হুজুর (সঃ) এর বানী (২৬) 📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

 


📚মাজালিশে গাজ্জালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

ষষ্ঠ বিংশ মজলিস 


হুযুর (সাঃ)-এর বাণী-

দোসরা রবিউস সানী, বৃহস্পতিবার। কাযী যাহেদ জিজ্ঞাসা করিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, শরীয়ত আমার বাণী, তরীকত আমার কার্যাবলী এবং হাকীকত আমার অবস্থা। শরীয়ত, তরীকত এবং হাকীকত একই বস্তু না ভিন্ন ভিন্ন বস্তু।

পীর ও মুরশিদ বলিলেন- সকলের মূলেই হইল শরীয়ত। শরীয়তে পাকাপোক্ত না-হওয়া পর্যন্ত তরীকত ও হাকীকত অর্জিত হয় না। শরীয়তের পথে তরীকতে প্রবেশ কর, যেন অবস্থার মনযিল স্বীয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে অর্জিত হয়। শরীয়ত ও হাকীকত বিচ্ছিন্ন বিষয় নহে। 'লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্' (لَاَ اِلهَ اِلاَّ اللَّهُ) হলো হাকীকত, মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (مُحَمَّدٌ رَسُولُ اللَّهِ) হলো শরিয়ত কেহ শুধু 'লা-ইলাহ্ ইল্লল্লাহ্' বলে এবং 'মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ' না বলে, তবে সে মুসলমান হইবে না। ইহাতে মনে হয় শরীয়ত, তরীকত ও হাকীকত একই বস্তু এবং শরীয়ত হইতে পৃথক নহে। ইহার তারতম্যও বলিয়া দেওয়া হইয়াছে।

হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) বলিয়াছেন, শরীয়ত আমার নির্দেশ। অর্থাৎ যাহা কিছু আমার নির্দেশ তাহা সহজতর এবাদত, জনসাধারণ সহজে আদায় করিতে সক্ষম হয়। তরীকত আমার কার্যাবলী, যাহা কষ্টকর এবং নিজেকে সাধনার অগ্নিতে নিক্ষেপ করা হয়। ওযু করা শরীয়ত, কিন্তু দিন-রাত ওযু সহকারে থাকা তরীকত। এই শক্তি জনসাধারণের মধ্যে কোথায়? কিন্তু হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) যাহাকে তরীকত বলিয়াছেন তাহা জনসাধারণকে করার নির্দেশও দেন নাই; আবার করিতে নিষেধও করেন নাই। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর অন্তর মোবারক আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত। এই রহস্য সম্বন্ধে কেহই কিছু অবগত নহে।

এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনি একবার এরশাদ করিয়াছেন যে, অনুকরণীয় ঈমান এবং আমাদের ঈমান একই সমতুল্য। কোথায় আরেফদের ঈমান আর কোথায় অনুকরণকারীদের ঈমান 'ইহা বুঝিতে পারিলাম না।

এরশাদ করিলেন, ইহার অর্থ হইল, অনুকরণকারীর ঈমান কাফেরের কুফরীর দিক হইতে ঈমান এবং বেহেশতে প্রবেশ করা তাহার পরিণতি। কিন্তু তাহাতে সন্তুষ্ট থাকা সামান্য পর্যায়ের সন্তুষ্টি। এই সম্প্রদায়ের মতে, তাহাদের এই সামান্য পর্যায়ের সন্তুষ্টি হারাম। তালেবের কোন কিছু অর্জিত হইলে তাহাতে স্থির-স্থিত থাকা ঠিক নহে। আল্লাহ ব্যতীত অন্য সব কিছুকে তাঁহারা প্রতিমা এবং পৈতা মনে করেন। উচ্চ ধারণা ও শক্তি রাখিয়া আসল উদ্দেশ্য সাধনে লিপ্ত থাকিবে।

আরেফের ঈমানও ঈমানই। আরেফ আসল উদ্দেশ্যস্থলে না পৌঁছার দরুন নিজের ঈমানকে অনুকরণকারীর ঈমানের ন্যায়ই মনে করেন। মোশাহাদা না পাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে উভয়েই সমান। যেমন- এক দেরহামের সম্মুখে দশ দেরহাম অনেক বেশী। দশ হাজার দেরহাম একহাজার দেরহামের চেয়ে অনেক বেশী। কিন্তু অপরিমিতের সামনে কোথায় দশ আর কোথায় হাজার দেরহাম; বরং উভয়ই সামন। রাস্তা খুবই কঠিন। পথপ্রদর্শক ব্যতীত এই পথে চলা দুঃসাধ্য। হাঁ, দেখ ! এই পথে চিন্তা-ভাবনার সাথে পা রাখিও। কারণ, এই পথ বাধা-বিঘ্নে পরিপূর্ণ।

