পরিণাম (মাজালিসে গাযযালী - ১৬)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
১৬ ষষ্ঠদশ মজলিস

পরিণাম
একুশে রবিউল আউয়াল, রবিবার। আমি দরবার শরীফে আরয করিলাম, লোকের পরিণতি কি হইবে এই সম্বন্ধে কেহ কিছু অবগত আছে কি?

এরশাদ করিলেন, কাহার পরিণতি কি হইবে এই সম্বন্ধে কেহই কিছু অবগত নহে। কিন্তু যাহাদের সম্বন্ধে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) খোশখবর দিয়াছেন তাঁহারাই পরিণতি সম্বন্ধে অবগত। যেমন- সাহাবাদের মধ্যে দশ জনকে বেহেশতী হওয়ার সুসংবাদ দান করিয়াছেন। বেহেশতী হওয়ার সুসংবাদ পাওয়ার পরও তাঁহারা নির্ভয় ছিলেন না ; বরং তাঁহাদের আশা-নিরাশার কোন সীমা ছিল না।
বর্ণিত আছে, হযরত আবু বকর (রাঃ) বলিতেন, আমি এতটা ভয় আর আশান্বিত যে, যদি কেয়ামতের দিন ঘোষণা করা হয়, আজ একজন ব্যতীত আর কেহই দোযখে যাইবে না, তবে আমি মনে করি সেই দোযখী আমি ব্যতীত আর কেহই নহে। আবার যদি বলা হয় যে, আজ একজন ব্যতীত আর কেহই জান্নাতী হইবে না। তবে আমি আশা করি সেই জান্নাতী আমি ছাড়া আর কেহ নহে।
সুতরাং দেখা যাইতেছে, পরিণাম কি হইবে সেই সম্বন্ধে কেহই অবগত নহে। এই বিষয়ে কেহ অবগত হইলে শয়তানেরও তাহার পরিণতি সম্বন্ধে জ্ঞান থাকিত। কারণ, সে ফেরেশতাদের ওস্তাদ ছিল সাত হাজার বৎসরের এবাদতের পুঞ্জি তাহার ছিল। তাহার আমল আরশের পাখার উপর রাখা ছিল।
যখন আল্লাহর দরবারে তাহাকে মরদুদ করা হইল, তখন তাহার কপালে লানতের টিকা পরাইয়া দেওয়া হইল। আল্লাহ এরশাদ করিলেন-
"নিঃসন্দেহে আমার লানত কেয়ামত পর্যন্ত তোমার উপর বর্ষিত হইবে।" সেই মরদুদ মাথায় ধুলাবালি নিক্ষেপ করিতে করিতে বলিতেছিল-
দোজাহানের এমন কোন স্থান নাই যেখানে আমি সেজদা করি নাই। আমিই তো নিজের অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞাত ছিলাম। ইবলীসের ভাগ্যের কথা শুনিয়া তাহাকে লানত করিতাম আর নিজের এবাদতের জন্য শুকরিয়া আদায় করিতাম। কিন্তু আজ আমি অপাদমস্তক পরিতাপে নিমজ্জিত; সমগ্র জগতের জন্য উদাহরণযোগ্য। হঠাৎ বিষাদ স্রোত আসিয়া পড়িল, মাথায় আমার লানতের আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। আমি কি জানিতাম যে, আমার অভিশপ্ত জন আমি স্বয়ং। আমি ছাড়া সকলেই জ্ঞানী আর আমি উন্মাদ। এখন আমি জানিতে পারিলাম যে, হাজার হাজার বৎসর এবাদত-বন্দেগী করার পরও লানতের বেড়ি গলায় দেওয়া হইয়া থাকে।
ইহার পর মৃত্যু সম্বন্ধে বলিলেন, মৃত্যু এমন এক বস্তু যাহা সন্তানকে ইয়াতীম করে, পিতামাতাকে সন্তানহারা করে, ঘরবাড়ী উজাড় করে, রাজা-বাদশাহকে এক মুহূর্তে দিশাহারা করে।
হে মৃত্যু! তুমি সর্বদা জীবনের উপর ডাকাতি কর। সন্তান-সন্ততি এবং ঘরবাড়ী ধ্বংস কর, যে রাজ্য গঠন করিতে হাজার বৎসর অতিবাহিত হয় তোমার কবলে পড়িয়া এক মুহূর্তে তাহা তছনছ হইয়া যায়। ওহে! তুমি রাজ্যের মালিক, এই জন্য গর্বিত হইও না। যখন মৃত্যু আসিবে তখন তুমি তাহা ছাড়িয়া যাইবে। মৃত্যু এমন এক বস্তু, যে প্রতিদিন প্রতিটি মানুষকে নূতন চিন্তা-ভাবনায় নিপতিত করে। প্রত্যেকের অন্তরকে ক্ষত-বিক্ষত করে। ওহে ভাই! মালাকুল মওত যখন উপস্থিত হন তখন বলেন-
"হে আল্লাহ! তোমার এই বান্দার আত্মাকে নেক না বদ লোকের আত্মার ন্যায় কবয করিব?".
জানি না আল্লাহ তখন ইহার উত্তর কি দেন। জানি না আমার ভাগ্যে কি লেখা হইয়াছে। আর ইহাও জানি না যে, পরিণতি কি হইবে? আমার পুণ্যও ধ্বংস হইবে যদি তিনি তাহা গ্রহণ না করেন।
এক বুযুর্গ ছিলেন। কোন লোক তাঁহার নিকট গেলে তিনি বলিতেন, ওহে ভাই ! মৃত্যু ক্রয় করিতে যদি পাওয়া যায় তবে আমার জন্য লইয়া আসিবে। তাঁহার মৃত্যুক্ষণে লোকে জিজ্ঞাসা করিল, মৃত্যু আপনার কেমন মনে হইতেছে?
তিনি বলিলেন, আমার মনে হইতেছে সপ্ত স্তর যমীন আমার নিচে এবং সপ্ত স্তর উপরে। আমাকে যেন উহার মধ্যে রাখিয়া পিষা হইতেছে।
হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে-
মৃত্যু যন্ত্রণার এক ফোঁটা যদি পাহাড়ের উপর রাখা হইত তবে পাহাড় বিগলিত হইয়া যাইত।
বর্ণিত আছে, কেয়ামতের দিন শিঙ্গায় ফুঁক দেওয়ার সাথে সাথে সমস্ত প্রাণী মৃত্যুবরণ করিবে। কিন্তু আযরাঈল (আঃ) জীবিত থাকিবেন। আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করিবেন, হে আযরাঈল! কোন প্রাণী জীবিত আছে কি?
আযরাঈল (আঃ) বলিবেন, আল্লাহ! তুমি সর্বজ্ঞ। আমি ব্যতীত আর কেহ জীবিত নাই। আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিবেন, এবার তোমার জান কবয কর। তখন তিনি মৃত্যু যন্ত্রণার ভয়ে এমনভাবে চিৎকার করিবেন যে, পৃথিবীর আদি হইতে শেষ পর্যন্ত যদি সমস্ত প্রাণী জীবিত থাকিত, তবে তাঁহার এই চিৎকারের যন্ত্রণায় সমস্ত প্রাণীর প্রাণ সংহার হইয়া যাইত। বর্ণিত আছে, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর যখন মৃত্যু যন্ত্রণা আরম্ভ হইল তখন তিনি এক পেয়ালা পানি আনাইয়া তাহাতে পবিত্র হাত ডুবাইয়া পবিত্র বুকে মালিশ করিতেছিলেন আর বলিতেছিলেন-
হে আল্লাহ! আমার ও আমার উম্মতের জন্য মৃত্যু যন্ত্রণা সহজ করিয়া দেন।
ওহে ভ্রাত! এখন বুঝিয়া দেখ, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মাসুম হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যু যন্ত্রণায় আল্লাহর নিকট ফরিয়াদ করিয়াছেন, মালাকুল মওতকে নরম হওয়ার জন্য অনুরোধ করিয়াছেন, তখন তোমার আমার অবস্থা কি?
আমি আরয করিলাম, নবী, ওলী এবং অন্যদের মৃত্যু একই সমতুল্য কিনা? এরশাদ করিলেন, মৃত্যুর বেলায় সকলেই সমান 
"সকল প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে"। কিন্তু যন্ত্রণার মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রত্যেকেই কার্যানুযায়ী মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করিবে। কোন কোন শিশু দুই তিন দিন মৃত্যু যন্ত্রণা ভোগ করে। ইহা তাহাদের মর্যাদার তারতম্যের জন্য হইয়া থাকে। কারণ, তাহারা দুনিয়ায় কোন প্রকার দুঃখের সম্মুখীন হয় নাই। আজ এখানে যাহারা কষ্ট ভোগ করিবে পরকালে তাহাদের উন্নততর মর্যাদা হইবে।
পিতা-মাতার যে ধর্ম শিশুদেরও সেই ধর্ম। যতদিন শিশু থাকিবে ততদিন মুসলমানের সন্তান হইলে মুসলমান এবং কাফেরের সন্তান হইলে কাফের বলিয়াই বিবেচিত হইবে। বালেগ হইলে ঈমান আনা তাহার পক্ষে ফরয। শিশু অবস্থায় সে হুকমী ঈমান রাখে, হাকীকী নহে। শরীয়তের আহকাম তাহার পক্ষে-ওয়াজিব নহে।
কোন মুসলিম শিশু শৈশবে মারা গেলে আমরা তাহাকে মুসলমান বলি। কারণ, তাহার পিতা-মাতার ঈমানই তাহার ঈমান। কাফেরের সন্তান তাহার পিতা-মাতার কুফরীর জন্য নিজেও কাফের হয়। কোন কাফের মুসলমান হইলে তাহার সন্তানদিগকেও আমরা মুসলমান বলি। কারণ, তাহার পিতা-মাতার ইসলামই তাহার ইসলাম।
মাতা-পিতার কুফরীর দরুন সন্তানও কাফের থাকে। পরকালের ব্যাপারে মতভেদ আছে। ইমাম আযম (রঃ) বলেন, শিশুকালে মৃত কাফেরদের শিশু সন্তানদের পরকাল সম্বন্ধে জানি না। ইমাম মুহাম্মদ এবং ইমাম আবু ইউসুফ (রঃ) বলেন, কাফেরদের শিশু সন্তানদিগকে আরাফ নামক স্থানে রাখা হইবে। আরাফ বেহেশত ও দোযখের মধ্যবর্তী একটি স্থান। তাহাদের মধ্যে কুফরী নাই যে দোযখে যাইবে; আর ইসলামও নাই যে বেহেশতবাসী হইবে। বরং দুইয়ের মধ্যবর্তী স্থান আরাফে থাকিবে।
আর এক মতে, তাহারা বেহেশতের গেলমান হইবে, বেহেশতাবাসীদের খাদেম হইবে।
তারপর বলিলেন, যাহার পরিণতি ভাল সে বিপদমুক্ত। দুনিয়ার যাবতীয় বিপদাপদ পরকালের বিপদাপদের তুলনায় একটি সরিষা সমতুল্যও নহে।

