২৪- চতুর্বিংশ মজলিস
মিলন সেতু
ঊনিত্রিশে রবিউল আউয়াল, সোমবার। দরবারে উপস্থিত মুরীদদের মধ্য হইতে কাযী যাহেদ বলিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন-
"যেব্যক্তি আমাকে সফর মাস গত হওয়ার সুসংবাদ দিবে আমি তাহাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিব।" পয়গম্বরদের নিকট মাসের কোন প্রকার ভাল-মন্দ বা কোন বস্তুর কোন প্রকার কঠোরতা নাই। বরং সকল মাসই তাঁহাদের নিকট সমান। সুতরাং হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) কোন উদ্দেশ্যে এমন কথা বলিলেন?
পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, এই হাদীসের অনেক প্রকার ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। প্রথমত সফর মাসে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) অসুস্থ হন। আল্লাহ তাআলা তাঁহাকে কথা দিয়াছিলেন, হে বন্ধু। সফর মাস অতিবাহিত হওয়ার পরই আপনি আমার সাথে মিলিত হইবেন। তাই সফর মাস হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর জন্য কষ্টকর কোন কিছু ছিল না। বরং সফর মাস অতিবাহিত হইতে যে বিলম্ব হইতেছিল এবং যে বিলম্বের ফলে বন্ধুর সহিত মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন, তাহাই তাঁহার জন্য কষ্টকর ছিল। তিনি অপেক্ষা করিতেছিলেন, কখন সফর মাস শেষ হইবে আর আমি আমার আরাধ্য জনের সহিত গিয়া মিলিত হইব।
ইহার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি এরশাদ করিয়াছেন, যে আমাকে সফর মাস শেষ হওয়ার সংবাদ দিবে আমি তাহাকে বেহেশতের সুসংবাদ দিব।
ইমাম যাহেদ (রঃ) তাফসীরে লিখিয়াছেন, বারই রবিউল আউয়াল সোমবার হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এই নশ্বর দুনিয়া ত্যাগ করিয়া পরম বন্ধুর সাথে গিয়া মিলিত হন। ইহার রহস্য হইল- 'মৃত্যু' বন্ধুর সাথে বন্ধুর 'মিলন সেতু'।
এখানে তিনি বলিয়াছেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর জীবদ্দশায় সাহাবাগণ যে সমস্ত কাজ-কারবার করিতেন তাঁহার ইনতেকালের পর আর সেই সবে তেমন বরকত ও সুযোগ-সুবিধা পাইতেছিলেন না। তাঁহারা ভয় পাইলেন, নিশ্চয়ই আমাদের ধর্মীয়কাজে শিথিলতা আসিয়াছে। এই ধারণা হইতে তাঁহারা ঘর-বাড়ী, স্ত্রী-পুত্রের মায়া পরিত্যাগ করত ধর্মীয় কাজের জন্য নির্জনতা অবলম্বন করিলেন। "পাহাড় জঙ্গলের ঐ সমস্ত জীব-জন্তুর ন্যায় জীবিকানির্বাহ কর যাহারা সব কিছু দেখিয়া ভয় পায় এবং বাড়ী-ঘর ইঁদুর-বিড়ালের জন্য ছাড়িয়া দাও"। ধর্মের চিন্তা যাহার অন্তরে স্থায়ী হইয়া যায়, ঘর-বাড়ী, সন্তান-সন্ততি তাহার চলার পথে বাধা সৃষ্টি করিতে পারে না।
উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত হাসান বসরী (রঃ) সাহাবী ছিলেন কিনা?
তিনি বলিলেন, সাহাবী নহেন, কিন্তু সাহাবীদের তিনি দেখিয়াছেন। তিনি ছিলেন তাবেয়ী। তিনি যত সাহাবী দেখিয়াছেন অন্য কোন তাবেয়ীর সেই ভাগ্য হয় নাই।
তারপর বলিলেন, একদিন তিনি বহু লোকের সাথে বসা ছিলেন। তাহাদেব মধ্য হইতে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, হযরত। সাহাবীদের দৃষ্টিতে আমরা কেমন? তিনি উত্তর করিলেন, তোমাদিগকে তাঁহারা দেখিলে বলিতেন তোমরা শয়তান সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আর যদি তোমরা তাঁহাদিগকে দেখিতে এবং তাঁহাদের আচার-ব্যবহার প্রত্যক্ষ করিতে তবে বলিতে, ইহারা তো উন্মাদ ! বোধ শক্তি বিবর্জিত পাগল।
হযরত হাসান বসরীর বর্ণনামতে এই ছিল তাবে তাবেয়ীদের অবস্থা। অথচ হিজরতের পর তখনও একশত চল্লিশ বৎসর অতিবাহিত হয় নাই। আজ আমরা শত শত বৎসর পরের লোক। অথচ আমরা আমাদিগকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দান করি। প্রতিমার উদ্দেশে সেজদা করিয়া কপালে দাগ পড়িয়া গিয়াছে। এই অবস্থায় মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিয়া নিজেকে আর কতকাল দোষারোপ করিব? যাহারা পরবর্তীকালে জন্মগ্রহণ করিবে (যমন আমরা) তাহাদের জন্য পরিতাপ। আল্লাহ জানেন তাহাদের কি অবস্থা হইবে?
এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, ধৈর্যধারণ করা কি ঈমানের শর্ত? এরশাদ করিলেন, হাঁ, ধৈর্যধারণ করা ঈমানের শর্তাবলীর মধ্যে একটি শর্ত।
তাহা হইলে যেব্যক্তি ধৈর্যশীল নহে তাহার অবস্থা কি হইবে?
বলিলেন, এমন কথাই হইতে পারে না। প্রতিটি লোক তাহার ঈমান অনুযায়ী ধৈর্যশীল। কাহারও ধৈর্য প্রকাশ পায় আবার কাহারও ধৈর্য গোপন থাকে। শোন ! হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন- "ঈমানের দুইটি অংশ ! একাংশ কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন এবং অন্যাংশ ধৈর্যাবলম্বন"। ইহাতে প্রমাণিত হয়, যেব্যক্তি "লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্ মুহম্মদুর রসুলুল্লাহ্" বলে সে-ই ধৈর্যশীল। কোন মোমেনই ধৈর্যহীন নহে এবং হইবেও না। ধৈর্যধারণের ক্ষমতা আল্লাহই দান করেন। বান্দার কর্তব্য সর্বদা আল্লাহর নিকট ধৈর্যধারণের ক্ষমতা প্রার্থনা করা। যেমন- আল্লাহ তাআলা বলেন- "হে মোমেনগণ! নামায ও ধৈর্যধারণের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য কামনা কর। নিশ্চয় আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সাথী"।
সমস্ত লোকই দুইটি অবস্থার সাথে জড়িত। হয় সে সুখে-সম্পদে থাকে অথবা বিপদে জড়িত হয়। যদি সুখে-সম্পদে থাকে তবে আল্লাহ তাহার নিকট কৃতজ্ঞতা চাহেন। আর যদি বিপদে জড়িত হয় তখন তাহার নিকট ধৈর্যধারণের প্রত্যাশা করেন। যেব্যক্তি এই দুই প্রকার গুণে গুণান্বিত নহে, তাহার পক্ষে ঈমানের দাবী করা বাতুলতা ব্যতীত আর কিছুই নহে। ওয়াস সালাম।
-----------
No comments:
Post a Comment