ইশকের নিগূঢ়তত্ব—
ইশকের নিগূঢ়তত্ব হচ্ছে, গোপনীয়তার পর্দা ও আবরণ উৎখাত করে দেওয়া, আচ্ছাদিত রহস্যাবলী উন্মোচিত করে দেওয়া, প্রেমাস্পদের ধ্যানমগ্নতা ও স্মৃতিচারণের অমৃত আস্বাদ ও উন্মত্ততায় আত্মহারা হওয়া, যেন শরীরের কোন অঙ্গ কর্তন করা হলেও বিন্দুমাত্র অনুভব না হয়।
এক ব্যক্তি ফুরাত নদীর তীরে গোসল করছিল। এমন সময় অপর এক ব্যক্তির কণ্ঠে নিম্নের এ আয়াতটির তিলাওয়াত শুনেছিল?
"হে অপরাধীরা। আজ তোমরা ভিন্ন হয়ে যাও”। (সুরা ইয়াসীন : ৫৯)
আয়াতটির তিলাওয়াত শুনার সাথে সাথে এর হৃদয়বিদারক প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তৎক্ষণাৎ সে নদীতে ডুবে মারা যায়।
মুহম্মদ আবদুল্লাহ বাগদাদী (রহঃ) বলেছেন : ‘আমি বসরা শহরে জনৈক যুবককে দেখেছি, উচু একটি অট্টালিকার ছাদের উপর থেকে উকি দিয়ে সে পথচারীকে উদ্দেশ্য করে বলছে – ইশক ও মহব্বতের তরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে কেউ কোনদিন কল্যাণ সাধন করতে পারে নাই। সুতরাং যদি কোন নিবেদিত প্রাণ ব্যক্তি প্রেমাস্পদের তরে প্রাণ বিসর্জন দিতে চায়, তা হলে সে যেন এভাবে মৃত্যুবরণ করে। একথা বলে সে তৎক্ষণাৎ ছাদের উপর থেকে মাটিতে পড়ে গেল । পরক্ষণেই লোকজন তাকে উঠিয়ে দেখে, সে মৃত্যুবরণ করেছে।
হযরত জুনাইদ বাগদাদী (রহঃ) বলেনঃ ‘প্রকৃত তাসাওউফ হচ্ছে সর্বপ্রকার খবর ও অবস্থা থেকে বেখবর ও গাফেল থাকার নাম।
একদা হযরত যুনুন মিসরী (রহঃ) মক্কা মুকারমায় মসজিদে হারামের একটি স্তম্ভের নীচে একজন যুবককে দেখলেন নেহায়েত পীড়িত ও বিবস্ত্র অবস্থায় পড়ে আছে; তার বেদনা ভারাক্রান্ত অন্তর থেকে আহ আহ শব্দ বের হচ্ছে। হযরত যুনুন বলেন : এ অবস্থা দেখে আমি তাকে সালাম দিয়ে পরিচয় জিজ্ঞাসা করলাম। সে বললো : আমি একজন মুসাফির আশেক; প্রেম-পীড়িত হয়ে পথে পড়ে আছি। তার উত্তর শুনে আমি বিষয়টি উপলব্ধি করে বললাম : ‘আমিও তোমার মতই একজন। একথা শুনে সে কাঁদতে লাগলো এবং আমিও তার সাথে কাঁদলাম। অতঃপর সে জিজ্ঞাসা করলো : "তুমিও যে কাদলে?” আমি বললাম : ‘তোমার মত আমিও একজন আশেক মুসাফির। একথা শুনে সে আরও অধিক পরিমাণে কাঁদতে লাগলো এবং এ অবস্থাতেই হঠাৎ সজোরে এক চিৎকার দিয়ে মারা গেল। অতঃপর আমি কাপড় দিয়ে তার শরীর আচ্ছাদিত করে কাফন খরিদ করার জন্য বাজারে গমন করলাম। বাজার থেকে কাফন এনে দেখি, সে নাই। তখন আমি আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললাম : সুবহানাল্লাহ (কোথায় গেল) ! এমন সময় একটি গায়েবী আওয়ায আমার কানে ভেসে আসলো— “হে যুনুন ! সে এমন এক পথিক, যাকে শয়তান আক্রমণ করতে চেয়েছে; কিন্তু পারে নাই, তোমার সম্পদের কিয়দাংশ তাকে স্পর্শ করতে চেয়েছে; তা ও হয় নাই, রিদওয়ান ফেরেশতা তাকে জান্নাতে আহ্বান জানিয়েছে; তা ও সে প্রত্যাখ্যান করেছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম : এখন সে কোথায় আছে?