---------

ওলীদের কাশফ ও কারামত (মাজালিসে গাযযালী - ১৫)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

15 পঞ্চদশ মজলিস


ওলীদের কাশফ ও কারামত

বিশে রবিউল আউয়াল, শনিবার। কাবা শরীফের ফযীলত সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।

হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হযরত ইবরাহীম (আঃ) কাবা গৃহ নির্মাণ করার পর আল্লাহ তাআলা আদেশ করিলেন, হে বন্ধু! কাবা গৃহ যিয়ারত করার জন্য আমার বান্দাদিগকে আহ্বান করুন।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) আরয করিলেন, হে আল্লাহ! আপনার বান্দাগণ আমার আহ্বান কি করিয়া শুনিবে?

আল্লাহ তাআলা এরশাদ করিলেন, আহ্বান করা আপনার কর্তব্য। কিভাবে আপনার আহ্বান তাহাদের কর্ণগোচর হইবে সে ব্যবস্থা আমি করিব।

হযরত ইবরাহীম (আঃ) কোবায়েস পাহাড়ে আরোহণ করিয়া বলিলেন-

হে মানবমণ্ডলী! আল্লাহ আমাকে কাবা নির্মাণ করার নির্দেশ দিয়াছেন। আমি তাহা নির্মাণ করিয়াছি। তারপর তোমাদিগকে আহ্বান করার নির্দেশ দিয়াছেন। তোমরা আমার আহ্বানে সাড়া দাও এবং কাবার যিয়ারত কর। আল্লাহ তোমাদিগকে ক্ষমা করিবেন।


যাহারা বাপের ঔরসে ও মায়ের পেটে ছিল, আল্লাহ স্বীয় কুদরত দ্বারা এই আহ্বান তাহাদের কানে পৌছাইয়া দিলেন। ঐদিন যেব্যক্তি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর আহ্বান শুনিয়া একবার লাব্বায়েক বলিয়াছিল সে একবার হজ্জ আদায় করিয়াছে, যে দুই বা ততোধিকবার লাব্বায়েক বলিয়াছে সে দুই বা ততোধিকবারই হজ্জ করিয়াছে বা করিবে। আর যে লাব্বায়েক বলে নাই সে হজ্জ করিতে পারিবে না।

কাবা যিয়ারত করার পুণ্য যেকোন সময়ই ছিল এবং থাকিবে। যাহারা এই আহ্বানে সাড়া দিয়াছে তাহারাই হজ্জ করার ভাগ্যে ভাগ্যবান হইবে।

তাহার পর বলিলেন, হজ্জ ও অন্যান্য সময়কার তাওয়াফ শেষ করিয়া লোক যখন সাফা ও মারওয়া পাহাড়ে সায়ী করার জন্য যাইত, তখন সেখানে এক বৃদ্ধা খোঁড়া মহিলাকে দেখিতে পাইত। বৃদ্ধা মহিলার কাজ ছিল, যাহারা সায়ী করিত তাহাদের কাপড়-চোপড় নিজের দায়িত্বে রাখা।

একবার এক ভারতীয় হজ্জ করিতে গিয়। সেই বৃদ্ধা মহিলাকে দেখিয়া বলিল, তুমি তো অমুক স্থানে থাক: আমি তোমাকে চিনি।

মহিলা বলিল, আমি অন্য কোথাও থাকি না। সারা বৎসর এখানে থাকিয়া লোকদিগকে সায়ী করিতে সাহায্য করি।

ইহার পর মাখদুম জাঁহা বলিলেন-

যেব্যক্তি "আমি হাযির! হে আল্লাহ আমি হাযির। তোমার কোন শরীফ নাই। আমি হাযির। সমস্ত প্রশংসা এবং নেয়ামত তোমারই। তোমারই রাজত্ব। তোমার কোন অংশীদার নাই" বলে, ইহা সেই আহ্বানেরই জবাব।

যাহারা কাবার যিয়ারত করে তাহারা ঐ আহ্বান শুনিয়াছিল এবং কবুল করিয়াছিল।

তারপর বলিলেন, আরববাসী দুইটি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। প্রথম- প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা, কোন মতেই ওয়াদার খেলাফ না করা। দ্বিতীয় মেহমানদারী করা। মেহমান' যাহার বাড়ীতে উপস্থিত হউক না কেন, কোন মতেই তাহাকে অন্যের মেহমান হইতে দেয় না।

তাহারা দাস-দাসীদিগকে নির্দেশ দিয়া রাখে, আমার অনুপস্থিতিতে কোন মেহমান আসিলে সে যেন ফিরিয়া না যায় এবং কোনমতেই যেন তাহার অনাদর করা না হয়।

বর্ণিত আছে, একবার হযরত খিযির (আঃ)-এর সাথে হযরত মূসা (আঃ)-এর সাক্ষাত হয়। উভয়ে এক সাথে কোন এক গ্রামে গিয়া উপস্থিত হন। উভয়ে ক্ষুধার্ত ছিলেন। খাওয়ার মত কোন বস্তু তাঁহাদের সাথে না থাকায় তাঁহারা গ্রামবাসীর নিকট খাবার চাহিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহাদিগকে আহার্য দিতে রাযী হইল না।

এই কথা আরবময় প্রচার হইয়া গেল যে, অমুক গ্রামে আল্লাহর দুই জন নবী গিয়াছিলেন এবং ক্ষুধায় কাতর হইয়া গ্রামবাসীর নিকট খাদ্য চাহিয়াছিলেন। কিন্তু কেহই তাঁহাদের কথায় কান দেয় নাই। তাঁহারা ক্ষুধার্ত অবস্থায়ই রাত কাটান এবং পর দিন সেখান হইতে চলিয়া যান।

হতভাগার দল বিফল মনোরথ হইয়া তাহাদের ধন-সম্পদসহ চলিয়া গেল। কেয়ামত পর্যন্ত তাহাদের এই কলঙ্ক উজ্জ্বল হইয়া রহিয়া গেল।

তারপর বলিলেন, মক্কার কাফেরদের অত্যাচার-উৎপীড়ন যখন চরমে পৌঁছিল তখন আল্লাহ তাআলা মুসলমানদিগকে হিজরত করার নির্দেশ দিলেন। মুসলমানগণ যখন মক্কা ত্যাগ করিয়া মদীনায় যাওয়া আরম্ভ করিলেন তখন কাফেরগণ মক্কার চারিদিকে শূলের ব্যবস্থা করিয়া রাখিল। কোন মুসলমানকে মক্কা হইতে মদীনা যাইতে দেখিলেই ধরিয়া আনিয়া শূলে বিদ্ধ করিত। এই চরম অবস্থার মধ্যেও তাঁহারা হিজরত অব্যাহত রাখিলেন। সোবহানাল্লাহ! কেমন তাঁহাদের মন বা আর কেমন মুসলমান!


