📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
১৭- সপ্তদশ মাজালিশ
নফস
বাইশে রবিউল আউয়াল, সোমবার। নফসের দোষ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।
পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, আল্লাহ তাআলা নফসকে পয়দা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর পরিচয় কি? নফস বলিল- আমি আমি, তুমি তুমি।
ইহার পর আল্লাহ তাআলা নফসকে অনাহারে রাখিয়া শাস্তি দিলেন। নফস ক্ষুধায় কাতর হইয়া পড়িল।
এইবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর পরিচয় কি?
নফস বলিল,
খোদাওয়ান্দ! তুমি আমার শক্তিশালী মালিক। আমি তোমার দুর্বল দাস।
এখন চিন্তা করিয়া দেখ যে, ক্ষুধা কেমন বস্তু। নাফরমানকেও আল্লাহর বন্দেগী করায়, তাঁহার সম্মুখে মাথানত করিতে বাধ্য করে। এই ধোঁকাবাজ নফস ক্ষুধার শাস্তি পাওয়া ব্যতীত আর কিছুতেই মাথানত করে না। আমাদের নফস ফেরআউনের অবাধ্য নফসের ন্যায় গর্বিত এবং মাথা উত্তোলন করিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু ফেরআউনের নফস প্রকাশ্যভাবে বলিত- "আমি তোমার মহান প্রভু"। আর আমাদের নফস অতি সংগোপনে বলে, আমি তোমাদের মহান প্রভু। আমিত্বের এই দাবী প্রত্যেক নফসই করিয়া থাকে। পার্থক্য এতটা যে. ফেরআউনের দাবী ছিল প্রকাশ্য। ইহার কারণ এই যে, ফেরআউন কাহাকেও ভয় করিত না। সেই যুগে তাহার চেয়ে প্রভাবশালী আর কেহ ছিল ন! যে তাহার ক্ষতিসাধন করিতে পারে। তাই যাহা কিছু বলার সর্বজনসমক্ষে এবং প্রকাশ্যেই বলিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"হে নবীবর ! আপনি কি তাহাদের অবস্থা লক্ষ্য করেন নাই যাহারা তাহাদের নফসকে স্বীয় খোদায় পরিণত করিয়াছে।"
শয়তান সাত হাজার বৎসর খোদার এবাদত-বন্দেগী করিয়া পরিশেষে নফসের বান্দায় পরিণত হইল। আল্লাহর এবাদত পরিত্যাগ করিয়া নফসের তাবেদার হইল। আল্লাহ যখন তাহাকে বলিলেন, আদমকে সেজদা কর। তখন সে বলিয়া উঠিল, আমি আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছ। নফস তাহার উপর বিজয়ী হওয়ায় সে আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য হইয়া আদমকে সেজদা করিল না, কাফের হইয়া গেল। কোরআন বলে, "সে গর্বভরে অস্বীকার করিয়া কাফের হইল।" নফসের একটি নির্দেশ পালন করিয়া হাজার হাজার বৎসরের সাধনা নষ্ট করিয়া ফেলিল। চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হইয়া আল্লাহর দরবার হইতে বাহির হইয়া আসিল। হাজার হাজার বৎসর এবাদত করার পরও গলায় লানতের বেড়ি পরাইয়া দেওয়া হইল। তাহার কপালে কলঙ্কের টিকা এইভাবে লাগাইয়া দেওয়া হইল-
"আমার লানত তোমার উপর কেয়ামত পর্যন্ত থাকিবে।" নফসে আম্মারাকে আয়ত্তে আনা এবং দুর্বল করার জন্যই সমস্ত বুযুর্গ রিয়াযত মুজাহাদার আগুনে দগ্ধ হইয়াছেন। নফসকে দমন ও ঘৃণিত করিয়া রাখার জন্যই তাঁহারা মোটা কম্বল আর খেরকা পরিধান করিতেন। তাই যদি কোন সময় তুমি তোমার নফসের উপর ক্রোধ প্রকাশ কর তবে নফসের দোষ তোমা হইতে দূর হইয়া যাইবে। এই সময় নফসকে অগ্নিকুণ্ডের উপর রাখিয়া দাও। ফলে নফস সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়া তোমার দেহ নূরের আলোকে আলোকিত হইয়া উঠিবে।
নফসকে দমন ও দুর্বল করার মানসেই আল্লাহর নবীগণ ক্ষুধার্ত থাকিতেন, দরিদ্রতা পছন্দ করিতেন। তাঁহারা নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও এক মুহূর্তের জন্যও নফস হইতে নির্ভয় থাকিতেন না। তাঁহারা আল্লাহর নিকট রাজত্ব বা ধন-সম্পদ কামনা করিলে অবশ্যই পাইতেন। কিন্তু তাহা কামনা করেন নাই। রাজ্য ও সম্পদে মুক্তির আলো দেখেন নাই। বরং তাহাতে নফসের আধিপত্যই দেখিয়াছিলেন। তাহাতে মুক্তির চেয়ে বন্দীত্বকেই বেশী দেখিতে পাইতেন। দরিদ্রতা ও অনাহারে থাকার মধ্যেই মুক্তি ও পরকালে সফলকাম হওয়া নিহিত রহিয়াছে। নফসের পূজা করা আমাদের জন্য নহে। আমরা এবং আমাদের মযহাব অন্য কিছু।
