পরিণাম
একুশে রবিউল আউয়াল, রবিবার। আমি দরবার শরীফে আরয করিলাম, লোকের পরিণতি কি হইবে এই সম্বন্ধে কেহ কিছু অবগত আছে কি?
এরশাদ করিলেন, কাহার পরিণতি কি হইবে এই সম্বন্ধে কেহই কিছু অবগত নহে। কিন্তু যাহাদের সম্বন্ধে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) খোশখবর দিয়াছেন তাঁহারাই পরিণতি সম্বন্ধে অবগত। যেমন- সাহাবাদের মধ্যে দশ জনকে বেহেশতী হওয়ার সুসংবাদ দান করিয়াছেন। বেহেশতী হওয়ার সুসংবাদ পাওয়ার পরও তাঁহারা নির্ভয় ছিলেন না ; বরং তাঁহাদের আশা-নিরাশার কোন সীমা ছিল না।
বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিতেন, আমি এতটা ভয় আর আশান্বিত যে, যদি কেয়ামতের দিন ঘোষণা করা হয়, আজ একজন ব্যতীত আর কেহই দোযখে যাইবে না, তবে আমি মনে করি সেই দোযখী আমি ব্যতীত আর কেহই নহে। আবার যদি বলা হয় যে, আজ একজন ব্যতীত আর কেহই জান্নাতী হইবে না। তবে আমি আশা করি সেই জান্নাতী আমি ছাড়া আর কেহ নহে।
সুতরাং দেখা যাইতেছে, পরিণাম কি হইবে সেই সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে। এই বিষয়ে কেহ অবগত হইলে শয়তানেরও তাহার পরিণতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকিত। কারণ, সে ফেরেশতাদের ওস্তাদ ছিল সাত হাজার বৎসরের এবাদতের পুঞ্জি তাহার ছিল। তাহার আমল আরশের পাখার উপর রাখা ছিল।
যখন আল্লাহর দরবারে তাহাকে মরদুদ করা হইল, তখন তাহার কপালে লানতের টিকা পরাইয়া দেওয়া হইল। আল্লাহ এরশাদ করিলেন-
"নিঃসন্দেহে আমার লানত কেয়ামত পর্যন্ত তোমার উপর বর্ষিত হইবে।" সেই মরদুদ মাথায় ধুলাবালি নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিতেছিল-
দোজাহানের এমন কোন স্থান নাই যেখানে আমি সেজদা করি নাই। আমিই তো নিজের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম। ইবলীসের ভাগ্যের কথা শুনিয়া তাহাকে লানত করিতাম আর নিজের এবাদতের জন্য শুকরিয়া আদায় করিতাম। কিন্তু আজ আমি অপাদমস্তক পরিতাপে নিমজ্জিত; সমগ্র জগতের জন্য উদাহরণযোগ্য। হঠাৎ বিষাদ স্রোত আসিয়া পড়িল, মাথায় আমার লানতের আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। আমি কি জানিতাম যে, আমার অভিশপ্ত জন আমি স্বয়ং। আমি ছাড়া সকলেই জ্ঞানী আর আমি উন্মাদ। এখন আমি জানিতে পারিলাম যে, হাজার হাজার বৎসর এবাদত-বন্দেগী করার পরও লানতের বেড়ি গলায় দেওয়া হইয়া থাকে।
ইহার পর মৃত্যু সম্বন্ধে বলিলেন, মৃত্যু এমন এক বস্তু যাহা সন্তানকে ইয়াতীম করে, পিতামাতাকে সন্তানহারা করে, ঘরবাড়ী উজাড় করে, রাজা-বাদশাহকে এক মুহূর্তে দিশাহারা করে।
হে মৃত্যু! তুমি সর্বদা জীবনের উপর ডাকাতি কর। সন্তান-সন্ততি এবং ঘরবাড়ী ধ্বংস কর, যে রাজ্য গঠন করিতে হাজার বৎসর অতিবাহিত হয় তোমার কবলে পড়িয়া এক মুহূর্তে তাহা তছনছ হইয়া যায়। ওহে! তুমি রাজ্যের মালিক, এই জন্য গর্বিত হইও না। যখন মৃত্যু আসিবে তখন তুমি তাহা ছাড়িয়া যাইবে। মৃত্যু এমন এক বস্তু, যে প্রতিদিন প্রতিটি মানুষকে নূতন চিন্তা-ভাবনায় নিপতিত করে। প্রত্যেকের অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে। ওহে ভাই! মালাকুল মওত যখন উপস্থিত হন তখন বলেন-
"হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দার আত্মাকে নেক না বদ লোকের আত্মার ন্যায় কবয করিব?".
জানি না আল্লাহ তখন ইহার উত্তর কি দেন। জানি না আমার ভাগ্যে কি লেখা হইয়াছে। আর ইহাও জানি না যে, পরিণতি কি হইবে? আমার পুণ্যও ধ্বংস হইবে যদি তিনি তাহা গ্রহণ না করেন।
এক বুযুর্গ ছিলেন। কোন লোক তাঁহার নিকট গেলে তিনি বলিতেন, ওহে ভাই ! মৃত্যু ক্রয় করিতে যদি পাওয়া যায় তবে আমার জন্য লইয়া আসিবে। তাঁহার মৃত্যুক্ষণে লোকে জিজ্ঞাসা করিল, মৃত্যু আপনার কেমন মনে হইতেছে?