সাহাবাগণ মদীনায় আগমন করার পর আর্থিক ও শারীরিক কষ্ট-ক্লেশের মধ্যে দিনাতিপাত করিতে লাগিলেন। ইহা দেখিয়া হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) খুব চিন্তিত হইয়া পড়িলেন এবং কি করা যায় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করিতে লাগিলেন।


হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মদীনাবাসীদিগকে সমবেত করিয়া এরশাদ করিলেন, যদি তোমরা চিন্তা-ভাবনা এবং পরামর্শ করিয়া উত্তর দাও তবে আমি তোমাদের নিকট একটি কথা বলিব।


সকলে একবাক্যে আরয করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার জন্য আমাদের পিতা-মাতা কোরবান হউক, এরশাদ করুন।

এরশাদ করিলেন, মক্কাবাসী মুসলমানদের জন্য আল্লাহ হিজরত ফরয করিয়াছেন। তাঁহারা আল্লাহর নির্দেশ পালনার্থ বাড়ী-ঘর, ধন-সম্পদ ছাড়িয়া রিক্ত হস্তে এখানে আসিয়াছেন। এখন তাহাদের জীবিকানির্বাহের কোন পথ খুঁজিয়া বাহির করা দরকার।


মদীনাবাসী সভাস্থল ছাড়িয়া চলিয়া গেলেন এবং নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করিতে লাগিলেন। প্রথমে তাঁহারা বলিলেন, আমাদের যাহা কিছু আছে সবই আমাদের মুহাজির ভাইদিগকে দান করিয়া দিব। তারপর আবার বলিলেন, আমাদের জীবিকানির্বাহের জন্যও কিছু রাখা দরকার। অতঃপর সকলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিলেন যে. আমাদের সম্পত্তির অর্ধেক তাঁহাদিগকে দিব।

এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার পর তাঁহারা হাসি-খুশী মুখে দরবারে নববীতে উপস্থিত হইয়া আরয করিলেন, আমরা সকলে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছিয়াছি যে, আমাদের নিকট যাহা কিছু আছে উহার অর্ধেক আমাদের মুহাজির ভাইদিগকে দান করিব।

এই সিদ্ধান্তের পর আনসারগণ মুহাজিরদিগকে তাঁহাদের সম্পত্তির অর্ধেক দান করিলেন। সুতরাং স্মরণ রাখিও, তোমার অন্তর যদি অর্থ বুঝে তবে তুমি ইহার যথার্থতা বুঝিতে পারিবে যে, পৃথিবী ত্যাগ না করিলে কেহ পৃথিবীতে কৃতকার্য হইতে পারে না।

আল্লাহ তাআলা আনসারদের প্রশংসায় বলিয়াছেন: "হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর সাহায্যকারী হও। যেমন মরিয়ম পুত্র ঈসা বলিয়াছেন, আল্লাহর কাজে কে আমার সাহায্যকারী হইবে? হাওয়ারীরা বলিল,

আমরা আল্লাহর কাজে সাহায্যকারী। বনী ইসরাঈলের একটি সম্প্রদায় ঈমান আনিল

এবং আর একটি দল কাস্ত্রে হইল। আমি ঈমানদারদিগকে তাহাদের শত্রুদের

উপর সাহায্য করিয়াছি। ফলে তাহারা জয়যুক্ত হইল। ঐ সময় যেব্যক্তি এক সের গম দিয়া মুহাজিরদিগকে সাহায্য করিয়াছেন, আজ অহুদ পরিমাণ স্বর্ণ দান করিলেও সেই পরিমাণ পুণ্য সঞ্চয় হইবে না। আনসারগণ মুহাজিরদের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করিয়াছেন, তাহার তুলনা কোন দিন কোন মতেই হইতে পারে না। এই পুণ্যময় ত্যাগ তাঁহারা ব্যতীত আর কেহই স্বীকার করিতে পারে নাই। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন-

লোকেরা যদি এক পথ অনুসরণ করে এবং আনসারগণ অন্য পথ অনুসরণ করে, তবে আমি আনসারদের পথই অনুসরণ করিব।


হজ্জ (মাজালিসে গাযযালী - ১৪)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
14 চতুর্দশ মজলিস

হজ্জ

উনিশে রবিউল আউয়াল, শুক্রবার। আমরা অনেকেই পবিত্র খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। উপস্থিত দরবেশদের মধ্যে সাইয়েদ নূরুদ্দীন গযনবী, সাইয়েদ শরফুদ্দীন, শায়খ মুহম্মদ মুজাহদুয প্রমুখ দরবেশ এমন উন্নত পর্যায়ের ছিলেন যে, আরশ হইতে পাতাল পর্যন্ত সব কিছুই বিনা বাধায় দেখিতে পাইতেন। কাবা গৃহের মুসাফিরদের কথা আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।


হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, যে আল্লাহর খাস বান্দা, তিনি যদি স্বীয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত থাকেন তবে কাবা গৃহকে নির্দেশ দেওয়া হয় ঐ খাস বান্দার চারিদিকে তাওয়াফ কর। এই কথা বলিতে বলিতে তিনি এবং উপস্থিত সকলে দণ্ডায়মান হইয়া এমন বিস্ময়ের জগতে চলিয়া গেলেন যে, সকলেই আত্মহারা হইয়া পড়িলেন। অতঃপর সকলেই এমনভাবে তাকবীর পাঠ করিতে লাগিলেন- যেমন কাবা গৃহের তাওয়াফ করার সময় পাঠ করা হয়।


সকলেই তাকবীর পাঠ করিতেছিলেন এবং প্রত্যেকরই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ হইতে তাজা রক্তধারা প্রবাহিত হইতেছিল। রক্তের যেই ফোঁটা মাটিতে পড়িতেছিল, উহাই তাকবীরের চিত্র অঙ্কন করিয়া প্রবাহিত হইতে লাগিল।


আমাদের যখন জ্ঞান ফিরিয়া আসিল তখন দেখিলাম, কাবা আমাদের সম্মুখে। আমরা কাবার যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করত চারিবার তাওয়াফ করিলাম। এই সময় আমরা অদৃশ্য আওয়ায শুনিতে পাইলাম, হে বন্ধুগণ! আমি তোমাদের তাওয়াফ, হজ্জ এবং নামায কবুল করিলাম। আর যাহারা তোমাদের অনুসারী তাহাদেরটাও কবুল করিলাম।


হযরত পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, আল্লাহর ওয়াস্তে বিশুদ্ধ নিয়তে হজ্জ করিলে তাহার পাপ ক্ষমা করিয়া খাস বান্দাদের নামের তালিকায় তাহার নাম লিখিয়া রাখার জন্য আল্লাহ ফেরেশতাদিগকে নির্দেশ দান করেন। হজ্জের উদ্দেশ্য হইল সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর দরবারে আত্মসমর্পণ করা। এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমেই আল্লাহর সাথে নিবিড় ও গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়। নিজের যাবতীয় পাপ পরিত্যাগ করিয়া লজ্জিত না হইলে এই সম্পর্ক স্থাপন হয় না।


হযরত ফোযায়েল ইবনে ইয়ায বলেন, আমি একবার আরাফাতে অবস্থানকালে দেখিলাম, সকলেই কাকুতি-মিনতি করিয়া মহান আল্লাহর দরবারে দোআ করিতেছে। আর এক যুবক মাথানত করত চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। আমি যুবককে জিজ্ঞাসা করিলাম, প্রিয় বৎস ! আজ এই মহান দিনে সকলেই আল্লাহর দরবারে দোআ করায় ব্যস্ত, অথচ তুমি চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছ?


যুবক আমার দিকে তাকাইয়া বলিল, হযরত! আমি আমার জীবনের মূল্যবান অনেক সময় অযথা কাজে ও কথায় নষ্ট করিয়া ফেলিয়াছি। তাই আমি লজ্জায় দোআ করার জন্য আল্লাহর দরবারে হাত উঠানোর সাহস পাইতেছি না।


আমি বলিলাম, তুমি দোআ কর। আল্লাহ মহান, অতি মেহেরবান। কাহাকেও বঞ্চিত করেন না। এই সমস্ত লোকের বরকতে তিনি তোমাকে তোমার উদ্দিষ্ট স্থানে পৌছাইয়া দিবেন।


আমার কথা শুনিয়া সে দোআ করার জন্য হাত উঠাইতেই তাহার মুখ হইতে এমনভাবে চিৎকার বাহির হইল যে, সাথে সাথে তাহার প্রাণবায়ু বাহির হইয়া গেল।

হজ্জের মূলতত্ত্ব এবং আসল উদ্দেশ্য হযরত জোনায়েদ বাগদাদী (রহঃ)-এর নিম্নোক্ত ঘটনা হইতে সুন্দরূপে উপলব্ধি করা যায়।

জনৈক ব্যক্তি হযরত জোনায়েদ (রহঃ)-এর নিকট আসিলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?

সে ব্যক্তি উত্তর করিল, আমি হজ্জ করিয়া আসিয়াছি।

-তুমি হজ্জ করিয়াছ?

- জি-হাঁ! আমি হজ্জ করিয়াছি।

- তুমি যখন হজ্জ করার নিয়তে স্বগৃহ হইতে বাহির হও তখন কি তুমি তোমার ধন-সম্পদ পরিত্যাগ করার নিয়ত করিয়াছিলে?

- জি-না। আমি তো এই সম্বন্ধে কোন চিন্তাই করি নাই।

- তাহা হইলে তো তুমি হজ্জের নিয়তে বাহির হও নাই।

আচ্ছা! তুমি মক্কার পথে যে সমস্ত মনযিল অতিক্রম করিয়াছ এবং যেখানে যেখানে রাত অতিবাহিত করিয়াছ তখন তুমি আল্লাহর নৈকট্য লাভের মঞ্জিল এবং সে পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহ অতিক্রম করার নিয়ত করিয়াছিলে কি?'

- না, আমি এমন কোন নিয়ত করি নাই।

- তবে হজ্জ কিভাবে শুদ্ধ হইল?

আচ্ছা। যখন তুমি এহরাম বাঁধার নিয়ত করিয়া প্রাত্যহিক পোশাক দেহ হইতে পরিত্যাগ করিয়াছ, তখন কি উহার সাথে তোমার খারাপ স্বভাবও পরিত্যাগ করিয়াছ?

- আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না।

- তবে তোমার এহরাম কিভাবে ঠিক হইল?

তুমি যখন আরাফাতের ময়দানে দাঁড়াইয়াছিলে তখন কি তোমার মনে এই খেয়াল হইয়াছিল যে, তুমি আল্লাহর দরবারে দণ্ডায়মান এবং তাঁহাকে দেখিতেছ?

-না, আমি এমন খেয়াল করি নাই।

- তবে তুমি যেন আরাফাত ময়দানে দণ্ডায়মানই হও নাই।

তাওয়াফ করার সময় তুমি তোমার প্রতি আল্লাহর মেহেরবানী অবতীর্ণ হইতেছে এমন কিছু অনুভব করিয়াছ কি?

- না, এমন কিছু অনুভব করি নাই।

- তবে তো তুমি তাওয়াফই কর নাই।

সাফা ও মারওয়ায় দৌড়ানোর সময় কেন দৌড়াইতেছ তাহা চিন্তা করিয়াছ কি?

- না, করি নাই। -

– তবে তোমার সায়ী হয় নাই।

কোরবানী করার সময় তুপি পাপ বিসর্জন দেওয়ার নিয়ত করিয়াছিলে কি? 

- না।

- তবে তোমার কোরবানী করার সার্থকতা কোথায়?

-আচ্ছা! তুমি যখন কঙ্কর নিক্ষেপ করিয়াছিলে তখন কি এই নিয়ত করিয়াছিলে যে, আল্লাহ যেন আমার পাপরাশি আমা হইতে এমনভাবেই দূরে নিক্ষেপ করিয়া দেন।

- না, আমি এই নিয়ত করি নাই।

-তাহা হইলে তোমার হজ্জের কোন কাজই সুসম্পন্ন হয় নাই। অর্থাৎ যথার্থভাবে তোমার হজ্জ হয় নাই। সুতরাং তুমি ফিরিয়া যাও এবং মাকামে ইবরাহীম পর্যন্ত গিয়া পৌছ। যেই মাকাম সম্বন্ধে আল্লাহ পাক এরশাদ করিয়াছেন, ইবরাহীম তাঁহার প্রভুর নিকট কৃতজ্ঞতার হক আদায় করিয়াছেন।

হযরত পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হযরত আবু ইয়াযীদ (রঃ) বলেন, আমি প্রথমবার হজ্জ করিতে গিয়া দেখি, মক্কা শরীফে একমাত্র কাবা ব্যতীত আর কোন কিছুই নাই। দ্বিতীয়বার হজ্জ করিতে গিয়া কাবা গৃহ এবং উহার মালিককে দেখিতে পাইলাম।

তিনি আবার বলিলেন, হজ্জ মানুষের সকল পাপ বিদূরিত করিয়া দেয়। একবার হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) মুযদালেফা হইতে রওয়ানা হওয়ার সময় সকলকে বলিলেন, তোমরা চুপ করিয়া থাক। সকলেই নীরবে দণ্ডায়মান হইয়া রহিলেন। অতঃপর তিনি এরশাদ করিলেন, হে উপস্থিত জনতা। আজ আল্লাহ তোমাদের প্রতি খুবই মেহেরবান। নেককার ব্যক্তিদের জন্য তোমাদের মধ্যকার পাপী ব্যক্তিও ক্ষমা প্রাপ্ত হইয়াছে। নেককার ব্যক্তি আল্লাহর নিকট যাহা কিছু প্রার্থনা করিয়াছে তাহাই পাইয়াছে। তোমরা সকলে ক্ষমা পাইয়াছ, এখন অগ্রসর হও।


এমন সময় এক গ্রাম্য আরব হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর উটের লাগাম ধরিয়া আরয করিল, ইয়া রাসূলাল্লাহ! যে খোদা আপনাকে সত্য নবীরূপে প্রেরণ করিয়াছেন তাঁহার শপথ করিয়া বলিতেছি, এমন কোন পাপ নাই যাহা আমি করি নাই? আজ আল্লাহ্ আমাকেও কি ক্ষমা করিয়াছেন?

হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিলেন, তোমার পূর্ববর্তী পাপরাশি ক্ষমা করিয়া দিয়াছেন। আমার উটের লাগাম ছাড় এবং এখন হইতে আরও বেশী সৎ কাজে আত্মনিয়োগ কর।

এই কথা বলার পর সেদিনকার মত মজলিস শেষ করা হইল।



তাকবীর দেওয়া (মাজালিসে গাযযালী - ১৩)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
13 ত্রয়োদশ মজলিস

তাকবীর দেওয়া-
আঠার রবিউল আউয়াল, বৃহস্পতিবার। আমরা অনেকেই খেদমতে উপস্থিত ছিলাম। দরবেশদের তাকবীর দেওয়া সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল যে, তাহারা যেখানে যান সেখানেই তাকবীর ধ্বনি করেন, এই নীতি কোথা হইতে আসিল? হযরত শায়খ এরশাদ করিলেন, এমনভাবে তাকবীর দেওয়ার নিয়ম রহিয়াছে। যখন কোন লোক দ্বীন অথবা দুনিয়ার নেয়ামত প্রাপ্ত হয় তখন উক্ত নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় এবং আরও নেয়ামত যেন পাওয়া যায় তজ্জন্য তাকবীর দেওয়া জায়েয। কিন্তু যখন তখন বা যেখানে সেখানে তাকবীর দেওয়া জায়েয নহে। তাকবীর হামদ বা প্রশংসার অর্থে ব্যবহৃত হয়।

একবার হুযুরে আকরাম (সল্লল্লাহু আলাইহে
 ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) সাহাবায়ে কেরামের সমাবেশে উপবিষ্ট ছিলেন। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) তাঁহাদের উদ্দেশে এরশাদ করিলেন, আমি আশা করি পরকালে তোমরা বেহেশতের এক চতুর্থাংশ স্থানের অধিকারী হইবে। অবশিষ্ট তিন চতুর্থাংশ অন্যান্য নবীর উম্মতদের অধিকারে থাকিবে। হযরত আবু বকর (রাঃ) ও অন্যান্য সাহাবী এই পবিত্র বাণী শ্রবণ করত নেয়ামতের আধিক্যের শুকরিয়া আদায়ের জন্য আল্লাহু আকবার বলিয়া তাকবীর ধ্বনি করিলেন, যেন আল্লাহ তাআলা তাঁহাদিগকে আরও অধিক নেয়ামত দান করেন।
আবার এরশাদ করিলেন, আমি আশা করি আল্লাহ তোমাদিগকে বেহেশতের অর্ধেক দান করিবেন এবং অবশিষ্ট অর্ধাংশ অন্যান্য নবীর উম্মতদের জন্য হইবে। এই পবিত্র বাণী শ্রবণ করত হযরত ওসমান, হযরত আলী এবং অন্যান্য সাহাবী বসা হইতে উঠিয়া দাঁড়াইয়া আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য তাকবীর ধ্বনি করিতে থাকেন।
আবার এরশাদ করিলেন, আমার উম্মতগণ সর্বপ্রথম বেহেশতে প্রবেশ করার অনুমতি পাইবে। অতঃপর অন্যান্য উম্মতগণ বেহেশতে যাইবে। এই বাণী শুনিয়া হযরত আলী (রাঃ) এবং অন্যান্য সাহাবী দণ্ডায়মান হইয়া আল্লাহু আকবার বলিয়া তাকবীর ধ্বনি করিলেন।
এই হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, বিশেষ ক্ষেত্রে তাকবীর ধ্বনি করা জায়েয। কিন্তু যেখানে সেখানে যখন তখন তাকবীর দেওয়া জায়েয নহে। 

অতঃপর এই আলোচনা হইতে লাগিল যে, মুরীদ যদি নফল নামায আদায় করিতে থাকে এবং এ মুহূর্তে পীর ও মুরশিদ তাহাকে ডাকেন তখন মুরীদের কর্তব্য কি? মুরীদ কি নামায ছাড়িয়া পীরের আহ্বানে সাড়া দিবে না নামায আদায় করিয়া সাড়া দিবে।

পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, এই অবস্থায় পীরের আহ্বানে সাড়া দেওয়াই উত্তম। ইহাতে বেশী পুণ্যের অধিকারী হইবে। একবার আমি নফল নামায আদায় করিতেছিলাম। এমন সময় আমার পীর ও মুরশিদ আমাকে ডাক দিলেন। আমি খেদমতে হাযির হইলে তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, কি করিতেছিলে? আমি বলিলাম, নফল নামায আদায় করিতেছিলাম। আপনার ডাক শুনিয়া নামায ছাড়িয়া খেদমতে উপস্থিত হইলাম। তিনি বলিলেন, ভাল করিয়াছ। তোমার এই কাজ নফল নামাযের চেয়ে বেশী পুণ্যময়। কেননা, পীরের কাজে নিয়োজিত থাকা ঠিক ধর্মীয় কাজে নিয়োজিত থাকার সমতুল্য।
তিনি বলিলেন, একবার আমি আমার পীর ও মুরশিদের দরবারে উপস্থিত ছিলাম। অন্য দরবেশগণও উপস্থিত ছিলেন। এই সময় আমাদের মধ্যে ওলীদের সম্বন্ধে কথাবার্তা হইতেছিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি আসিয়া আরয করিল, আমি মুরীদ হওয়ার জন্য আসিয়াছি। পীর ও মুরশিদ বলিলেন, আমি তোমাকে যাহা কিছু বলিব তাহা যদি পালন করিতে রাযী থাক তবে এই শর্তেই আমি তোমাকে বায়আত করিতে পারি। আগন্তুক তাঁহার কথায় রাযী হইয়া গেল।
পীর ও মুরশিদ বলিলেন, তবে কালেমা তাইয়্যেবা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু পাঠ কর। কালেমা পাঠ করার পর বলিলেন, এই কালেমা শরীফ সর্বক্ষণ অন্তরে অন্তরে পাঠ করিবে। তারপর তাহাকে বায়আত করিয়া বহু খেলাত দান করিলেন এবং বলিলেন, আমার উদ্দেশ্য ছিল তোমাকে পরীক্ষা করা যে, আমার প্রতি তোমার কতটা দৃঢ় বিশ্বাস আছে। আমার ইচ্ছা যে, তুমি এইভাবে কালেমা শরীফ পাঠ কর। অন্যথায় আমার এমন কি গুণ-গরিমা আছে? আমি তো হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর একজন সামান্যতম দাস। এই কালেমা তো তুমি প্রথম হইতে পাঠ করিয়া আসিতেছ। প্রথম বিশ্বাস ও আগ্রহে ইহাই প্রমাণিত হইল যে, তুমি আমার সত্যিকারের মুরীদে পরিণত হইয়াছ। নিজেকে সত্যিকারের মুরীদ প্রমাণিত করাই মুরীদের কর্তব্য।

ইহার পর এরশাদ করিলেন, তওবা করার পর তওবাকারীর উচিত নহে পাপাচারীদের সাথে সংস্রব রাখা, যাহার ফলে সে পুনরায় পাপ কাজে লিপ্ত হয়। অসৎ সঙ্গের চেয়ে এমন ক্ষতিকর আর কিছু নাই। কারণ, অসৎ সঙ্গের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই কার্যকর হইয়া থাকে! খারাপ কাজ হইতেও তওবা করিবে এবং আত্মরক্ষা করিয়া চলিবে। অন্যায় কাজও তাহার শত্রু।
এই প্রসঙ্গে তিনি একটি ঘটনা বলিলেন যে, হামীদ উদ্দীন বাহওয়ানী নামক এক ব্যক্তি তওবা করেন। তাহার সাথী-সঙ্গীগণ আসিয়া বলিল, বন্ধু ! চল আমরা আবার আমাদের কাজে লাগিয়া যাই। তিনি বন্ধুদিগকে বলিলেন যাও, রাস্তা দেখ। আমার মত অসহায় লোকের পিছন ছাড়। আমি তওবা করিয়াছি। খোদা না করুন, কোন মতেই আমি তওবা হইতে ফিরিব না।
এই সমস্ত কথাবার্তা হইতেছিল, এমন সময় খাবার আসিল। আমরা সকলেই খাইতে বসিয়া গেলাম। ইত্যবসরে শায়খ নিযামুদ্দীন আবুল মুয়াইয়েদ উপস্থিত হইলেন এবং সালাম করিলেন। পীর ও মুরশিদ না তাঁহার সালামের উত্তর দিলেন আর না তাঁহার দিকে ততটা মনোযোগ দিলেন। শায়খ নিযামুদ্দীন ইহাতে বেশ কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হইলেন। আহারপর্ব শেষ হইবার পর শায়খ নিযামুদ্দীন জিজ্ঞাসা করিলেন, আপনাদের আহার করার সময় আমি সালাম করিলাম, সালামের উত্তর দিলেন না কেন?
এরশাদ করিলেন, আমরা আল্লাহর এবাদতে লিপ্ত ছিলাম! তখন সালামের উত্তর কিভাবে দিব বলুন। আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী করার শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করার জন্যই দরবেশগণ আহার গ্রহণ করেন এবং ইহাই তাঁহাদের একমাত্র নিয়ত থাকে। তাই যখন আল্লাহর এবাদতে মশগুল থাকা হয় তখন কিভাবে সালামের উত্তর দেওয়া যাইতে পারে? আগন্তুকের উচিত সালাম করিয়াই খাইতে বসিয়া যাওয়া এবং খাওয়ার পর উঠিয়া পুনরায় সালাম করা।
অতঃপর এরশাদ করিলেন, আমিও এমন এক ঘটনার সম্মুখীন হইয়াছিলাম। একবার আমি শায়খ আবুল কাসেমের খানকায় গিয়া দেখি তাঁহারা সকলেই আহার করিতেছেন। আমি তাঁহাদিগকে সালাম করিলাম। তাঁহারা আমার সালামের না উত্তর দিলেন আর না আমার দিকে ফিরিয়া চাহিলেন। আহারপর্ব শেষ হইলে আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা আমার সালামের উত্তর দিলেন না- ইহা কেমন ব্যবহার? 
শায়খ আবুল কাসেম বলিলেন, নিয়ম তো এই যে, কেহ কোন সমাবেশে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে খাইতে দেখিলে নিজেও খাইতে বসিয়া যাওয়া। খাওয়া শেষ হইলে উঠিয়া সালাম করিবে। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, এই নিয়ম কোথায় পাইলেন? জ্ঞানগত না বর্ণনাগত। তিনি বলিলেন, জ্ঞানগত। কেননা, এবাদতের শক্তি অর্জন করার নিয়তেই দরবেশগণ পানাহার করিয়া থাকেন। এই জাতীয় আহার এবাদতের মধ্যে পরিগণিত। সুতরাং, এবাদত করার সময় সালামের জবাব কিভাবে দেওয়া যাইতে পারে?
এই কথা বলিয়াই হযরত আলমে সুকরে নিমজ্জিত হইয়া পড়িলেন! সে দিনকার মত দরবার বরখাস্ত হইয়া গেল।

----------------

কোরআনের ফযীলত (মাজালিসে গাযযালী - ১২)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

12 দ্বাদশ মজলিস 


কোরআনের ফযীলত

সতের রবিউল আউয়াল, বুধবার। কোরআনের মুকাত্তায়াত শব্দ সম্বন্ধে আলোচনা হইতেছিল। এক বন্ধু জিজ্ঞাসা করিলেন, ইমাম যাহেদীর তাফসীরে উল্লেখ রহিয়াছে, কোরআন তেলাওয়াতকারীদের সম্বন্ধে হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, কোরআনের প্রতিটি শব্দ তেলাওয়াত করার জন্য দশটি করিয়া নেকী বা পুণ্য লিখিত হইয়া থাকে, দশটি পাপ ক্ষমা করা হয় এবং দশটি মর্যাদার স্তর উন্নীত করা হয়।


হাদীসের শেষে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু আমি বলিতেছি না যে, لم। একটি শব্দ। বরং আলিফের পরিবর্তে দশ, লামের পরিবর্তে দশ এবং মীমের পরিবর্তে দশটি পুণ্য দান করা হইয়া থাকে। অতএব, ইহাকে একটি শব্দ বলিও না। ইহার কারণ কি?

আমাদের পীর ও মুরশিদ বলিলেন, আল্লাহ ও রাসূলের মধ্যে একটি রহস্য বিদ্যমান রহিয়াছে, তাই উহাকে শব্দ বলা যায় না। যদি শব্দ বলা হয় তবে মুকাত্তায়াতের দ্বারা আরম্ভের পূর্ণতা শেষ হইয়া যায়। কারণ, যদি শব্দ বলি তবে উহার বর্ণ জানা আছে এবং মুকাত্তায়াতে সংযুক্ত বর্ণ এবং অর্থ- উভয়ের দিক হইতেই যেমন মুকাতায়াত্তাতের অর্থ জানা নাই তেমন উহার বর্ণও জানা নাই। এই কারণেই মুকাত্তায়াতকে শব্দ বলা যায় না।


তিনি যে বলিয়াছেন, আলিফের পরিবর্তে দশ, লামের পরিবর্তে দশ এবং মীমে পরিবর্তে দশ পুণ্য পাওয়া যাইবে, এই বর্ণনা মুকাত্তায়াতের শব্দ সম্বন্ধে নহে; বরং ইহা পাঠ করার পুণ্য।


তারপর সেই বন্ধু বলিলেন, অন্য আর এক কিতাবে বর্ণিত আছে, মুকাত্তায়াত কয়েক প্রকার। কোনটি তিন, কোনটি দুই আবার কোনটি একবর্ণ বিশিষ্ট। এই বর্ণনা দ্বারা তো ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, মুকাত্তায়াত শব্দ।


হযরত পীর সাহেব বলিলেন, ইহা আল্লাহর হেকমত বর্ণনা করার জন্য বলা হইয়াছে। তিন বর্ণ, দুই বর্ণ এবং এক বর্ণের মধ্যেও যে আল্লাহর হেকমত রহিয়াছে, ইহাতে তাহাই বর্ণনা করিয়াছেন।


ইহার পর কোরআন ও তাওরাতের আলোচনা প্রসঙ্গে বলিলেন, তাওরাত হযরত মূসা (আঃ)-এর উপর অবতীর্ণ হয়। তাহা এত বিরাটাকার ছিল যে, আশি উটের বোঝার পরিমাণ ছিল। শরীয়তের বিষবস্তু তাওরাতে পূর্ণ ব্যাখ্যার সাথে খোলাখুলিভাবে বর্ণিত ছিল। তাই সেই যুগে এজতেহাদের কোন প্রয়োজন ছিল না। এই কিতাব মূসা (আঃ)-এর সম্পূর্ণ মুখস্থ ছিল।