বর্ণিত আছে, স্বেচ্ছায় দরিদ্রতাবরণ ও অনাহারে থাকার অবস্থা এতটা ছিল যে, একাদিক্রমে দুই তিন দিন হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঘরে রান্নাবান্নার কোন ব্যবস্থা থাকিত না। আবার কখনও তৈলের অভাবে পবিত্র গৃহ প্রদীপের আলোকে আলোকিত হইত না।
আল্লাহর বান্দার উপর আল্লাহর পক্ষ হইতে যে বিপদ অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তাআলা সেই বিপদের মধ্যে মেহেরবানীর এক বিরাট ভাণ্ডার লুক্কায়িত রাখেন।
অবাধ্য নফসের বিরুদ্ধে শেকায়েত সম্বন্ধে সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) হইতে একটি রেওয়ায়েত আছে, তিনি বলিতেন, কাল কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করিব যে, হে খোদা ! আমাকে দোযখে প্রবেশ করার অনুমতি দেন। যে কাফের নফস দুনিয়ায় অন্তরের রক্ত প্রবাহিত করাইয়াছে, আজ আমি উহাকে ক্রোধের অগ্নি দ্বারা জ্বালাইয়া দিব।
বর্ণিত আছে, পাক পবিত্র-থাকা সত্ত্বেও হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছিলেন, আমি আমার নফসকে পরীক্ষা করিয়া দেখিব, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট কিনা? দেখিলেন, নফস স্বভাবে ঠিক একই আছে। তিনি ধারণা করিলেন, সমস্ত পৃথিবীর বাদশাহ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হইতে নফস পিছপা নহে। তাই তিনি সীমাহীন বাদশাহী দ্বারাই নফসকে যাচাই করিতে চাহিয়া প্রার্থনা করিলেন- "হে আল্লাহ! আমাকে এমন রাজত্ব দান কর যেন আমার পর আর কেহ তেমন বিশাল রাজত্বের অধিকারী না হইতে পারে। নিশ্চয়ই তুমি দানকারী"।
আবার কোন কোন তাফসীরকার বলেন, বাদশাহী চাওয়ার অর্থ, তিনি খুব যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন এবং যুদ্ধ ব্যতীত দেশ জয় লাভ করা যায় না। যুদ্ধ করার জন্য রাজত্ব কামনা করিয়াছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁহাকে সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র বাদশাঃ করিয়াছিলেন।
হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর একহাজার স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর যাহাদিগকে বিবাহ করেন তাঁহাদের সংখ্যাই ছিল সাত শত। অবশিষ্ট তিন শত কুমারীর পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন।
এতসংখ্যক বিবাহ করার উদ্দেশ্য ছিল বহু সন্তান লাভের আশা। এই সন্তানগণই যেন তাঁহাকে যুদ্ধে সাহায্য করিতে পারে। বায়ু তাঁহার সিংহাসন বহন করিত। বহুদূর পর্যন্ত মানব সৈন্য ছড়াইয়া থাকিত। পরী, জিন ও পক্ষীকুল পলক মেলিয়া এই সৈন্যবাহিনীকে সূর্য তাপ হইতে ছায়া দান করিত।
এই সৈন্যদের রসদপত্র ও অন্যান্য আসবাবপত্র দেও-দৈত্যগণ যথাস্থানে মুহূর্তের মধ্যে পৌছাইয়া দিত। সমুদ্র হইতে মণি-মুক্তা উঠাইয়া আনিত। সারা পৃথিবীতে হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োজিত ছিল। যেখানে যাহা কিছু শুনিত বা দেখিত তাহারা তাঁহার কর্ণগোচর করিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"আমি প্রবাহিত বাতাস তাহার অধীনস্থ করিয়া দিয়াছিলাম।সে তাহার ইচ্ছানুযায়ী বাতাসকে পরিচালনা করিত।"
আর একদিন হযরত সোলায়মান (আঃ) কোথাও যাইতেছিলেন। পিঁপড়ার বাদশাহ দেখিলেন হযরত সোলায়মান (আঃ) তাঁহার সেনাবাহিনী লইয়া আসিতেছেন। সে তাহার সঙ্গী-সাথীদিগকে বলিল, তোমরা পদদলিত হওয়ার পূর্বেই গর্তে চলিয়া যাও। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"এমনকি পিঁপড়ারা ময়দানে আসিল, তখন এক পিঁপড়া বলিল, হে পিঁপড়াকুল। তোমরা তোমাদের গর্তে ঢুকিয়া পড়। অসাবধানতাবশত সোলায়মান এবং তাঁহার বাহিনী যেন তোমাদিগকে পদদলিত করিয়া না ফেলেন।"
সংবাদদাতা হযরত সোলায়মান (আঃ)-কে এই সংবাদ জ্ঞাপন করিল। হযরত সোলায়মান (আঃ) বায়ুকে নির্দেশ দিলেন আমার সিংহাসন এখানে অবতরণ করাও। আর তোমরা স্ব স্ব কর্তব্য কাজ কর। অতঃপর তিনি পিঁপড়ার গর্তের পাশে বসিয়া পড়িলেন। পিঁপড়ার বাদশাহ গর্ত হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, হে আল্লাহর নবী ! বলুন, আল্লাহ আপনাকে কি কি বস্তু দান করিয়াছেন?
হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিলেন, সেই শ্রেষ্ঠ বাদশাহ আমাকে এমন সিংহাসন দান করিয়াছেন যে, উহার উপর চারি হাজার কুরসী বসানো আছে। প্রত্যেক কুরসীতে একজন আলেম বসিয়া ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেন। জ্বিন, ইনসান, দৈত্য, পশু-পাখী সব কিছু আমার আজ্ঞাধীন করিয়া দিয়াছেন। এমনকি বাতাস আমার কথামত পরিচালিত হয়। পিপড়া জিজ্ঞাসা করিল, বাতাস পরিচালনা করার মধ্যে কি রহস্য আছে আপনি জানেন কি? হযরত সোলায়মান (আঃ) এই প্রশ্নে হতবাক হইয়া রহিলেন। পিঁপড়া বলিল, ইহারা সব বাতাসী দুর্গ, আপনার ক্ষমতাধীন কিছুই নহে। এই পৃথিবীর গঠন যতই উচ্চ পর্যায়ের হউক না কেন, একদিন অবশ্যই ধ্বংস হইয়া যাইবে। দুনিয়ার সম্পদ ও রাজত্ব অর্থহীন। ইহা বরবাদী ব্যতীত আর কিছুই নহে। বায়ু তাঁহার সিংহাসন একমাসের পথ একদিনে লইয়া যাইত আবার রাতে ফিরিয়া আসিত। যখন তিনি পানিবিহীন কোন স্থানে অবতরণ করিতেন তখন দৈত্য-দানবকে নির্দেশ দিতেন মাটি খুঁড়িয়া পানি বাহির করিতে। এই সমস্ত কিছু ধোঁকাবাজ নফসকে যাচাই করার জন্য ছিল। সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে খেজুর পাতার থলি তৈয়ার করিতেন এবং তাহা বিক্রয় করিয়া সন্ধ্যায় ইফতার করিতেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্রতার দরুন থলি তৈয়ার করিয়া জীবিকানির্বাহের পন্থা করিয়া লইয়াছিলেন। এইভাবে জীবন যাপন করিলেই এই দুনিয়া তোমার জন্য রহমতস্বরূপ হইবে। ধর্মের জন্যই দুনিয়াকে গ্রহণ কর।
বর্ণিত আছে, সমস্ত নবীর পর হযরত সোলায়মান ও ইউসুফ (আঃ) বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাইবেন। কারণ, তাঁহারা বাদশাহীর প্রতি আসক্ত না থাকিলেও বাদশাহ ছিলেন।
তারপর বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিলেন, হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছেন, "আমার পর যেন আর কাহারও এমন রাজত্ব না থাকে।" অর্থাৎ নবী ব্যতীত অন্য কেহ যেন এমন রাজ্যের অধিপতি না হয়। এমন প্রার্থনা অন্য কেহ করেন নাই। এমন বিস্ময়কর রাজ্য ও সিংহাসনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নফস তাঁহার উপর কোন প্রকার কর্তৃত্ব করিতে পারে নাই। আম্বিয়া ব্যতীত অন্যদের অবস্থা ইহার বিপরীত। কারণ, তাহারা নিষ্পাপ বা শয়তান ও নফসের ধোঁকা হইতে নিরাপদ নহে। তাহারা যদি এমন বাদশাহীর অধিকারী হয় তবে অতি শীঘ্রই ধ্বংসের কূপে নিপতিত হইবে। তাই আল্লাহর সৃষ্টির নিরাপত্তার জন্য হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছিলেন, "আমার পরে যেন অন্য কেহ এমন বিশাল রাজ্যের অধিপতি না হয়।"
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে বর্ণিত আছে, হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং অন্যান্য বহু নবী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। একমাত্র ইউসুফ (আঃ) ব্যতীত অন্যান্য সকল নবীকে কোব্বার মধ্যে কবর দেওয়া হইয়াছে। কারণ, হযরত ইউসুফ (আঃ) নবী থাকা সত্ত্বেও মিসরের বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
"এমনিভাবে আমি পৃথিবীতে ইউসুফকে ক্ষমতাশালী করিয়াছিলাম যাহাতে সে তাহার ইচ্ছামত কাজ করিতে পারে। যাহাকে ইচ্ছা আমি আমার রহমতের অংশীদার করি। আমি এহসানকারীদের পারিশ্রমিক কম করি না।"
নফস এমনই খারাপ যে, আল্লাহর বিরোধিতা করিতে আরম্ভ করিয়া দেয়। আল্লাহ তাআলা বান্দাদিগকে বলেন,
