📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২৩- ত্রয়োবিংশ মজলিস
শরীয়ত ও হাকীকত
আঠাশে রবিউল আউয়াল, রবিবার। খানকা শরীফে উপস্থিত মুরীদদের মধ্য হইতে কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন,
আঠাশে রবিউল আউয়াল, রবিবার। খানকা শরীফে উপস্থিত মুরীদদের মধ্য হইতে কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন,
শরীয়ত ও হাকীকত কি? ইহার অর্থই বাকি?
এরশাদ করিলেন, হাকীকত এই যে, তাহাতে কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন জায়েয নাই। হযরত আদম (আঃ) হইতে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত ইহার ব্যতিক্রম হইবে না। যেমন- আল্লাহর মারেফাতের হাল বা অবস্থা।
শরীয়তে রদবদল জায়েয। শরীয়তের আদেশ-নিষেধ রদবদল হইয়া থাকে। শরীয়তের আভিধানিক অর্থ মুসলমানদের পথ ও মত।
এরশাদ করিলেন, হাকীকত এই যে, তাহাতে কোন প্রকার পরিবর্তন পরিবর্ধন জায়েয নাই। হযরত আদম (আঃ) হইতে পৃথিবী ধ্বংস হওয়া পর্যন্ত ইহার ব্যতিক্রম হইবে না। যেমন- আল্লাহর মারেফাতের হাল বা অবস্থা।
শরীয়তে রদবদল জায়েয। শরীয়তের আদেশ-নিষেধ রদবদল হইয়া থাকে। শরীয়তের আভিধানিক অর্থ মুসলমানদের পথ ও মত।
কাযী সাহেব আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তবকায়ে ওয়াক্ত এবং হাল কাহাকে বলে?
এরশাদ করিলেন, একই সময়ে অতীত এবং বর্তমান হইতে অজ্ঞাত হইয়া যাওয়া। এই অবস্থা কাহারও মধ্যে সৃষ্টি হইলে তাহাকে ওয়াক্ত বলে। ঐ সময় যদি কেহ অন্য পথে অতিক্রম করে এবং ঐ পথকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করিয়া ওয়াক্তকে স্থায়ী ও আরামদায়ক করে তবে তাহাকে হাল বলা হয়।
কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন, তামকীন ও মাকাম কাহাকে বলে?
এরশাদ করিলেন, লক্ষ্যস্থলে পৌঁছিয়া যদি আরাম পায় তবে তাহাকে তামকীন বলে। যেমন- নদী ও সাগরের পানি সর্বদিকে চঞ্চলতার সাথে প্রবাহিত হইয়া থাকে। কিন্তু সমুদ্রে পৌছার পর সমস্ত চঞ্চলতা হারাইয়া আরামে নিশ্চুপ থাকে। স্রোতধারায় চঞ্চলতা থাকিলেও সমুদ্রে পৌছিয়া স্থির হইয়া যায়। নদী একটি স্রোতধারা বুকে করিয়াই শব্দ করে; আর সমুদ্র হাজার নদী বুকে ধারণ করিয়াও চুপ থাকে।
যখন কাহারও দ্বারা কোন অন্যায় সংঘটিত হইয়া পড়ে, সে যদি কান্নাকাটি করিয়া তওবা করে আর বলে-
"হে আমার প্রভু ! আমি আমার নফসের প্রতি বহু যুলুম করিয়াছি। আমায় ও আমার পাপকে ক্ষমা করুন। কারণ, আপনি ব্যতীত পাপ ক্ষমাকারী আর কেহ নাই"। ইহাকে মাকাম বলা হয়। যেমন- হযরত আদম (আঃ) ভুল করার পর তিন শত বৎসর পর্যন্ত তওবা ও কান্নাকাটি করিয়াছিলেন আর বলিয়াছিলেন-
"হে প্রভু ! আমি আমার নফসের উপর যুলুম করিয়াছি। যদি আপনি ক্ষমা না করেন, দয়া না করেন তবে আমি ধ্বংস হইয়া যাইব"।
মোটকথা, মোমেনের কর্তব্য কোন অবস্থায়ই পাপ না করা। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলিকে মূল্যবান মনে করিয়া সর্বক্ষণ তওবা-এস্তেগফার করিতে থাকিবে। বুযুর্গগণ বলেন,
হে বৃদ্ধ পাপী ! তওবার দ্বার উন্মুক্ত। নানা প্রকার নেয়ামত তোমার জন্য তৈয়ার। তাড়াতাড়ি তওবা কর। কারণ, বিলম্বে তোমার ক্ষতির উপর ক্ষতিই হইবে।
হে ভ্রাত! এই সুফী সম্প্রদায় প্রতিটি বস্তু এবং প্রতিটি স্থানের জন্য একটি নাম ও একটি পরিভাষা নির্দিষ্ট করিয়া লইয়াছেন, যাহা একমাত্র এই সম্প্রদায়ের লোকই বুঝিতে সক্ষম। যে বুঝার সে বুঝে আর যে না বুঝার সে অবুঝ থাকে।
কাযী যাহেদ আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, এমন কেন করা হইল আর এমন কেন হইল না, এই প্রশ্ন করার বান্দার অধিকার আছে কি?