হযরত মূসা (আঃ)-এর ইনতেকালের পর বখতে নাস্স্সারে আবির্ভাব ঘটে। বখতে নাসার বায়তুল মোকাদ্দাস্ ধ্বংস করিয়া তাওরাত জ্বালাইয়া ফেলে। তাওরাত জ্বালাইয়া দেওয়ায় বনী ইসরাঈলগণ হয়রান-পেরেশান হইয়া পড়ে। কিন্তু আল্লাহ তাআলা বনী ইসরাঈলদের প্রতি অতি মেহেরবান ছিলেন। তিনি তাহাদের মধ্যে হযরত ওযায়ের (আঃ)-কে পয়দা করেন। হযরত ওযায়ের (আঃ) বনী ইসরাঈলদিগকে বলিলেন, তাওরাত আমার কণ্ঠস্থ আছে, আমি বলি তোমরা লিখিয়া লও। এই কথা শুনিয়া তাহারা খুবই সন্তুষ্ট হইল। তাহারা হযরত ওযায়েরের নিকট হইতে তাওরাত লিখিয়া লইল। তাহা সত্তর উটের বোঝার সমপরিমাণ হইল।


দশ বোঝা কম হওয়ার ফলে বনী ইসরাঈলদের মনে খটকা দেখা দিল এবং শয়তান তাহাদিগকে প্ররোচিত করিতে লাগিল যে, এই লিখিত তাওরাত মূল তাওরাতের ন্যায় কিনা? উভয়ের সাথে মিল আছে কিনা? এই সন্দেহের বশীভূত হইয়া তাহারা আসল তাওরাতের সন্ধানে রহিল।


বহু দিন পর তাহারা এক বৃদ্ধার সন্ধান পাইল। সেই বৃদ্ধা তাহাদিগকে বলিল, হযরত মূসা (আঃ)-এর জীবদ্দশায় একখণ্ড তাওরাত মাটির তলায় প্রোথিত করিয়া রাখা হইয়াছিল, কোথায় রাখা হইয়াছিল আমি তাহা জানি। যদি আমি তাহা বাহির করিয়া দিতে পারি তবে তোমরা আমাকে কি পুরস্কার দিবে?


লোকে নানা প্রকার উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল। বৃদ্ধা স্থান দেখাইয়া দিল। মাটি খোদাইর পর সত্যই প্রোথিত তাওরাত পাওয়া গেল। সকলেই তাহাদের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বৃদ্ধাকে নানা প্রকার উপঢৌকন দিয়া সন্তুষ্ট করিয়া দিল। অতঃপর তাহার সাথে হযরত ওযায়ের (আঃ)-এর তাওরাত মিলাইয়া দেখা হইল, কোথাও কোন প্রকার গরমিল নাই। আসল কপির সাথে হুবহু মিল রহিয়াছে।

ইহার ফলে বনী ইসরাঈলদের ঈমানে খটকা দেখা দিল। তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল, যে কিতাব সত্তর উটের বোঝার সমান তাহা কণ্ঠস্থ করিয়া রাখা একজন মানুষের পক্ষে কিভাবে সম্ভবপর হইতে পারে। তাই ওযায়ের কখনও মানব সন্তান নহে ; বরং তিনি আল্লাহর পুত্র। এই কুধারণায় পতিত হইয়া তাহারা বেঈমান হইয়া গেল।


তাওরাত, যবুর, ইনজীল এবং অন্যান্য আসমানী গ্রন্থে যাহা কিছু আছে তাহার সংক্ষিপ্তসারই আল্লাহ তাআলা কোরআনে বর্ণনা করিয়াছেন। এই সংক্ষিপ্ততার জন্যই আল্লাহ তাআলা কোরআনকে ছুহুফ বলিয়াছেন।


পরস্পর ভালবাসা (মাজালিসে গাযযালী - ১১)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

11 একাদশ মজলিস

পরস্পর ভালবাসা

পনর রবিউল আউয়াল, সোমবার। পবিত্র আস্তানায় উপস্থিত ভক্তদের মধ্যে একজন জিজ্ঞাসা করিলেন, পরস্পর যে ভালবাসা হয় এমন ভালবাসা জায়েয কিনা? অথবা এরূপ ভালবাসা পরকালে কোন উপকারে আসিবে কিনা?


হযরত এরশাদ করিলেন, একের সাথে অন্যের ভালবাসা পরকালের কোন কাজেই আসিবে না, তবে যে ভালবাসা আল্লাহর জন্য হয়। যেমন- পীর ও আলেমদের সাথে ভালবাসা, ইহা উপকারে আসিবে। ইহা ব্যতীত নফসের তাড়নায় বা পার্থিব স্বার্থের বশীভূত হইয়া যে ভালবাসা স্থাপন করা হয় তাহা দূষণীয়; বরং এরূপ ভালবাসা দ্বারা মানুষ হারামে লিপ্ত হইয়া পড়ে। যেমন- কোন বেগানা মহিলার প্রতি হঠাৎ দৃষ্টি পতিত হওয়া। কিন্তু ভালবাসার দৃষ্টিতে দ্বিতীয়বার তাহার প্রতি তাকানো হারাম। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, তোমার প্রথম দৃষ্টির জন্য জিজ্ঞাসাবাদ করা হইবে না। কিন্তু দ্বিতীয়বার তাকানোর জন্য পাকড় ও করা হইবে।


নফসের তাড়নায় পার্থিব স্বার্থবশত যে ভালবাসা হয় তাহা চিরস্থায়ী নহে। কারণ, ইহা সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা। আর সৃষ্টির প্রতি ভালবাসা নশ্বর, অবিনশ্বর নহে, ক্ষণস্থায়ী ও ধ্বংসশীল। বরং স্রষ্টার সাথে যে ভালবাসা স্থাপন করা হয় তাহা অবিনশ্বর ও চিরস্থায়ী। কারণ, তাহার অস্তিত্ব কেয়ামতে অবশ্য ফলদায়ক হইবে।


ইহার পর আমি আরয করিলাম, আজ এই দুনিয়ায় একে অন্যকে ভালবাসে, একে অন্যের সান্নিধ্য কামনা করে এবং একে অন্যের আপনজন। পরকালেও কি এমন সম্বন্ধ বিদ্যমান থাকিবে।

তিনি বলিলেন, পৃথিবীতে যেমন বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন আছে, পরকালেও তেমনি থাকিবে। বরং সেখানে যদি কাহারও মনে এই আশা জাগ্রত হয় যে, আমি অমুক বন্ধু বা অমুক আত্মীয়ের সাথে সাক্ষাত করিতে যাইব। এরূপ ধারণা পূর্ণভাবে মনে উদয় হইতে না হইতেই সে যে আসনে বসা থাকিবে তাহা গতিশীল হইয়া অগ্রসর হইতে থাকিবে।


আল্লাহ তাআলা বলেন, "পরহেযগারগণ ব্যতীত আজ এক বন্ধুর অন্য বন্ধুর শত্রুতে পরিণত হইবে"।

বেহেশতে কোন প্রকার দুঃখ-কষ্ট থাকিবে না। জান্নাতবাসীদের অবস্থা জানিতে চাহিলে আল্লাহর এই বাণীর প্রতি খেয়াল কর- জান্নাতবাসী যাহা চাহিবে তাহাই সেখানে মওজুদ পাইবে। তদ্রূপ অন্যান্য আয়াতেও জান্নাতের অবস্থা বর্ণনা করা হইয়াছে। সেইসব আয়াত পাঠ করিলেই জানিতে পারিবে।

----------------

সুখ-দুঃখ (মাজালিসে গাযযালী - ১০)




📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
১০ম দশম মজলিস

সুখ-দুঃখ—
চৌদ্দ রবিউল আউয়াল, রবিবার। মহান দরবারে উপস্থিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করিলাম। পীর ও মুরশিদ যোহরের পর তাশরীফ আনিলেন। ভক্তবৃন্দও দরবারে উপস্থিত ছিলেন। সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল।
মাননীয় পীর ও মুরশিদ সকলকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, এক দেশে এক বাদশাহ ছিলেন। তিনি তাহার মন্ত্রীকে বলিলেন, আমার এমন একটি আংটির প্রয়োজন যাহা দেখিলে আমার মন আনন্দিত হয়। অর্থাৎ যখন আমি কোন কারণে চিন্তিত থাকি তখন ঐ আংটি দেখিয়া যেন আমার চিন্তা দূর হইয়া যায় এবং আমার মনে আনন্দ স্রোত প্রবাহিত হয়। মন্ত্রী বাদশাহর অভিপ্রায় শুনিয়া খুবই চিন্তিত হইয়া পড়িলেন। ভাবিতে লাগিলেন- এখন আমি কি করিব? এই সমস্যার সমাধান করিতে তিনি দেশের গুণী-জ্ঞানী সকলকে পরামর্শ করার জন্য আহ্বান করিলেন। কিভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায় তাহাদের নিকট প্রশ্ন করিলেন।
তিনি সমবেত বিজ্ঞজনদের উদ্দেশে বলিলেন, আমার বাদশাহ আমাকে তো এই নির্দেশ দিয়াছেন। কিন্তু আমি চিন্তা-ভাবনা করিয়াও ইহার সমাধান খুঁজিয়া পাইতেছি না। আপনারা আমাকে সমাধান বলুন, আমি কি করিতে পারি?
এই বিজ্ঞজনদের মধ্যে একজন খুবই অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমান বুযুর্গ ছিলেন। তিনি অন্যান্য সকলের কথাবার্তা শুনার পর বলিলেন, হে মন্ত্রী মহোদয়! বড়ই কঠিন কাজের নির্দেশ আপনাকে দেওয়া হইয়াছে। তবে আমার মতে আপনি একটি আংটি তৈয়ার করাইয়া উহাতে "এই সময়ও অতিবাহিত হইয়া যাইবে" কথা কয়টি খোদাই করিয়া দিন।