তিনি বলিলেন, আমার মনে হইতেছে সপ্ত স্তর যমীন আমার নিচে এবং সপ্ত স্তর উপরে। আমাকে যেন উহার মধ্যে রাখিয়া পিষা হইতেছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-
মৃত্যু যন্ত্রণার এক ফোঁটা যদি পাহাড়ের উপর রাখা হইত তবে পাহাড় বিগলিত হইয়া যাইত।
বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার সাথে সাথে সমস্ত প্রাণী মৃত্যুবরণ করিবে। কিন্তু আযরাঈল (আঃ) জীবিত থাকিবেন। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করিবেন, হে আযরাঈল! কোন প্রাণী জীবিত আছে কি?
আযরাঈল (আঃ) বলিবেন, আল্লাহ! তুমি সর্বজ্ঞ। আমি ব্যতীত আর কেহ জীবিত নাই। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিবেন, এবার তোমার জান কবয কর। তখন তিনি মৃত্যু যন্ত্রণার ভয়ে এমনভাবে চিৎকার করিবেন যে, পৃথিবীর আদি হইতে শেষ পর্যন্ত যদি সমস্ত প্রাণী জীবিত থাকিত, তবে তাঁহার এই চিৎকারের যন্ত্রণায় সমস্ত প্রাণীর প্রাণ সংহার হইয়া যাইত। বর্ণিত আছে, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর যখন মৃত্যু যন্ত্রণা আরম্ভ হইল তখন তিনি এক পেয়ালা পানি আনাইয়া তাহাতে পবিত্র হাত ডুবাইয়া পবিত্র বুকে মালিশ করিতেছিলেন আর বলিতেছিলেন-
হে আল্লাহ! আমার ও আমার উম্মতের জন্য মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ করিয়া দেন।
ওহে ভ্রাত! এখন বুঝিয়া দেখ, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মাসুম হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু যন্ত্রণায় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করিয়াছেন, মালাকুল মওতকে নরম হওয়ার জন্য অনুরোধ করিয়াছেন, তখন তোমার আমার অবস্থা কি?
আমি আরয করিলাম, নবী, ওলী এবং অন্যদের মৃত্যু একই সমতুল্য কিনা? এরশাদ করিলেন, মৃত্যুর বেলায় সকলেই সমান
"সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে"। কিন্তু যন্ত্রণার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রত্যেকেই কার্যানুযায়ী মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করিবে। কোন কোন শিশু দুই তিন দিন মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। ইহা তাহাদের মর্যাদার তারতম্যের জন্য হইয়া থাকে। কারণ, তাহারা দুনিয়ায় কোন প্রকার দুঃখের সম্মুখীন হয় নাই। আজ এখানে যাহারা কষ্ট ভোগ করিবে পরকালে তাহাদের উন্নততর মর্যাদা হইবে।
পিতা-মাতার যে ধর্ম শিশুদেরও সেই ধর্ম। যতদিন শিশু থাকিবে ততদিন মুসলমানের সন্তান হইলে মুসলমান এবং কাফেরের সন্তান হইলে কাফের বলিয়াই বিবেচিত হইবে। বালেগ হইলে ঈমান আনা তাহার পক্ষে ফরয। শিশু অবস্থায় সে হুকমী ঈমান রাখে, হাকীকী নহে। শরীয়তের আহকাম তাহার পক্ষে-ওয়াজিব নহে।
কোন মুসলিম শিশু শৈশবে মারা গেলে আমরা তাহাকে মুসলমান বলি। কারণ, তাহার পিতা-মাতার ঈমানই তাহার ঈমান। কাফেরের সন্তান তাহার পিতা-মাতার কুফরীর জন্য নিজেও কাফের হয়। কোন কাফের মুসলমান হইলে তাহার সন্তানদিগকেও আমরা মুসলমান বলি। কারণ, তাহার পিতা-মাতার ইসলামই তাহার ইসলাম।
মাতা-পিতার কুফরীর দরুন সন্তানও কাফের থাকে। পরকালের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইমাম আযম (রঃ) বলেন, শিশুকালে মৃত কাফেরদের শিশু সন্তানদের পরকাল সম্বন্ধে জানি না। ইমাম মুহাম্মদ এবং ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) বলেন, কাফেরদের শিশু সন্তানদিগকে আরাফ নামক স্থানে রাখা হইবে। আরাফ বেহেশত ও দোযখের মধ্যবর্তী একটি স্থান। তাহাদের মধ্যে কুফরী নাই যে দোযখে যাইবে; আর ইসলামও নাই যে বেহেশতবাসী হইবে। বরং দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থান আরাফে থাকিবে।
আর এক মতে, তাহারা বেহেশতের গেলমান হইবে, বেহেশতাবাসীদের খাদেম হইবে।
তারপর বলিলেন, যাহার পরিণতি ভাল সে বিপদমুক্ত। দুনিয়ার যাবতীয় বিপদাপদ পরকালের বিপদাপদের তুলনায় একটি সরিষা সমতুল্যও নহে।