উত্তর আসলো "যোগ্য আসনে, সর্বাধিপতি সম্রাটের সান্নিধ্যে।" (কামারঃ ৫৪)
লোকটিকে উক্ত পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে সে আল্লাহর আশেক ছিল, অত্যধিক ইবাদতে নিমগ্ন থাকতো এবং তওবা ও অনুতাপে দ্রুত অগ্রগামী হতো।
জনৈক বুযুর্গকে ইশক ও মহব্বতের তাৎপর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেছিলেন : 'মাখলুকের সাথে সম্পর্ক কম রাখবে, অধিকতর নির্জনতা ও একাকীত্ব অবলম্বন করবে, সর্বদা চিন্তাশীল থাকবে, নিচুপ থাকবে, চক্ষু উত্তোলন করবে কিন্তু দৃষ্টিপাত করবে না, সম্বোধন করা হলে শুনবে না, কিছু বলা হলে অনুধাবন করবে না, মুসীবতে ধৈর্যহারা হবে না, ক্ষুধার্ত হলে অনুভব করবে না, বিবস্ত্র হলে খবর থাকবে না, গালি বা ভৎর্সনা দিলে বুঝবে না, মানবকে ভয় করবে না, নির্জনে আল্লাহ তা'আলার ধ্যানে মগ্ন থাকবে, সর্বদা তার প্রতি আকৃষ্ট থাকবে, একাকীত্বে মুনাজাত করবে, পার্থিব ঝঞ্চাটে দুনিয়াদার লোকদের সাথে জড়িত হবে না।
হযরত আবু হুরাব বখশী (রহঃ) মহব্বত সম্পর্কে নিম্নের কয়েকটি পংক্তি আবৃত্তি করেছেন, যেগুলোর সারমর্ম হচ্ছে : ‘পার্থিব কোন ব্যাপারে ধোকায় পড়ো না; প্রতারিত হয়ো না। কেননা : এসবই প্রেমিকের জন্য প্রেমাস্পদের উপঢৌকন। দুঃখ-কষ্ট ও বালা-মুসীবত যা প্রেমাস্পদের পক্ষ থেকে এসে থাকে, সবই সে আনন্দচিত্তে বরণ করে নেয়। অভাব-অনটন ও দারিদ্রকেও প্রেমাস্পদের পক্ষ থেকে নগদ দান, সম্মান ও সন্তুষ্টির প্রতীক জ্ঞান করে নেয়। প্রকৃত প্রেমিকের আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে, শত্রুর শত ধিক্কার ও প্রতারণা সত্ত্বেও তার পদঙ্খলন হয় না; বরং উত্তরোত্তর প্রেমাস্পদের প্রতি তার প্রত্যয় ও আসক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে।
একদা হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম একজন যুবকের পার্শ্ব দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন। যুবকটি বাগানে পানি-সিঞ্চন কার্যে রত ছিল। হযরত ঈসা আলাইহিস সালামকে দেখে সে আরয করলো : “হে আল্লাহর নবী ! আপনি দো'আ করুন, যেন আল্লাহ্ তা'আলা আমাকে তার মহব্বতের অণু পরিমাণ অংশ দান করেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম বললেন :
“তোমার মধ্যে তা’ সহ্য করার ক্ষমতা নাই”।
যুবক বললো : “তা’ হলে অর্ধাণু পরিমাণ মহব্বতের জন্য দো'আ করুন।”
অতঃপর হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম দো'আ করলেন “হে মহান প্রভু ! এই যুবককে আপনার মহব্বতের অর্ধাণু পরিমাণ দান করুন।”
দো'আর পর হযরত ঈসা (আঃ) আপন পথে চলে গেলেন। দীর্ঘকাল অতিবাহিত হওয়ার পর তিনি সেই যুবকের বাড়ীর পার্শ্ব দিয়ে যাওয়ার সময় তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। লোকেরা বললো, বহুদিন যাবত যুবকটি পাগল অবস্থায় কালাতিপাত করছে এবং বর্তমানে সে পর্বতের চূড়ায় চুড়ায় ঘুরে বেড়ায়। এ খবর শুনে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালাম দো'আ করলেন “হে আল্লাহ্ সেই নওজওয়ানের সাথে আমাকে সাক্ষাৎ করিয়ে দিন।” দো'আর পর হযরত ঈসা (আঃ) দেখতে পেলেন– সেই যুবক অসংখ্য পর্বতমালার মাঝখানে একটি উঁচু শিখরে আসমানের দিকে মুখ করে দাড়িয়ে আছে।