উপস্থিত অভিজ্ঞজনেরা সকলেই এই পরামর্শ সমর্থন করিলেন। মন্ত্রী তাঁহাদের কথামত তখনই একটি আংটি তৈয়ার করাইয়া উহাতে উক্ত কথাগুলি ক্ষোদিত করাইয়া বাদশাহর সমীপে পেশ করিলেন। আংটি দেখিয়া বাদশাহ খুব খুশী হইলেন এবং মন্ত্রীর কাজের জন্য তাহাকে বিশেষভাবে পুরস্কৃত করিলেন। কথিত আছে, হযরত সোলায়মান (আঃ)-এর আংটিতেও উপরোক্ত কথা কয়টি সোনালী অক্ষরে ক্ষোদিত ছিল।

ইহার পর নিদ্রা সম্বন্ধে কথাবার্তা আরম্ভ হইল। হযরত পীর ও মুরশিদ এরশাদ করিলেন, নিদ্রা তিন প্রকার:
১। আল্লাহর জন্য নিদ্রা
২। আল্লাহর সাথে নিদ্রা এবং
৩। আল্লাহ হইতে নিদ্রা।
প্রথম প্রকার নিদ্রার অর্থ এই যে, যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহর যিকর-আযকারে এতটা লিপ্ত থাকে যে, তাহার নফস পরিশ্রান্ত হইয়া পড়ে এবং সেই অবস্থায় সে যদি মনে করে যে, সামান্য পরিমাণ নিদ্রা গেলে শ্রান্তি দূর হইয়া যাইবে এবং এই নিদ্রা আমার এবাদতে সাহায্যকারী হইবে, তখন নিদ্রা যাওয়া ভাল। অধিক এবাদত করার নিয়তে নিদ্রা যাওয়া এবাদতের মধ্যে পরিগণিত হইবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি তোমাদের জন্য নিদ্রাকে বিশ্রামস্বরূপ করিয়াছি। এই আয়াত এমন সব ব্যক্তির উদ্দেশেই অবতীর্ণ হইয়াছে। এই কারণেই এই নিদ্রাকে আল্লাহর জন্য নিদ্রা বলা হয়।

দ্বিতীয় প্রকার নিদ্রা হইল, যদি কোন ব্যক্তি নিদ্রা যাওয়া নিজের পক্ষে হারাম করিয়া যিকর-আযকারে ডুবিয়া থাকে এবং এই ডুবিয়া থাকার দরুন সে নিদ্রিত হইয়া পড়িলেও ইহা তাহার পক্ষে ইচ্ছাকৃত নিদ্রা নহে; বরং আল্লাহর পক্ষ হইতেই সে নিদ্রিত হইয়া পড়ে। তাই ইহাকে আল্লাহর সাথে নিদ্রা বলা হয়।

তৃতীয় প্রকার নিদ্রা হইল, আল্লাহর এবাদত-বন্দেগী হইতে বিরত থাকিয়া নিদ্রা যাওয়া। যেমন- আমাদের নিদ্রা। আর ইহাই হইল প্রকৃত পাপ। কারণ, নফসের প্রতিপালন এবং শয়তানের নির্দেশ পালন করার জন্যই এই নিদ্রা। এই প্রকার নিদ্রা মানুষকে আল্লাহ হইতে গাফেল করিয়া দেয়। হাদীস শরীফে বর্ণিত আছে, নিদ্রা মৃত্যুর ভাই। এই প্রকার নিদ্রা সম্বন্ধেই কোন কবি বলিয়াছেন-
"অলসতা করিয়া মূল্যবান সময় নষ্ট করিয়া দিয়াছ। তুমি কি উত্তর দিবে? খেলাধুলায় দিন এবং নিদ্রায় রাত অতিবাহিত করিয়াছ। ওহে অলস! অন্তরে জাগ্রত থাক, দুনিয়ায় গাধার ন্যায় খাওয়া ও ঘুমানোর জন্য তোমার আগমন নহে।"
ইহার পর তিনি মোমেনদের মঙ্গল সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে বলিলেন, চল্লিশ দিনের মধ্যে যদি মোমেন বান্দা কোন প্রকার বিপদে জড়িত হয় তবে ভাল। কারণ ইহার মধ্যেই তাহার মঙ্গল নিহিত রহিয়াছে। যদি কোন মোমেন চল্লিশ দিন পর্যন্ত নিরাপদ থাকে, কোন প্রকার বিপদে পতিত না হয় তবে গোমরাহীর ভয় রহিয়াছে। আল্লাহ আমাদিগকে নিরাপদ রাখুন।
এই প্রসঙ্গে তিনি বলিলেন, একদিন মদীনায় হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এক মহিলাকে দেখিলেন এবং তাহাকে বিবাহ করার ইচ্ছা প্রকাশ করিলেন।
এক সাহাবী হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর অভিপ্রায় জানিতে পারিয়া আরয করিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যে মহিলাকে বিবাহ করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, আমি তাহার সম্বন্ধে এতটা জানি যে, সে তাহার সারা জীবনে একবারও অসুস্থ হয় নাই। এমনকি' কোন বিপদেও সে জড়িত হয় নাই।
এই কথা শুনিয়া হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিলেন, তাহার মধ্যে কোন প্রকার মঙ্গল নাই। অতএব তিনি বিবাহ করার অভিপ্রায় পরিত্যাগ করিয়া এরশাদ করিলেন, ফেরআউন চারিশত বৎসর বয়স পাইয়াছিল। এই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে সে কোন দিন পীড়িত হয় নাই। এমনকি একদিনের জন্য সে সর্দিতেও ভোগে নাই। দেখ, ইহার ফলে সে কোন প্রকার বিপদে পতিত হইল। সে দাবী করিল "আমি তোমাদের মহান আল্লাহ।" ইহার পরিণতি সে দুনিয়াতেই ভোগ করিল। অর্থাৎ সে তাহার পরিবার-পরিজনসহ নীল নদে ডুবিয়া মরিল।
আল্লাহ তাআলা এই প্রসঙ্গে বলেন, তোমরা দেখিতেছ, আমি ফেরআউনকে তাহার পরিবার-পরিজনসহ ডুবাইয়া দিলাম। পরকালে তাহাদের দোযখে নিক্ষেপ করা হইবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, তিনি প্রথম ও শেষ অসৎ কাজের প্রতিফল হিসাবে তাহাকে পাকড়াও করিলেন।
তাই চল্লিশ দিনের মধ্যে মোমেন বান্দার জান ও মালের উপর কোন বিপদ আসা প্রয়োজন। কারণ, মোমেনের বিপদের মধ্যে মঙ্গল নিহিত রহিয়াছে। সাধারণ লোকও যদি বিপদাপন্ন হয় তবে উহা দ্বারা তাহার পাপ মার্জনা হয়। আর যদি কোন সালেক বিপদাপন্ন হয় তবে তাহার মর্যাদা ও অবস্থার উন্নতি সাধিত হয়। আলহামদু লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।
---------------------

বিচারক (মাজালিসে গাযযালী - ৯)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)
9/ নবম মজলিস

বিচারক

তের রবিউল আউয়াল, শনিবার। জাহেল কাযী বা বিচারক ও তাহাদের ফয়সালা সম্বন্ধে কথাবার্তা হইতেছিল।

পীর ও মুরশিদ বলিলেন, হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম ) এরশাদ করিয়াছেন, “এক বিচারক জান্নাতী আর দুই বিচারক দোযখী”।

এই পবিত্র বাণী মোতাবেক বিচারক তিন প্রকার। প্রথম প্রকার কাযী আলেম, নিজের এলম দ্বারা শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করেন এবং এই ফয়সালার ব্যাপারে তিনি নিঃস্বার্থ থাকেন। এই প্রথম প্রকারের কাযী জান্নাতী, আল্লাহ তা’আলা বলেন- "ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের আল্লাহ প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন যে, তাহাদিগকে ক্ষমা করিয়া বিরাট প্রতিদান দিবেন।"


দ্বিতীয় প্রকার কাযী আলেম। কিন্তু উৎকোচ গ্রহণ করিয়া শরীয়ত মোতাবেক ফয়সালা করিয়া থাকে। রায় দেওয়ার ব্যাপারে বাদী বিবাদী উভয় পক্ষ হইতে স্বার্থসিদ্ধির আশা পোষণ করে। নিঃস্বার্থভাবে কোন কাজই করে না। উৎকোচ গ্রহণকারী বিচারকের স্থান অবশ্যই দোযখে। 