তারপর বলিলেন- সিদ্দীকে আকবর বলেন- ঈমান কি? সুতরাং অন্যে আর কি বলিবে? কিভাবে এরূপ ঈমানের প্রতি ভরসা করা যায়। এতটা হিম্মত থাকিতে হইবে যেন ঈমানের পথের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করা যায় এবং আশান্বিত থাকিবে যেন উদ্দেশ্যস্থলে পৌঁছা যায়।


তারপর বলিলেন, যে প্রেমের দাবী করে তাহার পক্ষে উচিত দুইটি বিপদের জন্য তৈয়ার থাকা। প্রথম- আল্লাহ তাআলার পক্ষ হইতে যে বিপদাপদ অবতীর্ণ হয় তাহার জন্য তৈয়ার থাকা। দ্বিতীয়- সৃষ্টির তরফ হইতে যে বালা-মসিবত আসিতে পারে তাহার জন্যও সদা তৈয়ার থাকা। তাই এই সম্প্রদায় কখনও ভালবাসার দাবী করেন না। কারণ, তাঁহারা উভয় প্রকার বিপদের নমুনাই প্রত্যক্ষ করিয়াছেন। তাঁহারা জানেন, প্রেমের দাবী করিলে অবশ্যই প্রমাণ চাওয়া হইবে। এতদসত্ত্বেও তাঁহারা প্রেমের কারবার করেন না। আশা রাখেন লক্ষ্যস্থলে পৌঁছার। মানুষের কর্তব্য, যতদিন জীবিত থাকে ততদিন চেষ্টা হইতে ক্ষান্ত না থাকা। বাদশাহ হওয়ার দাবী করিও না। প্রভুর দাস হইয়া সাক্ষাত লাভের অপেক্ষা কর। প্রেমের ধর্ম হইল, বিপদ যতই হউক ধৈর্যধারণ করা।


হযরত নূহ (আঃ) সাড়ে নয়শত বৎসর জীবিত ছিলেন। তিনি যখনই লোকদিগকে আল্লাহর পথে আহ্বান করিতেন তখনই তাহারা তাঁহাকে ইট-পাথর নিক্ষেপ করিত। একদিন তাঁহার সম্প্রদায় তাঁহাকে সত্তর বার ইট-পাথর নিক্ষেপ করে। তিনি প্রতিবারই অজ্ঞান হইয়া পড়িয়া যান। যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিত তখন আবার সকলকে ইসলাম গ্রহণের আহ্বান করিতেন। নবী ব্যতীত এমন সহ্য শক্তি আর কাহারও থাকিতে পারে না।


এক বন্ধু বলিয়াছেন- জানি না, এই পথের বীরগণ কোন্ উচ্চ মর্যাদায় আসীন ছিলেন। কারণ, তাঁহারা আমল দ্বারা কখনও তৃপ্তি লাভ করেন নাই। পরিশেষে সত্যের গোলামী করার পর্যায়ে আসিয়াছেন এবং শাহানশাহে পরিণত হইয়াছেন। সমস্ত সৃষ্টির নেতায় পরিণত হইয়াছেন। সত্য বলিতে কি, তাঁহাদের ব্যথা নিজেদের সৃষ্টি নহে; বরং খোদার দান। এমন ব্যথা কষ্টে অর্জিত হইতে পারে না। সহ্য করার ক্ষমতা অনুযায়ী বিপদ সকলের উপরই অবতীর্ণ হয়। যেমন- হযরত মূসা (আঃ)-কে মায়ের নিকট হইতে সকালে পৃথক করিয়া আবার সন্ধ্যায় মায়ের মানিক মায়ের কোলে পৌঁছাইয়া দিয়াছেন। পক্ষান্তরে হযরত ইউসুফ (আঃ)-কে হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর নিকট হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া চল্লিশ বৎসর পর পিতার হৃদয়ের ধন পিতার নিকট পৌঁছাইয়া দিয়াছিলেন। 

