিসে সাকালাইন #রসুল_সঃ_এর_সুন্নত_ই_আদর্শ #হাদিসে_সাকালাইন বা #দুটি_ভারী_জিনিষ আল্লাহ্ রব্বুলআলামিন বলেন, "এবং সত্যকে মিথ...
-
📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) ৮/ অষ্টম মজলিস পীরের পরিচয় একাদশ রবিউল আউয়াল, বৃহস্পতিবার। দরবার শরীফে প্রকৃত পীরের গুণাবলী সম্বন্...
-
📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) 4 চতুর্থ মাজালিস সুলুক এবং আহলে সুলুক- ঊনত্রিশে সফর, রবিবার। উপস্থিত মুরীদ ও ভক্তদের উদ্দেশে হুজ্...
-
📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) ৩ - তৃতীয় মজলিস ইলম ও আমল আটাশে সফর শনিবার। দরবার শরীফে ইলম ও আমল সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল হ...
-
📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ) ১ - প্রথম মজলিস ওলীদের কাশফ ও কারামত– ১ ছাব্বিশে সফর, বৃহস্পতিবার। পবিত্র দরবারে বহু আলেম-ওলামা এ...