এরশাদ করিলেন, এই ভাবের কোন কথা বলার অধিকারই বান্দার নাই। আল্লাহ ঘোষণা করিয়া দিয়াছেন, তাঁহার কাজ সম্বন্ধে প্রশ্ন করার কাহারও কোন অধিকার নাই। কাহার ক্ষমতা আছে যে তাঁহার কারখানার দিকে ফিরিয়া তাকায়, তাঁহার কাজ সম্বন্ধে মুখ খোলে। আল্লাহ যাহা ইচ্ছা করেন এবং যাহা ইচ্ছা আদেশ করেন। কবি ঠিকই বলিয়াছেন- (ভাবার্থ) "কাহার এত বড় সাহস যে, তোমার প্রতাপের সামনে মাথানত করা ব্যতীত মুখ খোলার সাহস পায়"।
ইহা অমুখাপেক্ষীর দরবার। কাহারও কিছু জিজ্ঞাসা করার হক নাই। যাহাকে গ্রহণ করার বিনা কারণেই করিয়াছেন এবং যাহাকে প্রত্যাখ্যান করার বিনা কারণেই প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন। যাহা ইচ্ছা করেন কথার ইহাই রহস্য।
কোন কবি বলিয়াছেন- (ভাবার্থ) "অনাদিকালে কি নির্ধারণ করা হইয়াছে আমি কিছুই জানি না। কাহার পরিণতি গ্রহণযোগ্য তাহাও জানি না। তোমার কার্যাবলী কেহই অবগত নহে। তোমার অমুখাপেক্ষিতাকে ভয় না পায় এমন কে আছে"?
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, যাহা সহ্য করার বা মোকাবিলা করার ক্ষমতা নাই তাহা হইতে পশ্চাদপসরণ কি পয়গম্বরদের সুন্নত।
এরশাদ করিলেন, হাঁ! হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর পক্ষে যখন মক্কায় বসবাস করা অসম্ভব হইয়া উঠিল তখন তিনি হযরত আবু বকরকে সাথে লইয়া মদীনার পথে হিজরত করিলেন। তিনি চলিয়া যাওয়ার সাথে সাথেই তাঁহার শত্রুগণ পিছনে ধাওয়া করিল। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ও হযরত আবু বকর পর্বত গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। গুহা মুখে মাকড়সা জাল বুনিয়া রাখিল। শত্রুরা গুহা মুখে মাকড়সার জাল দেখিয়া মনে করিল- ইহার মধ্যে কোন লোক যাইতে পারে না। তাহারা বিফল মনোরথ হইয়া ফিরিয়া গেল।
হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) গুহা হইতে বাহির হইয়া মদীনার পথে রওয়ানা হইলেন এবং নিরাপদে মদীনায় উপস্থিত হইলেন। এই কাহিনী বলার উদ্দেশ্য এই যে, কোন কিছুর মোকাবিলা করায় অসমর্থ হইয়া পশ্চাদপসরণ করা যে সুন্নত, ইহাই তাহার প্রমাণ।
তারপর আবার জিজ্ঞাসা করিলেন, বালা-মসিবত দেখিয়া পলায়ন করাও কি সুন্নত?
এরশাদ করিলেন, হাঁ! ইহাও পয়গম্বরদের সুন্নত। হযরত মূসা (আঃ)-এর প্রতি নির্দেশ আসিল-
আল্লাহ বলিলেন, হে মূসা! লাঠি মাটিতে ফেলিয়া দাও। লাঠি ফেলিয়া দিতেই উহা ধাবমান সাপে পরিণত হইল। লাঠি সাপ হইয়াই হযরত মূসা (আঃ)-কে আক্রমণ করিত উদ্যত হইল। তিনি ভয়ে দৌড় দিলেন।
আল্লাহ পাক এরশাদ করিলেন, উহা ধর এবং ভয় করিও না। উহা আসল আকৃতিতে ফিরিয়া আসিবে। হযরত মূসা (আঃ) ধরিতেই উহা পূর্ববর্তী রূপ লাঠিতে রূপান্তরিত হইল।
সুতরাং দেখা গেল, বিপদ দেখিয়া মূসা (আঃ) ভাগিয়াছিলেন। অন্যান্য পয়গম্বরের জীবনেও এমন নিদর্শন রহিয়াছে। সুতরাং ইহাও পয়গম্বরদের সুন্নত। কেহ যদি ধৈর্যধারণ না করে, আল্লাহর সিদ্ধান্তে রাযী না থাকে, তাহার সম্বন্ধে নিম্নরূপ ধমক আসিয়াছে-
"নিশ্চয় আমিই আল্লাহ। আমি ব্যতীত কোন আল্লাহ নাই। আমার কাজে যে সন্তুষ্ট নহে; আমার দেওয়া বিপদে যে ধৈর্যধারণ না করে এবং যে আমার নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে, সে যেন আমার রাজ্য হইতে চলিয়া যায় এবং আমা ব্যতীত অন্যকে প্রভু হিসাবে গ্রহণ করে।" তারপর বলিলেন, বিপদ দেখিয়া পলায়ন করার আদেশ আছে এবং ইহা ধৈর্যের প্রতিবন্ধক নহে। বিপদে ধৈর্যধারণ কাহাকে বলে জান? বিপদ আসিলে অসন্তুষ্ট না হওয়াই ধৈর্যধারণ। খোদা প্রেমিকদের যত বিপদই আসে তাঁহারা সাদরে গ্রহণ করেন এবং হাসিমুখে বিপদের তিক্ততা বরণ করিয়া লন; বরং আরও বিপদ আসার অপেক্ষায় থাকেন এবং বলেন-
"একটিই তো মাত্র প্রাণ আমার, যে তোমার প্রেমের বোঝা বহন করিবে। যতক্ষণ তোমার কাজ না আসে পশ্চাদপসরণের নাম নাই। তোমার প্রেমে যে বিপদ জীবনের উপর আসে তখন তো এই আশা যে, একের পরিবর্তে যেন হাজার বিপদ আসে।"
------------
No comments:
Post a Comment