ইহার রহস্য এই যে, হযরত মূসা (আঃ)-এর মা দুর্বলচেতা রমণী ছিলেন। পুত্রের বিচ্ছেদ যাতনা সহ্য করার মত ক্ষমতা তাঁহার খুবই কম ছিল। তাই তাঁহার পুত্রকে সকালে বিচ্ছিন্ন করিয়া আবার সন্ধ্যায় ফিরাইয়া দিয়াছিলেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) পুরুষ ছিলেন। তাঁহার ধৈর্যধারণ ক্ষমতাও অধিক ছিল। তাই চল্লিশ বৎসরের ব্যবধানে পিতা-পুত্রের মিলন হইয়াছিল। কঠিন বিপদ নবীর উপর অবতীর্ণ হয়। তারপর তাঁহাদের সাথে যাঁহাদের সাদৃশ্য থাকে তারপর নবীর সাথে সাদৃশ্যশীলদের সাথে যাঁহাদের সাদৃশ্য থাকে। এইরূপ পর্যায়ক্রমে বিপদ অবতীর্ণ হইয়া থাকে।

হযরত আইউব (আঃ)-এর দেহে যখন পোকায় আক্রমণ করিল তখন দেহের গোশত শেষ করিয়া হাড় পর্যন্ত চলিয়া গেল। এই অবস্থায়ও তিনি আল্লাহর নিকট কোন প্রকার ফরিয়াদ করেন নাই। বরং আল্লাহ যাহা করিতেছিলেন তাহাতেই তিনি সন্তুষ্ট থাকিয়া আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করিতেছিলেন। দেহে গোশত না থাকায় কীটের দল তাঁহার জিহ্বা ও অন্তরের দিকে ধাবিত হইল। তখন তিনি ক্রন্দন করিয়া আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করিলেন। কিন্তু বিপদে অধীর হইয়া তিনি ফরিাদ করেন নাই; বরং তাঁহার জিহ্বা ও অন্তর নষ্ট হইয়া যাইবে এই ভয়ে তিনি ফরিয়াদ করিয়াছিলেন। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর দরবারে ফরিয়াদ করিলেন, হে খোদা ! আমার অন্তর ও জিহ্বা যদি কীটের খাদ্যে পরিণত হয় তবে তোমার নাম আমি কি উপায়ে স্মরণ করিব? এই অবস্থায় তিনি মোনাজাত করিলেন-

"হে প্রভু! আমি বিপদাপন্ন। আমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করুন। আপনি অত্যন্ত মেহেরবান"।


তারপর হযরত মূসা ও হযরত খিযির (আঃ) প্রসঙ্গে বলিলেন, একদিন হযরত মূসা (আঃ) মিম্বরে দাঁড়াইয়া ওয়ায করিতেছিলেন। এমন সময় সেখানে এক পাগল আসিয়া উপস্থিত হইল এবং প্রশ্ন করিল, (مَنْ اَعْلَمِ النَّاسِ) শ্রেষ্ঠ আলেম কে ? হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, (যেহেতু আমি নবী) আমিই শ্রেষ্ঠ আলেম। অতঃপর তিনি পাহাড়ে গমন করিয়া আল্লাহর নিকট জানিতে চাহিলেন, হে আল্লাহ! সত্যই কি আপনি আমাকে সকলের চেয়ে বেশী জ্ঞান দান করিয়াছেন?

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, খিযির নামে আমার এক বান্দা আছে, সে তোমার চেয়ে বড় আলেম।হযরত মূসা (আঃ) আরয করিলেন, হে প্রভু ! আমাকে আপনি তাঁহার সাথে সাক্ষাত করাইয়া দেন যেন আমি তাঁহার নিকট হইতে জ্ঞানার্জন করিতে পারি। আল্লাহ তা'আলা প্রার্থনা কবুল করিলেন এবং তাঁহার নিকট হইতে জ্ঞানার্জন করার সুযোগ দান করিলেন। তিনি বহু সন্ধানের পর হযরত খিযির (আঃ)-এর সাক্ষাত পাইলেন। পবিত্র কোরআনে এই প্রসঙ্গে আল্লাহ্ ত'আলা বলেন,-  "আমার বান্দাদের মধ্যে আমার খাস রহমত প্রাপ্ত এক বান্দার সাক্ষাত সে পাইল এবং তাহাকে আমি এক বিশেষ প্রকারের এলম (এলমে লাদুনী) দান করিয়াছি।"


