তওবা (২৭) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)



📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
২৭ - সপ্তবিংশ মজলিস

তওবা

তেসরা রবিউস সানী, শুক্রবার। অদ্যকার মজলিসে তওবা সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল। হযরত শায়খ এরশাদ করিলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত আন্তরিকভাবে তওবা করিয়া মুখে উচ্চারণ করা না হয় ততক্ষণ পর্যন্ত তওবা কার্যকর হয় না এবং তওবার আসল উদ্দেশ্যও সাধিত হয় না। নিজের খেয়াল-খুশীমত পাপ করিয়া পরে যদি তওবা করা হয়, তবে সেই তওবাও আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য নহে। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিয়াছেন- (يأَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا تُوبُوا إِلَى اللَّهِ تَوْبَةً نَصُوحًا) "হে মোমেনগণ! আল্লাহর নিকট তওবা নসুহ কর"।

অর্থাৎ আন্তরিকতার সাথে আল্লাহর নিকট তওবা কর। যে পাপ হইতে তওবা করা হইতেছে তাহা যেন পুনরায় করা না হয়। এইভাবে তওবা করিলে আল্লাহ মেহেরবান হইয়া হয়ত তোমার তওবা কবুল করিতে পারেন।

আল্লাহ ও বান্দার মধ্যস্থিত অন্তরায় পাপ এবং অপবিত্রতা। অন্তরঙ্গতার সাথে কৃত পাপ হইতে তওবা করার পর মানুষ যখন আর সেই পাপ না করে তখন এই অন্তরায় দূর হইয়া যায় এবং আল্লাহর নৈকট্য লাভের পথ বিপদমুক্ত হয়। পৃথিবীর প্রতি আসক্তি এবং পাপ- ইহাই অন্তরকে অপবিত্র করিয়া রাখে। তাই অন্তরকে যাবতীয় কামনা-বাসনা ও লোলুপতা হইতে দূরে রাখ, মোশাহাদা মোকাশাফার দ্বার তোমার জন্য উন্মুক্ত হইয়া যাইবে।

অন্তরের তওবার পর মুখের তওবার স্তর। অর্থাৎ খারাপ ও অশ্লীল কথাবার্তা বলা হইতে তওবা করিয়া মুখকে সংযত রাখাই মুখের তওবা। এই জন্য প্রথমে দুই রাকআত নফল নামায আদায় করত কেবলামুখী অবস্থায় কাকুতি-মিনতি করিয়া আল্লাহর নিকট বলিবে, হে পরওয়ারদেগারে আলম! খারাপ কথা বলা হইতে এবং যে কথায় আপনি অসন্তুষ্ট হোন এমন কিছু বলা হইতে আমাকে, আমার জিহ্বাকে সংযত রাখুন। পরনিন্দা হইতেও আমাকে বিরত রাখুন।

প্রতুষে নিদ্রা হইতে উঠার পর সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ মুখকে অনুরোধ করিয়া বলে, ওহে মুখ! তুমি যদি সংযত থাক তবে আমরা ধ্বংস হইব না। আল্লাহ তা'আলা জিহ্বাকে সৃষ্টি করিয়া এরশাদ করিলেন, ওহে জিহ্বা ! আমার স্মরণ, আমার যিকর-আযকার করার জন্যই আমি তোমাকে মানুষের একটি শ্রেষ্ঠ অঙ্গ হিসাবে সৃষ্টি করিয়াছি। আমার কালাম ব্যতীত যেন অন্য কোন কিছু তোমা দ্বারা উচ্চারিত না হয়। তুমি আমার আদেশের অন্যথা করিলে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ্যই বিপদাপন্ন হইবে। তাই তোমাদের কর্তব্য তোমাদের জিহ্বা যেন সর্বদা আল্লাহর যিকর এবং পবিত্র কালাম তেলাওয়াতে লিপ্ত থাকে।