"আমার একত্ববাদ স্বীকার করিয়া আমার প্রশংসা কর, আমি ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা করিও না এবং আমার নির্দেশ পালন কর।" ঠিক তেমন নফস আদেশ করে, আমার প্রশংসা কর, আমার আদেশের বিরোধিতা করিও না এবং আমি ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিও না। প্রত্যেক ব্যক্তির নফসই এই দাবী করে। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজেকে অন্যের চেয়ে বুযুর্গ মনে করে এবং বলে, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেহ নাই।
তৃপ্তি সহকারে আহার, অধিক পার্থিব ধন-সম্পদ সঞ্চয় এবং আরাম-আয়েশের কারণেই নফস আল্লাহর সমতুল্য হওয়ার দাবী করিয়া থাকে। যেমন- কথিত আছে, ফেরআউন যদি ক্ষুধার্ত থাকিত তবে খোদায়ী দাবি করার সাহস পাইত না। একমাত্র এই কারণেই বুযুর্গগণ ধোঁকাবাজ নফসের মনস্কামনা পূর্ণ হইতে দিতেন না। সুতরাং নফসানী যিন্দেগী হইতে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁহার বন্ধুদিগকে ক্ষুধার্ত রাখেন। আশ্চর্য যে, লুক্কায়িত কাফের নফস তবুও খোদায় দাবী করে। এই দুর্ভাগা কুকুর আমার সহিত সব কিছুই করে। সে এমন কিছু করে যাহা রোমী কাফেরও করে না।
নফস আয়ত্তে আসিয়াছে কিনা ইহা অবগত হইতে ইচ্ছা করিলে নিজের প্রতি লক্ষ্য করিবে। নিজের মধ্যে সামান্যতম গর্ব থাকিলেও বুঝিবে, তোমার নফস এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে। নিজেকে সাধারণ একটি কুকুরের চেয়েও ভাল মনে করিলে গর্ব-অহংকার এখনও বাকী রহিয়াছে। যতদিন আত্মঅহংকার থাকিবে ততদিন নফসও জীবিত থাকিবে। নফস যতদিন থাকিবে বিপদও ততদিন থাকিবে। ইসলামের সৌন্দর্য অর্জন করা হইতে ততই দূরে থাকিবে। ইসলামে গর্ব ও অহংকারের স্থান কোথায়?
কোন কোন দরবেশনামা ব্যক্তি মনে করেন, আমি আল্লাহর মনোনীতদের একজন। কিন্তু সে জানে না, সারাজীবনের সঞ্চয় তাহার একমাত্র গর্ব ও অহংকার ব্যতীত আর কিছুই নহে। যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে রাস্তার কুকুরের চেয়েও অধম মনে করে তবে মানিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, সে তাহার নফসকে আয়ত্তে আনিতে সমর্থ হইয়াছে।
আল্লাহ ব্যতীত অন্যের পর্দা যখন মধ্যস্থল হইতে অপসারণ হইয়া যায় তখন সঠিক কথা এই হইয়া যাইবে যে, আমি মারেফাতের আসমানের চন্দ্রে পরিণত হইব। দেহ এবং প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিতে যখন তুমি সক্ষম হইবে তখন তোমার যাহা কিছু থাকিবে তাহাই যথার্থ।
বাইশে রবিউল আউয়াল, সোমবার। নফসের দোষ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।
পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, আল্লাহ তাআলা নফসকে পয়দা করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর পরিচয় কি? নফস বলিল- আমি আমি, তুমি তুমি।
ইহার পর আল্লাহ তাআলা নফসকে অনাহারে রাখিয়া শাস্তি দিলেন। নফস ক্ষুধায় কাতর হইয়া পড়িল।
এইবার জিজ্ঞাসা করিলেন, তোর পরিচয় কি?
নফস বলিল,
খোদাওয়ান্দ! তুমি আমার শক্তিশালী মালিক। আমি তোমার দুর্বল দাস।