সন্ধান করার পর যখন তিনি বাঞ্ছিত জনের সাক্ষাত পাইলেন তখন হযরত খিযির (আঃ) জিজ্ঞাসা করিলেন, হে আল্লাহর নবী ! কি প্রয়োজনে আপনি এই কষ্ট স্বীকার করিয়াছেন? হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, আপনার নিকট হইতে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য। খিযির (আঃ) বলিলেন, আপনি কি আমার কার্যকলাপ সন্তুষ্ট চিত্তে গ্রহণ করিতে পারিবেন? এই প্রসঙ্গে আল্লাহ তা'আলা বলেন- "খিযির বলিল, নিশ্চয়ই আপনি আমার সাথে থাকিয়া ধৈর্যধারণ করিতে পারিবেন না। মূসা বলিলেন, আমি ধৈর্যধারণ করিব। উভয়ে সেখান হইতে রওয়ানা হইয়া এক নদীর তীরে উপস্থিত হইলেন এবং নদী অতিক্রম করার জন্য নৌকায় আরোহণ করিলেন। নৌকা যথাস্থানে পৌঁছার কিছু পূর্বেই খিযির (আঃ) নৌকাখানি ছিদ্র করিয়া ফেলিলেন। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, অযথা কেন আপনি, গরীব বেচারাদের নৌকা ছিদ্র করিয়া ফেলিলেন?"

এই ঘটনার বর্ণনায় আল্লাহ তাআলার ভাষায় হযরত খিযির (আঃ) বলেন- আমি কি প্রথমেই বলি নাই যে, আপনি আমার কাজে ধৈর্যধারণ করিতে পারিবেন না। মূসা (আঃ) বলিলেন, আমার ভুল হইয়া গিয়াছে। আমাকে ক্ষমা করুন। অতঃপর উভয়ে আবার চলিতে আরম্ভ করিলেন। কিছুদূর গিয়া দেখিলেন সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট একটি বালক অন্য বালকদের সাথে আনন্দ চিত্তে খেলা করিতেছে। হযরত খিযির (আঃ) খেলারত বালকদের মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেই সুন্দর চেহারাবিশিষ্ট ছেলেটিকে ধরিয়া আনিয়া হত্যা করিলেন। হযরত মূসা (আঃ) তাঁহারই সম্মুখে একটি নিষ্পাপ খেলারত শিশুকে হত্যা করিতে দেখিয়া অধৈর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন- আপনি কেন এই অবোধ বালকটিকে হত্যা করিলেন? হযরত খিযির (আঃ) বলিলেন, আমার কথা কি সত্যে পরিণত হইল না যে, আপনি আমার কাজে ধৈর্যাবলম্বন করিতে পারিবেন না? আপনি আমার সঙ্গ পরিত্যাগ করিয়া যেখানে ইচ্ছা চলিয়া যান। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, অতঃপর যদি কোন প্রশ্ন করি তবে আপনার নিকট হইতে বিদায় করিয়া দিবেন। আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে বলেন-

"ইহার পর যদি আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করি তবে আমাকে আর আপনার সঙ্গে রাখিবেন না।"

আবার তাঁহারা পথ চলা আরম্ভ করিয়া এক গ্রামে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। গ্রামে একটি ভাঙ্গা প্রাচীর ছিল। হযরত খিযির (আঃ) বিনা পারিশ্রমিকেই সেই ভাঙ্গা প্রাচীরটি মেরামত করিয়া দিলেন। হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, বিনা পারিশ্রমিকে আপনি কেন এই প্রাচীরটি মেরামত করিয়া দিলেন। হযরত খিযির (আঃ) (কোরআনের ভাষায়) বলিলেন- "এখন আপনার ও আমার মধ্যে বিচ্ছিন্নতার সময় হইয়া গিয়াছে"।

হযরত মূসা (আঃ) বলিলেন, হে খিযির (আঃ)। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনার উপরোক্ত তিনটি কাজের ব্যাখ্যা না দিবেন ততক্ষণ পর্যন্ত আমি আপনার নিকট হইতে যাইব না। আপনার এই সমস্ত কাজের মধ্যে নিশ্চয়ই অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। সুতরাং আপনি ঐ সমস্ত কাজের কারণ বলার পরই আমি আপনার নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিব।