হযরত ঈসা (আঃ) তাকে সালাম দিলেন; কিন্তু সে কোন উত্তর দিল না। পুনরায় হযরত ঈসা নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন : “আমি ঈসা”।
এ সময় আল্লাহ’র পক্ষ হতে হযরত ঈসা আলাইহিস্ সালামের প্রতি ওহী আসলো- “হে ঈসা ! যার অন্তরে আমার মহব্বতের অর্ধাণু পরিমাণও প্রবেশ করেছে, সে কখনও মানুষের আওয়ায শুনতে পারে না। শুনে রাখ, - আমার মহত্ব ও পরাক্রমশীলতার কসম, তুমি যদি করাত দিয়ে তাকে চৌচির করে দাও, তবুও সে বিন্দুমাত্রও অনুভব করবে না।”
যে ব্যক্তি নিজের জীবনে তিনটি বিষয়ের দাবী করেছে; অথচ আত্মাকে অপর তিনটি বিষয়ের কলুষতা হতে মুক্ত করতে পারে নাই, সে নির্ঘাত ধোকায় পড়ে রয়েছে : এক, হৃদয়ে আল্লাহ্’র যিকরের সুমিষ্ট আস্বাদের দাবী করে; অথচ দুনিয়ার মহব্বত পরিত্যাগ করে নাই।
দুই, - ইবাদতে ইখলাস ও নিষ্ঠার দাবী করে; অথচ মানুষের কাছে সম্মান ও সুযশের লিপ্সা পরিহার করে নাই।
তিন, - আল্লাহ্’র মহব্বতের দাবী করে; অথচ নিজেকে তুচ্ছ ও নিকৃষ্টতম জ্ঞান করে না।
হুযূর আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহি ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেছেন : “অদূর ভবিষ্যতে আমার উম্মতের উপর এমন এক সময় আসবে, যখন তারা পাঁচটি বিষয়কে ভালবাসবে; কিন্তু সেই সঙ্গে অপর পাঁচটি বিষয়কে ভুলে যাবে,
(১) তারা দুনিয়াকে ভালবাসবে; কিন্তু আখেরাতকে ভুলে যাবে।
(২) তারা ধন-দৌলতকে ভালবাসবে; কিন্তু এর হিসাব-নিকাশের কথা ভুলে যাবে।
(৩) তারা সৃষ্টিকে ভালোবাসবে, কিন্তু সৃষ্টিকর্তাকে অবহেলা করবে।
(৪) তারা পাপকার্যকে ভালবাসবে; কিন্তু তওবা করতে ভুলে যাবে।
(৫) তারা বড় বড় অট্টালিকাকে ভালবাসবে; কিন্তু কবরের কথা ভুলে যাবে।”
মনসূর ইবনে আম্মার (রহঃ) এক যুবককে নসীহত করতে গিয়ে বলেছিলেন : “হে যুবক ! তুমি সদা-সর্বদা সতর্ক থাক; যৌবন যেন তোমাকে প্রতারিত না করে; বহু নওজওয়ানকে দেখা গেছে–জীবনের কৃত পাপরাশি হতে তওবা করতে বিলম্ব করেছে, অন্তরে দীর্ঘ আশা পোষণ করেছে, মৃত্যুকে স্মরণ করে নাই আর শুধু বলেছে, আগামী কল্য অথবা পরশু তওবা করবো; এভাবে দীর্ঘ সময় অতীত হওয়ার পর অবশেষে তওবার সুযোগ আর হয় নাই, বঞ্চিত ও প্রতারিত হয়েই সে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে এবং একেবারে রিক্ত হস্তে কবরে গিয়েছে। পার্থিব প্রচুর ধন-সম্পদ, দাস-দাসী, পিতা-মাতা, আওলাদ-পরিজন কিছুই তার উপকারে আসে নাই। যেমন পবিত্র কুরআনে আল্লাহ্ তা'আলা ইরশাদ করেছেন : “(ক্বিয়ামতের দিন) কোন অর্থ-সম্পদ ও সস্তান-সন্ততি কারও কোন উপকারে আসবে না। একমাত্র সেই ব্যক্তি মুক্তি পাবে, যে সুস্থ অস্তঃকরণ নিয়ে আল্লাহ্’র কাছে পৌছবে"। (শু'আরা : ৮৮,৮৯)