এখন চিন্তা করিয়া দেখ যে, ক্ষুধা কেমন বস্তু। নাফরমানকেও আল্লাহর বন্দেগী করায়, তাঁহার সম্মুখে মাথানত করিতে বাধ্য করে। এই ধোঁকাবাজ নফস ক্ষুধার শাস্তি পাওয়া ব্যতীত আর কিছুতেই মাথানত করে না। আমাদের নফস ফেরআউনের অবাধ্য নফসের ন্যায় গর্বিত এবং মাথা উত্তোলন করিয়া দাঁড়ায়। কিন্তু ফেরআউনের নফস প্রকাশ্যভাবে বলিত- "আমি তোমার মহান প্রভু"। আর আমাদের নফস অতি সংগোপনে বলে, আমি তোমাদের মহান প্রভু। আমিত্বের এই দাবী প্রত্যেক নফসই করিয়া থাকে। পার্থক্য এতটা যে. ফেরআউনের দাবী ছিল প্রকাশ্য। ইহার কারণ এই যে, ফেরআউন কাহাকেও ভয় করিত না। সেই যুগে তাহার চেয়ে প্রভাবশালী আর কেহ ছিল ন! যে তাহার ক্ষতিসাধন করিতে পারে। তাই যাহা কিছু বলার সর্বজনসমক্ষে এবং প্রকাশ্যেই বলিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"হে নবীবর ! আপনি কি তাহাদের অবস্থা লক্ষ্য করেন নাই যাহারা তাহাদের নফসকে স্বীয় খোদায় পরিণত করিয়াছে।"
শয়তান সাত হাজার বৎসর খোদার এবাদত-বন্দেগী করিয়া পরিশেষে নফসের বান্দায় পরিণত হইল। আল্লাহর এবাদত পরিত্যাগ করিয়া নফসের তাবেদার হইল। আল্লাহ যখন তাহাকে বলিলেন, আদমকে সেজদা কর। তখন সে বলিয়া উঠিল, আমি আদমের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। তুমি আমাকে অগ্নি দ্বারা সৃষ্টি করিয়াছ। নফস তাহার উপর বিজয়ী হওয়ায় সে আল্লাহর হুকুমের অবাধ্য হইয়া আদমকে সেজদা করিল না, কাফের হইয়া গেল। কোরআন বলে, "সে গর্বভরে অস্বীকার করিয়া কাফের হইল।" নফসের একটি নির্দেশ পালন করিয়া হাজার হাজার বৎসরের সাধনা নষ্ট করিয়া ফেলিল। চিরকালের জন্য অভিশপ্ত হইয়া আল্লাহর দরবার হইতে বাহির হইয়া আসিল। হাজার হাজার বৎসর এবাদত করার পরও গলায় লানতের বেড়ি পরাইয়া দেওয়া হইল। তাহার কপালে কলঙ্কের টিকা এইভাবে লাগাইয়া দেওয়া হইল-
"আমার লানত তোমার উপর কেয়ামত পর্যন্ত থাকিবে।" নফসে আম্মারাকে আয়ত্তে আনা এবং দুর্বল করার জন্যই সমস্ত বুযুর্গ রিয়াযত মুজাহাদার আগুনে দগ্ধ হইয়াছেন। নফসকে দমন ও ঘৃণিত করিয়া রাখার জন্যই তাঁহারা মোটা কম্বল আর খেরকা পরিধান করিতেন। তাই যদি কোন সময় তুমি তোমার নফসের উপর ক্রোধ প্রকাশ কর তবে নফসের দোষ তোমা হইতে দূর হইয়া যাইবে। এই সময় নফসকে অগ্নিকুণ্ডের উপর রাখিয়া দাও। ফলে নফস সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হইয়া তোমার দেহ নূরের আলোকে আলোকিত হইয়া উঠিবে।
নফসকে দমন ও দুর্বল করার মানসেই আল্লাহর নবীগণ ক্ষুধার্ত থাকিতেন, দরিদ্রতা পছন্দ করিতেন। তাঁহারা নিষ্পাপ হওয়া সত্ত্বেও এক মুহূর্তের জন্যও নফস হইতে নির্ভয় থাকিতেন না। তাঁহারা আল্লাহর নিকট রাজত্ব বা ধন-সম্পদ কামনা করিলে অবশ্যই পাইতেন। কিন্তু তাহা কামনা করেন নাই। রাজ্য ও সম্পদে মুক্তির আলো দেখেন নাই। বরং তাহাতে নফসের আধিপত্যই দেখিয়াছিলেন। তাহাতে মুক্তির চেয়ে বন্দীত্বকেই বেশী দেখিতে পাইতেন। দরিদ্রতা ও অনাহারে থাকার মধ্যেই মুক্তি ও পরকালে সফলকাম হওয়া নিহিত রহিয়াছে। নফসের পূজা করা আমাদের জন্য নহে। আমরা এবং আমাদের মযহাব অন্য কিছু।
বর্ণিত আছে, স্বেচ্ছায় দরিদ্রতাবরণ ও অনাহারে থাকার অবস্থা এতটা ছিল যে, একাদিক্রমে দুই তিন দিন হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর ঘরে রান্নাবান্নার কোন ব্যবস্থা থাকিত না। আবার কখনও তৈলের অভাবে পবিত্র গৃহ প্রদীপের আলোকে আলোকিত হইত না।
আল্লাহর বান্দার উপর আল্লাহর পক্ষ হইতে যে বিপদ অবতীর্ণ হয়, আল্লাহ তাআলা সেই বিপদের মধ্যে মেহেরবানীর এক বিরাট ভাণ্ডার লুক্কায়িত রাখেন।
অবাধ্য নফসের বিরুদ্ধে শেকায়েত সম্বন্ধে সুলতানুল আরেফীন হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রহঃ) হইতে একটি রেওয়ায়েত আছে, তিনি বলিতেন, কাল কেয়ামতের দিন আমি আল্লাহর নিকট দরখাস্ত করিব যে, হে খোদা ! আমাকে দোযখে প্রবেশ করার অনুমতি দেন। যে কাফের নফস দুনিয়ায় অন্তরের রক্ত প্রবাহিত করাইয়াছে, আজ আমি উহাকে ক্রোধের অগ্নি দ্বারা জ্বালাইয়া দিব।