হযরত খিযির (আঃ) বলিলেন, আমরা যেই নৌকায় নদী পার হইয়াছি তাহা ছিল কিছু সংখ্যক গরীব শ্রমিকের। শ্রমিকরা ঐ নৌকার আয় দ্বারাই সংসারযাত্রা নির্বাহ করে। আমাদের পিছনেই এক অত্যাচারী বাদশাহ আসিতেছিল। সে অক্ষত নৌকা দেখিলেই জোরপূর্বক লইয়া যায়। তাই আমি নৌকা ছিদ্র করিয়া দিলাম যাহাতে সে নৌকা লইয়া না যায়। আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে এরশাদ করিয়াছেন-

"নৌকাটি ছিল কিছুসংখ্যক গরীব শ্রমিকের যাহারা নদীতে মাঝিগিরি করিত। আমি উহাকে এইজন্য ত্রুটিযুক্ত করিয়া দিলাম যে, পিছনে এক বাদশাহ আসিতেছিল যে ভাল ভাল নৌকা লইয়া যায়"।

বালকটি হত্যা করার কারণ এই যে, উক্ত বালকের পিতা-মাতা নেকবখত মুসলমান। আর বালকটি কুফরীর প্রতি আসক্ত। পিতা-মাতার ইচ্ছা বালকটিকে হত্যা করিয়া ফেলা। তাই আমি তাহাকে হত্যা করিয়া ফেলিলাম যেন তাহারা এমন কুসন্তান হইতে পরিত্রাণ পায়। আল্লাহ তাআলা তাহাদিগকে মেহেরবান এবং সৎ পুত্র দান করিবেন। কোরআন পাকে বর্ণিত আছে: সন্তানের পিতা-মাতা মোমেন ছিল। আমার ভয় হইল, ভবিষ্যত জীবনে স্বীয় অবাধ্যতা ও কুফরীর দরুন পরকাল বরবাদ হইয়া যায় কিনা।

আমি যেই প্রাচীর মেরামত করিয়া দেই উহার মধ্যে দুই জন ইয়াতীমের ধনভাণ্ডার ছিল। প্রাচীর ধ্বংস হইয়া গেলে সেই সম্পদ বাহির হইয়া পড়িত এবং অন্য লোকে লইয়া যাইত। ফলে ইয়াতীমদ্বয় তাহাদের সম্পদ হইতে বঞ্চিত হইয়া পড়িত।

আল্লাহ তাআলা কোরআন পাকে এই সম্বন্ধে বলেন- "শহরে দুই জন নাবালেগ ইয়াতীম বাস করে। এই প্রাচীরদ্বয়ের নিচে তাহাদের সম্পদ লুকানো রহিয়াছে। তাহাদের পিতা সৎ ছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় বালকদ্বয় বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে তাহাদের সম্পদ বাহির করিয়া লইবে। ইহা তোমার প্রভুর রহমতের ব্যবস্থাপনা"।

আমি আমার ইচ্ছায় কিছুই করি নাই। ইহাই ঐ ঘটনাত্রয়ের ব্যাখ্যা, যে বিষয়ে আপনি ধৈর্যধারণ করিতে সক্ষম হন নাই। এই প্রাচীরের নিচে কি সম্পদ লুক্কায়িত ছিল এই সম্বন্ধে আলেমদের মধ্যে মতবিরোধ রহিয়াছে। কেহ বলেন, টাকা-পয়সা ছিল। আবার কেহ কেহ বলেন, পাথরের টুকরা ছিল। তাহাতে দুইটি বাক্য লেখা ছিল। প্রথম বাক্য-

"যে তকদীরে বিশ্বাসী সে কিভাবে চিন্তিত হইতে পারে"?

"যেব্যক্তি মাওলার উপর বিশ্বাসী সে কিভাবে নিশ্চিন্তে আনন্দ উপভোগ করিতে পারে? ইহার পর মূসা (আঃ) বিদায় গ্রহণ করিলেন। 

অতঃপর আত্মদর্শন ও আত্মগর্ব সম্বন্ধে বলিলেন, হে ভ্রাত! তোমরা লক্ষ্য করিয়াছ কি, অভিশপ্ত শয়তান কিভাবে বলিল, (اَنَا خَيْرٌ مِّنْهُ) আমি তাহার চেয়ে ভাল। অথচ সকলেই জানে, এই অহংকারীর পরিণতি কি হইয়াছিল? সুতরাং হে বন্ধুগণ। আর কতদিন আত্মদর্শনে আত্মগর্বে লিপ্ত থাকিবে। যাও, শয়তানের কাহিনীর প্রতি লক্ষ্য করিয়া দেখ যে, আত্মদর্শনের অহমিকায় তাহার পরিণতি কি হইয়াছিল?

No comments:

__