অতঃপর পীর ও মুরশিদ মানুষের রিযিক বা জীবিকা সম্বন্ধে এরশাদ করিলেন, আল্লাহ তাআলা যাহার ভাগ্যে যেই জীবিকা নির্ধারণ করিয়া রাখিয়াছেন সে তাহা অবশ্যই পাইবে। আর যাহা কাহারও ভাগ্যে রাখেন নাই সে যত চেষ্টাই করুক না কেন কিছুই পাইবে না। সুতরাং যাহার অন্তকরণ জীবিকা অর্জনে লিপ্ত না হইয়া এবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকে, সে-ই শরীয়ত ও তরীকতের পথের যথার্থ পথিক। সুতরাং তুমি একান্তভাবে দৃঢ়তার সাথে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখ- অনুসন্ধান ব্যতীতই তুমি তোমার ভাগ্যের নির্ধারিত বস্তু পাইবে। তুমি নিজেকে তোমার একচ্ছত্র মালিকের সন্ধানে রাখ, তাহা হইলেই তোমার ভাগ্যে যাহা কিছু আছে তাহা তোমাকে সন্ধান করিয়া ফিরিবে। কোন মুসলমান যখন দুনিয়ার সন্ধানে লিপ্ত হইয়া পড়ে তখন দুনিয়া তাহার নিকট হইতে দূরে সরিয়া যায়। আর যে মালিকের সন্ধানে নিয়োজিত থাকিয়া দুনিয়ার প্রতি উদাসীন থাকে, তখন দুনিয়া ও দুনিয়ার যাবতীয় কিছু স্বেচ্ছায় তাহার নিকটে আসিয়া ধরা দেয়। অথচ সে দুনিয়াকে পূতি দুর্গন্ধময় লাশ মনে করিয়া তাহা হইতে সরিয়া থাকে। ওহে দরবেশগণ! আল্লাহর প্রতি ভরসাকারীগণ জীবিকা বা অন্যান্য কোন কিছুর সম্বন্ধে মোটেই চিন্তিত নহেন। কারণ, তাঁহারা বিশ্বাস করেন, ভাগ্যে লিখিত বস্তু অবশ্যই আল্লাহ দান করিবেন। তবে আর চিন্তা-ভাবনা কেন?

সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাজে নিয়োজিত থাক এবং একাগ্রতার সাথে তাঁহার এবাদত-বন্দেগী কর। তারপর দেখ আল্লাহ তোমাদের জন্য কত নেয়ামত পাঠাইয়া দেন।

 ওহে বন্ধুগণ ! শত চেষ্টা করিলেও নির্ধারিত ভাগ্যের কোন প্রকার রদবদল হইবে না। কোন কোন অজ্ঞ লোকের ধারণা, নিজস্ব এলাকা ছাড়িয়া অন্য কোথাও গেলে আমার ভাগ্যের পরিবর্তন হইবে, অধিক ধন-সম্পদের মালিক হইব। এমন ধারণা করা কবীরা গোনাহের মধ্যে পরিগণিত। যাহারা এমন কথা বলে তাহারা আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসী। কারণ, তুমি যেখানেই যাইবে সেখানেই আল্লাহ আছেন এবং তিনিই তোমার ভাগ্যের নিয়ন্তা।

একবার এক ব্যক্তি ভাগ্যের পরিবর্তন করার জন্য নিজের শহর ছাড়িয়া অন্য শহরে যাওয়ার মনস্থ করিল। শহর পরিত্যাগ করার পূর্বে সেই শহরের একজন বুযুর্গের নিকট বিদায় গ্রহণ করিতে গেল। বুযুর্গ জিজ্ঞাসা করিলেন, কেন যাইবে? সে বলিল, হযরত বড় অভাব-অনটনে পড়িয়া গিয়াছি। সেখানে গিয়া দেখি ভাগ্যের পরিবর্তন হয় কিনা? বুযুর্গ বলিলেন, ভাল কথা। তুমি যখন সেখানে পৌঁছিবে তখন তথাকার খোদাকে আমার সালাম দিও। বুযুর্গের কথা শুনিয়া সে তো হতভম্ব। জিজ্ঞাসা করিল, হযরত। সেই শহরে আবার অন্য খোদা কোথা হইতে আসিবে? বুযুর্গ বলিলেন, নাদান! যখন এতটাই বুঝিতে পারিতেছ যে, ঐ শহর এই শহর এবং সারা বিশ্বের খোদা একই জন এবং এখানে বা সেখানে তুমি তাহাই অর্জন করিতে পারিবে যাহা তোমার ভাগ্যে লিখিত রহিয়াছে, তবে কেন এত চিন্তা। যাও, একাগ্রতার সাথে আল্লাহর কাজে লাগিয়া থাক এবং দেখ তিনি তোমার জন্য কি ব্যবস্থা করেন।