বর্ণিত আছে, পাক পবিত্র-থাকা সত্ত্বেও হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছিলেন, আমি আমার নফসকে পরীক্ষা করিয়া দেখিব, সে আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন কিছুতে সন্তুষ্ট কিনা? দেখিলেন, নফস স্বভাবে ঠিক একই আছে। তিনি ধারণা করিলেন, সমস্ত পৃথিবীর বাদশাহ হওয়ার আকাঙ্ক্ষা হইতে নফস পিছপা নহে। তাই তিনি সীমাহীন বাদশাহী দ্বারাই নফসকে যাচাই করিতে চাহিয়া প্রার্থনা করিলেন- "হে আল্লাহ! আমাকে এমন রাজত্ব দান কর যেন আমার পর আর কেহ তেমন বিশাল রাজত্বের অধিকারী না হইতে পারে। নিশ্চয়ই তুমি দানকারী"।
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, যদি নফসকে যাচাই করার উদ্দেশ্যই ছিল তবে "আমার পর আর কেহই যেন তেমন বিশাল রাজত্বের অধিকারী না হইতে পারে" বলার অর্থ কি? এরশাদ করিলেন, ইহার বহু প্রকার ব্যাখ্যা বর্ণিত আছে। কেহ বলেন, শুধু বাদশাহী চাহিলে পূর্ণ রাজত্ব হইত না। অর্থাৎ এমন রাজত্ব হইত যেখানে অন্যান্য রাজা-বাদশাহও থাকিত, একচ্ছত্র অধিপতি হইতে পারিতেন না। রাজ্যের অংশীদার থাকিলে ক্ষতি হয়, পূর্ণতা অবশিষ্ট থাকে না। অথচ তাঁহার ইচ্ছা ছিল পূর্ণভাবে নফসকে যাচাই করা। পূর্ণতার যাচাই পূর্ণতা দ্বারাই হইয়া থাকে, অংশ দ্বারা নহে।
আবার কোন কোন তাফসীরকার বলেন, বাদশাহী চাওয়ার অর্থ, তিনি খুব যুদ্ধপ্রিয় ছিলেন এবং যুদ্ধ ব্যতীত দেশ জয় লাভ করা যায় না। যুদ্ধ করার জন্য রাজত্ব কামনা করিয়াছিলেন। ফলে আল্লাহ তাঁহাকে সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র বাদশাঃ করিয়াছিলেন।
হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর একহাজার স্ত্রী ছিলেন। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পর যাহাদিগকে বিবাহ করেন তাঁহাদের সংখ্যাই ছিল সাত শত। অবশিষ্ট তিন শত কুমারীর পাণি গ্রহণ করিয়াছিলেন।
এতসংখ্যক বিবাহ করার উদ্দেশ্য ছিল বহু সন্তান লাভের আশা। এই সন্তানগণই যেন তাঁহাকে যুদ্ধে সাহায্য করিতে পারে। বায়ু তাঁহার সিংহাসন বহন করিত। বহুদূর পর্যন্ত মানব সৈন্য ছড়াইয়া থাকিত। পরী, জিন ও পক্ষীকুল পলক মেলিয়া এই সৈন্যবাহিনীকে সূর্য তাপ হইতে ছায়া দান করিত।
এই সৈন্যদের রসদপত্র ও অন্যান্য আসবাবপত্র দেও-দৈত্যগণ যথাস্থানে মুহূর্তের মধ্যে পৌছাইয়া দিত। সমুদ্র হইতে মণি-মুক্তা উঠাইয়া আনিত। সারা পৃথিবীতে হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর গোয়েন্দা বাহিনী নিয়োজিত ছিল। যেখানে যাহা কিছু শুনিত বা দেখিত তাহারা তাঁহার কর্ণগোচর করিত। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"আমি প্রবাহিত বাতাস তাহার অধীনস্থ করিয়া দিয়াছিলাম।সে তাহার ইচ্ছানুযায়ী বাতাসকে পরিচালনা করিত।"
খোদা প্রেমিকদের সম্বন্ধে বর্ণিত আছে, একদিন এক কবুতর তার সঙ্গিনীর সাথে খেলা করিতেছিল। কিন্তু মাদী কবুতর সঙ্গী নর কবুতরটিকে তেমন আমল দিতেছিলন অর্থাৎ খেলার প্রতি উহার কোন মনোযোগ ছিল না। নর কবুতর বলিল তোর জন্য কি দেশটি তছনছ করিয়া ফেলিব? গোয়েন্দা এই কথা শুনিতেছিল। সে হযরত সোলায়মান (আঃ)-কে এই সংবাদ দিল। পর দিন সকালে তিনি উক্ত কবুতরটিকে সংবাদ দিয়া দরবারে হাযির করিলেন এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, গতকাল তুমি তোমার সঙ্গিনীর সাথে খেলা করার সময় কি একথা বলিয়াছিলে যে, তোর জন্য কি দেশটা তছনছ করিয়া ফেলিব? কবুতর বলিল, জি হাঁ ! বলিয়াছিলাম। হযরত সোলাময়মান (আঃ) বলিলেন, কিভাবে তুমি তছনছ করিবে বল। কবুতর বলিল, হে আল্লাহর নবী ! প্রেমিকদের কথা শ্রবণ করা হয় এবং স্বাদ পাওয়া যায়। এই উত্তর শুনিয়া হযরত সোলায়মান (আঃ) খুবই সন্তুষ্ট হইলেন এবং কবুতরটি উড়াইয়া দিলেন।