ওগো খোদা ! আমাদেরকে মৃত্যুর পূর্বে তওবার তাওফীক দান করুন, গাফলতি ও উদাসীনতা হতে মুক্তি দান করুন, কিয়ামতের ময়দানে আপনার হাবীব সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম উনার শাফা'আত নসীব করুন।
বস্তুতঃ প্রকৃত ঈমানের পরিচয় হচ্ছে, সুযোগের প্রথম মুহূর্তেই তওবা করা, কৃত পাপকার্যের উপর অনুতপ্ত হওয়া, লজ্জা ও অনুশোচনায় ভেঙ্গে পড়া, নশ্বর পৃথিবীর নূন্যতম রিযিক ও দ্রব্যের উপর তুষ্ট থাকা, যাবতীয় দুনিয়াবী ব্যাপারে সম্পূর্ণ নির্লিপ্ত থাকা এবং ইখলাস ও নিষ্ঠার সাথে আল্লাহ্’র ইবাদতে নিমগ্ন থাকা।
একদা জনৈক কৃপণ ও মুনাফিক ব্যক্তি নিজের স্ত্রীকে কসম দিয়ে বলেছিলো : “তুমি যদি কোন মিস্কীনকে দান-খয়রাত কর, তা’হলে আমি তোমাকে তালাক দিয়ে দিবো।” পরবর্তী কোন এক সময়ে একজন মিস্কীন এসে গৃহের দরজায় হাঁক ছেড়ে বললো : “হে গৃহবাসী ! আমাকে আল্লাহ্’র ওয়াস্তে কিছু দান কর”। ঘর থেকে স্ত্রী তাকে তিনটি রুটি দান করলো। রুটি নিয়ে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে অকস্মাৎ সেই মিস্কীন মুনাফিকের সম্মুখীন হয়ে গেলে জিজ্ঞাসা করলো : “তুমি এ রুটি কোত্থেকে পেলে”? মিস্কীন লোকটি মুনাফিকের গৃহের কথা বললো। অতঃপর সে বাড়ীতে গিয়ে স্ত্রীকে শাসনের স্বরে জিজ্ঞাসা করলো'আমি কি তোমাকে কসম দিয়ে বলি নাই? দান-খয়রাত করলে তালাক দিয়ে দিবো? স্ত্রী বললো : “আমি আল্লাহর নামে দান-খয়রাত করেছি”। এ কথা শুনে মুনাফিক চটে গিয়ে একটি অগ্নিকুণ্ড প্রজ্জ্বলিত করে উত্তপ্ত অগ্নিতে তাকে আল্লাহর নামে ঝাপ দিতে আদেশ করলো। নির্দেশ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রী গহনা অলঙ্কারে সজ্জিতা হয়ে প্রস্তুত হয়ে গেল। এ সময় মুনাফিক স্বামী তাকে গহনা-অলঙ্কার খুলে ফেলার নির্দেশ দিলে স্ত্রী উত্তরে বললো'বন্ধু বন্ধুর জন্য সাজ-সজ্জা গ্রহণ করে থাকে; এখন আমি আমার প্রিয় বন্ধুর সাক্ষাত লাভে ধন্য হতে যাচ্ছি - একথা বলেই সে অগ্নিকুণ্ডে ঝাপিয়ে পড়লো। অতঃপর মুনাফিক আগুনের গর্তটি উপর দিয়ে ঢেকে রেখে চলে গেলো। তিন দিন পর ফিরে এসে গর্তটি খুলে দেখলো তার স্ত্রী দিব্যি যেমন ছিলো তেমনি সহী–সালামতে জীবিত রয়েছে। এ দৃশ্য দেখে সে বিস্ময়াভিভূত হয়ে গেলো; এমন সময় অদৃশ্য একটি আওয়ায ভেসে আসলো ‘তুমি কি একথা বিশ্বাস কর না যে, অগ্নি আমার প্রিয়জনকে কখনো স্পর্শ করে না।”
ফেরআউনের স্ত্রী হযরত আছিয়া (আঃ) নিজের ঈমানদার হওয়ার বিষয়টি বহুকাল পর্যন্ত ফেরআউন থেকে গোপন করে রেখেছিলেন। অবশেষে বিষয়টি ফেরআউনের গোচরীভূত হওয়ার পর হযরত আছিয়াকে সে বিভিন্নরূপে শাস্তি প্রদানের হুকুম দিল। সেমতে তাঁকে বহু রকমে উৎপীড়ন করা হয়। ফেরআউন তাঁকে বলেছিল : “হে আছিয়া ! তুমি তোমার দ্বীনকে পরিত্যাগ কর”। কিন্তু হযরত আছিয়া দ্বীন ও ঈমানের উপর অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে স্থিত ছিলেন। পরিশেষে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কীলক (পেরেক) পুতে দেওয়া হয়েছিল। এ অবস্থায়ও ফেরআউন যখন তাকে দ্বীন ও ঈমান পরিত্যাগ করার নির্দেশ দিচ্ছিল, তখন তিনি উত্তর করছিলেন'হে ফেরআউন ! তুমি আমার শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের উপর ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পার; কিন্তু অন্তঃকরণ তো আল্লাহর হাতে; সেখানে তুমি কোনরূপ অধিকার বা ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে না; জেনে রাখ, তুমি যদি আমার প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে টুকরা টুকরা করে ফেলো, তাতে আমার ঈমানে কোন প্রকার দুর্বলতা সৃষ্টি হওয়া তো দূরের কথা; বরং এতে আমার ঈমান আরও বৃদ্ধি পাবে। এ সময় হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম হযরত আছিয়ার পার্শ্ব দিয়ে পথ অতিক্রম করছিলেন, তখন হযরত আছিয়া তাকে জিজ্ঞাসা করলেন "হে মুসা ! আপনি বলুন খোদা আমার প্রতি সন্তুষ্ট আছেন কিনা'? হযরত মুসা আলাইহিস্ সালাম বললেন : "হে আছিয়া আসমানের ফেরেশতাকুল তোমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান এবং আল্লাহ্ তা'আলা তাঁদের সম্মুখে তোমার বিষয়ে গৌরব করছেন, তোমার যা মনোবাসনা আছে, আল্লাহর কাছে তুমি এখন তা' চেয়ে নাও, তিনি তোমার দো'আ কবুল করবেন"। তখন হযরত আছিয়া দো'আ করলেন; কুরআনের ভাষায় “হে আমার পালনকর্তা ! আপনার সন্নিকটে জান্নাতে আমার জন্যে একটি গৃহ নির্মাণ করুন, আমাকে ফেরআউন ও তার দুষ্কর্ম হতে উদ্ধার করুন এবং আমাকে জালেম সম্প্রদায় হতে মুক্তি দিন"। (তাহরীম : ১১)
হযরত সালমান (রঃ) হতে বর্ণিত ফেরআউন তার স্ত্রী আছিয়াকে প্রখর রৌদ্রে শাস্তি দিতো। তখন ফেরেশতারা আপন আপন ডানার সাহায্যে তাকে ছায়া দান করতো। হযরত আছিয়া তখন বেহেশতে স্বীয় আবাসস্থল দেখতে পেতেন। হযরত আবূ হুরায়রাহ্ (রঃ) থেকে বর্ণিত- ফেরআউন তার স্ত্রী আছিয়ার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে চারটি কীলক (পেরেক) পুতে দিয়েছিল এবং বুকের উপর ভারী চাকী বা পেষণ যন্ত্র স্থাপন করে রেখেছিল। এহেন উৎপীড়নের সময় তার চেহারাকে প্রখর উত্তাপময় সূর্যের দিকে ফিরিয়ে দিতো। এ সময় হযরত আছিয়া আকাশ পানে মাথা উঠিয়ে দো'আ করতেন “ওগো খোদা ! আপনার অতি নিকটে বেহেশ্ত মাঝে আমাকে আবাস দান করুন ।” হযরত হাসান (রঃ) বলেন : 'আল্লাহ্ তা'আলা হযরত আছিয়াকে অতি উত্তমরূপে মুক্তি দান করেছেন এবং বেহেশতে তাঁকে অতি উচ্চ মর্যাদা দিয়েছেন। তিনি বেহেশতে যেকোন স্থানে বিচরণ করেন এবং পানাহার করে থাকেন'। অতএব সাধকের কর্তব্য হচ্ছে, - সর্বদা আল্লাহর পানাহ্ চাওয়া; একমাত্র তাঁরই নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করা। কেননা আপদ-বিপদ ও উৎপীড়ন থেকে মুক্তির জন্য দো'আ করা পুত-চরিত্র নেক বান্দাদের তরীকা ও আদর্শ এবং এটাই প্রকৃত ঈমানের লক্ষণ।
(সমাপ্ত) আত্মার আলোকমনি
প্রথম পর্ব
No comments:
Post a Comment