অতঃপর তিনি হাত চুম্বন করা সম্বন্ধে বলিলেন, একে অন্যের হাত চুম্বন করা হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এবং তাঁহার পূর্ববর্তী নবীদের সুন্নত। যেব্যক্তি আন্তরিক ভক্তি-শ্রদ্ধার সাথে কোন বুযুর্গ ও পীরের হাত চুম্বন করে, আল্লাহ তাহার যাবতীয় পাপ ক্ষমা করিয়া দেন, যেন সেব্যক্তি আজই মাতৃগর্ভ হইতে ভূমিষ্ট হইল। তাই ইহকাল পরকালের মঙ্গলার্থই শায়খ ও বুযুর্গদের হাতে চুম্বন করা উচিত।

হযরত দাউদ (আঃ) যখন দরবারে বসিয়া বিচার করিতেন তখন বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের কোন বুযুর্গ সেখানে উপস্থিত হইলে তিনি আসন ছাড়িয়া উঠিয়া বুযুর্গের সাথে মোসাফাহা করিতেন এবং তাঁহার হাত চুম্বন করত আকাশের দিকে মুখ তুলিয়া বলিতেন, হে মাবুদ ! এই বুযুর্গের হাত চুম্বনের বরকতে তুমি আমার ইহকাল পরকাল মঙ্গলময় কর।

হযরত ইউসুফ (আঃ) হারাইয়া যাওয়ার পর পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) রাজপথে দাঁড়াইয়া প্রত্যেক গমনাগমনকারীর হাত ভক্তিভরে চুম্বন করিতেন এবং বলিতেন, বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের বুযুর্গদের হাত চুম্বন এবং তাঁহাদের দোআর বরকতেই হয়ত আল্লাহ আমার হারান মানিক ইউসুফকে আমার বুকে ফিরাইয়া দিতে পারেন। 

হুযুর আকরাম (সাঃ) প্রত্যহ প্রভাতে এক বৃদ্ধার নিকট যাইতেন এবং বলিতেন, ওহে বৃদ্ধা। তুমি আমার জন্য আল্লাহর নিকট ভাল দোআ কর।

এক বুযুর্গ বলেন, আমি শপথ করিয়া বলিতে পারি, কোন ব্যক্তি যদি ভক্তিভরে কোন বুযুর্গের হাত চুম্বন করে তবে আল্লাহ অবশ্যই' তাহাকে পরকালে মুক্তি দান করিবেন। কারণ, যেব্যক্তি কোন বুযুর্গের হাত ধারণ করিল সে যেন হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর মোবারক হাতই ধারণ করিল।

হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ ইসলামের ইতিহাসে একজন অত্যাচারী, নির্মম, নিকৃষ্ট শাসনকর্তা হিসাবে চিহ্নিত হইয়া রহিয়াছেন। তিনি ইনতেকাল করার পর লোকে তাহাকে স্বপ্নে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আপনার অবস্থা কি?

হাজ্জাজ বলিলেন, ধ্বংসের পথে পা দিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছি। কিন্তু একটি বিষয়ের প্রতি আমার ভরসা রহিয়াছে, হয়ত তাহার বরকতে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করিয়া দিবেন। লোকে জিজ্ঞাসা করিল, সেই কাজটি কি? 

হাজ্জাজ বলিলেন, আমাকে বলা হইয়াছে যে, তুমি অমুক দিন হাসান বসরীর দরবারে গিয়া ভক্তিভরে তাঁহার হাত চুম্বন করিয়াছিলে। তাহার বরকতেই তোমাকে ক্ষমা করিয়া দেওয়া হইবে।

-------------


No comments:

__