আর একদিন হযরত সোলায়মান (আঃ) কোথাও যাইতেছিলেন। পিঁপড়ার বাদশাহ দেখিলেন হযরত সোলায়মান (আঃ) তাঁহার সেনাবাহিনী লইয়া আসিতেছেন। সে তাহার সঙ্গী-সাথীদিগকে বলিল, তোমরা পদদলিত হওয়ার পূর্বেই গর্তে চলিয়া যাও। আল্লাহ তাআলা বলেন-
"এমনকি পিঁপড়ারা ময়দানে আসিল, তখন এক পিঁপড়া বলিল, হে পিঁপড়াকুল। তোমরা তোমাদের গর্তে ঢুকিয়া পড়। অসাবধানতাবশত সোলায়মান এবং তাঁহার বাহিনী যেন তোমাদিগকে পদদলিত করিয়া না ফেলেন।"
সংবাদদাতা হযরত সোলায়মান (আঃ)-কে এই সংবাদ জ্ঞাপন করিল। হযরত সোলায়মান (আঃ) বায়ুকে নির্দেশ দিলেন আমার সিংহাসন এখানে অবতরণ করাও। আর তোমরা স্ব স্ব কর্তব্য কাজ কর। অতঃপর তিনি পিঁপড়ার গর্তের পাশে বসিয়া পড়িলেন। পিঁপড়ার বাদশাহ গর্ত হইতে বাহির হইয়া আসিয়া বলিল, হে আল্লাহর নবী ! বলুন, আল্লাহ আপনাকে কি কি বস্তু দান করিয়াছেন?
হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিলেন, সেই শ্রেষ্ঠ বাদশাহ আমাকে এমন সিংহাসন দান করিয়াছেন যে, উহার উপর চারি হাজার কুরসী বসানো আছে। প্রত্যেক কুরসীতে একজন আলেম বসিয়া ধর্মজ্ঞান শিক্ষা দেন। জ্বিন, ইনসান, দৈত্য, পশু-পাখী সব কিছু আমার আজ্ঞাধীন করিয়া দিয়াছেন। এমনকি বাতাস আমার কথামত পরিচালিত হয়। পিপড়া জিজ্ঞাসা করিল, বাতাস পরিচালনা করার মধ্যে কি রহস্য আছে আপনি জানেন কি? হযরত সোলায়মান (আঃ) এই প্রশ্নে হতবাক হইয়া রহিলেন। পিঁপড়া বলিল, ইহারা সব বাতাসী দুর্গ, আপনার ক্ষমতাধীন কিছুই নহে। এই পৃথিবীর গঠন যতই উচ্চ পর্যায়ের হউক না কেন, একদিন অবশ্যই ধ্বংস হইয়া যাইবে। দুনিয়ার সম্পদ ও রাজত্ব অর্থহীন। ইহা বরবাদী ব্যতীত আর কিছুই নহে। বায়ু তাঁহার সিংহাসন একমাসের পথ একদিনে লইয়া যাইত আবার রাতে ফিরিয়া আসিত। যখন তিনি পানিবিহীন কোন স্থানে অবতরণ করিতেন তখন দৈত্য-দানবকে নির্দেশ দিতেন মাটি খুঁড়িয়া পানি বাহির করিতে। এই সমস্ত কিছু ধোঁকাবাজ নফসকে যাচাই করার জন্য ছিল। সমগ্র পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও তিনি নিজ হাতে খেজুর পাতার থলি তৈয়ার করিতেন এবং তাহা বিক্রয় করিয়া সন্ধ্যায় ইফতার করিতেন। হযরত সোলায়মান (আঃ) সমগ্র পৃথিবীর অধিপতি হওয়া সত্ত্বেও দরিদ্রতার দরুন থলি তৈয়ার করিয়া জীবিকানির্বাহের পন্থা করিয়া লইয়াছিলেন। এইভাবে জীবন যাপন করিলেই এই দুনিয়া তোমার জন্য রহমতস্বরূপ হইবে। ধর্মের জন্যই দুনিয়াকে গ্রহণ কর।
বর্ণিত আছে, সমস্ত নবীর পর হযরত সোলায়মান ও ইউসুফ (আঃ) বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাইবেন। কারণ, তাঁহারা বাদশাহীর প্রতি আসক্ত না থাকিলেও বাদশাহ ছিলেন।
তারপর বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলিলেন, হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছেন, "আমার পর যেন আর কাহারও এমন রাজত্ব না থাকে।" অর্থাৎ নবী ব্যতীত অন্য কেহ যেন এমন রাজ্যের অধিপতি না হয়। এমন প্রার্থনা অন্য কেহ করেন নাই। এমন বিস্ময়কর রাজ্য ও সিংহাসনের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও নফস তাঁহার উপর কোন প্রকার কর্তৃত্ব করিতে পারে নাই। আম্বিয়া ব্যতীত অন্যদের অবস্থা ইহার বিপরীত। কারণ, তাহারা নিষ্পাপ বা শয়তান ও নফসের ধোঁকা হইতে নিরাপদ নহে। তাহারা যদি এমন বাদশাহীর অধিকারী হয় তবে অতি শীঘ্রই ধ্বংসের কূপে নিপতিত হইবে। তাই আল্লাহর সৃষ্টির নিরাপত্তার জন্য হযরত সোলায়মান (আঃ) বলিয়াছিলেন, "আমার পরে যেন অন্য কেহ এমন বিশাল রাজ্যের অধিপতি না হয়।"
পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে বর্ণিত আছে, হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং অন্যান্য বহু নবী হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর বংশধর ছিলেন। একমাত্র ইউসুফ (আঃ) ব্যতীত অন্যান্য সকল নবীকে কোব্বার মধ্যে কবর দেওয়া হইয়াছে। কারণ, হযরত ইউসুফ (আঃ) নবী থাকা সত্ত্বেও মিসরের বাদশাহ ছিলেন। আল্লাহ তাআলা বলেন,
"এমনিভাবে আমি পৃথিবীতে ইউসুফকে ক্ষমতাশালী করিয়াছিলাম যাহাতে সে তাহার ইচ্ছামত কাজ করিতে পারে। যাহাকে ইচ্ছা আমি আমার রহমতের অংশীদার করি। আমি এহসানকারীদের পারিশ্রমিক কম করি না।"
নফস এমনই খারাপ যে, আল্লাহর বিরোধিতা করিতে আরম্ভ করিয়া দেয়। আল্লাহ তাআলা বান্দাদিগকে বলেন,
"আমার একত্ববাদ স্বীকার করিয়া আমার প্রশংসা কর, আমি ব্যতীত আর কাহারও উপাসনা করিও না এবং আমার নির্দেশ পালন কর।" ঠিক তেমন নফস আদেশ করে, আমার প্রশংসা কর, আমার আদেশের বিরোধিতা করিও না এবং আমি ব্যতীত আর কাহারও সম্মুখে মাথা নত করিও না। প্রত্যেক ব্যক্তির নফসই এই দাবী করে। প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজেকে অন্যের চেয়ে বুযুর্গ মনে করে এবং বলে, আমার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কেহ নাই।
তৃপ্তি সহকারে আহার, অধিক পার্থিব ধন-সম্পদ সঞ্চয় এবং আরাম-আয়েশের কারণেই নফস আল্লাহর সমতুল্য হওয়ার দাবী করিয়া থাকে। যেমন- কথিত আছে, ফেরআউন যদি ক্ষুধার্ত থাকিত তবে খোদায়ী দাবি করার সাহস পাইত না। একমাত্র এই কারণেই বুযুর্গগণ ধোঁকাবাজ নফসের মনস্কামনা পূর্ণ হইতে দিতেন না। সুতরাং নফসানী যিন্দেগী হইতে নিরাপত্তার উদ্দেশ্যেই তিনি তাঁহার বন্ধুদিগকে ক্ষুধার্ত রাখেন। আশ্চর্য যে, লুক্কায়িত কাফের নফস তবুও খোদায় দাবী করে। এই দুর্ভাগা কুকুর আমার সহিত সব কিছুই করে। সে এমন কিছু করে যাহা রোমী কাফেরও করে না।
নফস আয়ত্তে আসিয়াছে কিনা ইহা অবগত হইতে ইচ্ছা করিলে নিজের প্রতি লক্ষ্য করিবে। নিজের মধ্যে সামান্যতম গর্ব থাকিলেও বুঝিবে, তোমার নফস এখনও অবশিষ্ট রহিয়াছে। নিজেকে সাধারণ একটি কুকুরের চেয়েও ভাল মনে করিলে গর্ব-অহংকার এখনও বাকী রহিয়াছে। যতদিন আত্মঅহংকার থাকিবে ততদিন নফসও জীবিত থাকিবে। নফস যতদিন থাকিবে বিপদও ততদিন থাকিবে। ইসলামের সৌন্দর্য অর্জন করা হইতে ততই দূরে থাকিবে। ইসলামে গর্ব ও অহংকারের স্থান কোথায়?
কোন কোন দরবেশনামা ব্যক্তি মনে করেন, আমি আল্লাহর মনোনীতদের একজন। কিন্তু সে জানে না, সারাজীবনের সঞ্চয় তাহার একমাত্র গর্ব ও অহংকার ব্যতীত আর কিছুই নহে। যদি কোন ব্যক্তি নিজেকে রাস্তার কুকুরের চেয়েও অধম মনে করে তবে মানিয়া লওয়া যাইতে পারে যে, সে তাহার নফসকে আয়ত্তে আনিতে সমর্থ হইয়াছে।
আল্লাহ ব্যতীত অন্যের পর্দা যখন মধ্যস্থল হইতে অপসারণ হইয়া যায় তখন সঠিক কথা এই হইয়া যাইবে যে, আমি মারেফাতের আসমানের চন্দ্রে পরিণত হইব। দেহ এবং প্রাণের মায়া পরিত্যাগ করিতে যখন তুমি সক্ষম হইবে তখন তোমার যাহা কিছু থাকিবে তাহাই যথার্থ।
No comments:
Post a Comment