তৃতীয় প্রকার কাযী জাহেল, অজ্ঞ! শরীয়তের কাজ নিজের অজ্ঞতা দ্বারা সম্পন্ন করিয়া থাকে।

মানুষের অজ্ঞতা অগ্নিস্বরূপ। ওহে ভাই। উহা এমনই অগ্নি যে, উহা দ্বারা একজন আলেম ভন্মে পরিণত হইতে পারে।


জ্ঞান ও বুদ্ধিমত্তার প্রদীপ তোমার সম্মুখে রাখ। অন্যথায় মাথানত অবস্থায় অজ্ঞতার কূপে গড়িয়া যাইবে।


শেষোক্ত দুই প্রকার কাযী বা বিচারক সম্পর্কে শরীয়তের অভিমত, তাহারা দোযখী। অবশ্য মেহেরবান আল্লাহ ক্ষমা করিয়া দিতে পারেন।


এই প্রসঙ্গে হযরত পীর ও মুরশিদ একটি কাহিনী বলিলেন যে, এক শহরে একজন পীর ও একজন আলেম ছিলেন। উভয়ের গৃহদ্বার সামনাসামনি। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় বন্ধুত্ব বিরাজমান ছিল।

হঠাৎ সেই শহরের কাযী (বিচারক) মারা যান। আল্লাহর ইচ্ছা পূর্ণ হওয়ার মানসে সেই আলেমকে উক্ত শহরের কাযীর পদে নিয়োগ করা হইল। বেশ কিছুদিন পরের ঘটনা। পীর সাহেবের কিছু গম পিষানোর প্রয়োজন দেখা দিল। পূর্বের ন্যায় দাসী সেই গয় ভাঙাইতে কাযীর বাড়ী গেল। গম ভাঙাইয়া আসার সময় পীর সাহেব দাসীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, তোমার মাথায় কি?

দাসী বলিল, কাযী সাহেবের বাড়ী হইতে কিছু গম ভাঙাইয়া আনিলাম।

পীর সাহেব বলিলেন, আটা এখানে রাখিয়া তুমি চলিয়া যাও। পীর সাহেবের কথামত দাসী আটা রাখিয়া চলিয়া গেল।

অতঃপর পীর সাহেব তাহার কোন মুরীদকে ডাকিয়া বলিলেন-

এই আটা মাথায় লইয়া শহরময় ঘুরিয়া বেড়াও এবং ঘোষণা কর যে, এই আটা কাযীর বাড়ীর চাক্কিতে পিষানো হইয়াছে। যাহার ইচ্ছা বিনা পয়সায় লইতে পার।

পীরের নির্দেশমত মুরীদ আটা মাথায় করিয়া সমস্ত শহর ঘুরিয়া ফিরিয়া ঘোষণা করিল, কিন্তু কেহই সেই আটা লইতে রাযী হইল না। মুরীদ ফিরিয়া আসিয়া পীরের খেদমতে আরয করিল, কাযীর চাক্কিতে পিষানো বলিয়া কেহই এই আটা গ্রহণ করিতে রাযী হইল না।

পীর সাহেব বলিলেন, এই আটা নদীতে ফেলিয়া দাও! মুরীদ পীরের নির্দেশমত তাহাই করিল। অতঃপর পীর সাহেব শপথ করিলেন, আমি যতদিন জীবিত আছি ততদিন আর এই নদীর পানি পান করিব না।

পীর সাহেব বলিলেন, ইহা ছিল সেই যুগের কাযীর চাক্কিতে পিষানো আটার অবস্থা। আর এই যুগের কার্যীদের অবস্থা পরকালে কি হইবে তখনই তাহারা জানিতে পারিবে। অবস্থা সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী হইবে।

ধূলিঝড় সরিয়া যাওয়ার পর তুমি অবশ্য দেখিতে পাইবে যে, তোমার বাহন ঘোড়া না গাধা। আজ শক্তি মদমত্ত অবস্থায় যাহা ইচ্ছা তাহাই করিতেছ। কিন্তু কাল কেয়ামতের ময়দানে যখন তোমাকে আমলনামা দেওয়া হইবে এবং দাবীদারগণ হাযির হইবে তখন তোমার অবস্থা কি হইবে? এই সমস্ত কাযীর সম্বন্ধে ভয়ানক শাস্তির কথা বলা হইয়াছে। হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, যাহাকে বিচারক করা হইয়াছে তাহাকে বিনা ছুরিতে হত্যা করা হইয়াছে।

মানসূরের শাসন আমলে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) বিচারকের পদ গ্রহণ না করায় তাঁহাকে কতই না যন্ত্রণা ভোগ করিতে হইয়াছিল। শেষ পর্যন্ত তাঁহাকে বন্দিশালায় রাখিয়া অত্যাচার করা হয় এবং সেই অত্যাচার-উৎপীড়নেই তিনি মারা যান। তবু তিনি বিচারকের পদ গ্রহণ করেন নাই।

যাঁহারা সর্বক্ষণ নামাযরত অবস্থায় থাকেন, বিশ্বাস কর, তাঁহারাই রহস্যের ভাণ্ডার। তাঁহারা কাহারও প্রত্যাশী নহেন। আল্লাহর যিকরে লিপ্ত থাকিয়া অন্যের নিকটে অপ্রত্যাশী থাকেন। দরিদ্রতার চুল্লিতে জ্বলিতে থাকেন। নিজেকে প্রিয়ের চিন্তার আধারে পরিণত করেন, একত্বের প্রভাবে দোজাহান হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া যান। আল্লাহ ব্যতীত যাবতীয় কিছু হইতে সব সময় আত্মরক্ষা করিয়া চলেন।

---------------

পীরের পরিচয় (মাজালিসে গাযযালী- ৮)



📚মাজালিসে গাযযালী ✍🏻ইমাম গাজ্জালী (রহঃ)

৮/ অষ্টম মজলিস

পীরের পরিচয়

একাদশ রবিউল আউয়াল, বৃহস্পতিবার। দরবার শরীফে প্রকৃত পীরের গুণাবলী সম্বন্ধে আলাপ-আলোচনা হইতেছিল- এই যুগে প্রকৃত পীর কে এবং কোথায় তাহার সন্ধান করিব?


হযরত মাখদুম জাঁহা বলিলেন, যিনি তিনটি পথ অতিক্রান্ত করিয়াছেন এবং উহার আরোহণ ও অবরোহণের অবস্থা সম্বন্ধে জ্ঞাত, তিনিই পীর। তিনটি পথ হইল, শরীয়ত, তরীকত এবং হাকীকতের পথ। 

যেব্যক্তি এই তিনটি পথের সাথে পরিচিত নহে এবং অতিক্রম করে নাই, সে পীর নহে; বরং শয়তান। তোমরা অনেককেই দেখ জায়নামাযে বসিয়া পীর হওয়ার দাবী করে। তাহারা কখনও পীর মুরশিদ নহে। বরং তাহারা এই পথের প্রতিমা এবং পৈতাস্বরূপ। তাহাদের অবস্থা তো নিম্নরূপ যে, সুন্দর মুখাকৃতি জ্ঞান হরণকারী। মর্যাদার অনুসন্ধানকারী এবং ধর্ম বিক্রেতা। সকলেই স্ব স্ব কাজের জ্ঞানে সামেরী সমতুল্য। প্রকাশ্যে মূসা দৃশ্যমান হইলেও ভিতরে ভিতরে বিষধর সাপ। তাহাদের অন্তর বাগানের দিকে, পৃথিবীর সম্পদের দিকে। তাহাদের জ্ঞান, শরীয়ত এবং ধর্ম আছে কি? তাহারা একে অন্যের রক্ত পিপাসু।


লোকে এক বুযুর্গকে জিজ্ঞাসা করিল, প্রতিমা কি? তিনি উত্তর করিলেন, যে বস্তু তোমাকে আল্লাহ হইতে ফিরাইয়া রাখে উহাই প্রতিমা এবং পৈতা। সাবধান! কখনও এই জাতীয় পীরের ধোঁকায় পড়িবে না এবং তাহাদের নিকট যাইবে না। ইহারা ধর্ম পথের ডাকাত। কোন বুযুর্গ বলিয়াছেন: কিছু অনভিজ্ঞ লোক দরবেশী পোশাক পরিধান করিয়া রহিয়াছে। মুখে তাহাদের ধর্মের বাণী, অন্তরে কুফরী। তাহারা সততা পবিত্রতার পথে এক পদও অগ্রসর হয় নাই। ইহারা নেক লোকদের বদনামকারী।

ইহার পর যোহদ বা বৈরাগ্য সম্বন্ধে এরশাদ করিলেন, যাহারা হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর বাণী- 

("যাহারা পৃথিবী হইতে উদাসীন, পরকালের প্রতি আসক্ত; আল্লাহর ফয়সালা এবং নির্ধারিত ভাগ্যের প্রতি সন্তুষ্ট, তাহারাই যাহেদ বা সংসার বিরাগী") মোতাবেক আমল করে, তাহারাই যাহেদ।

ওহে ভ্রাত! পীর ও সংসারবিরাগী হওয়া বড়ই কঠিন কাজ। আত্মদর্শী এবং নফসের পূজারী এই সম্পদের অধিকারী হইতে পারে না। আবার আল্লাহ ইচ্ছা করিলে যাহাকে খুশী তাহাকেই দিতে পারেন। তাঁহার কাজের বিরোধিতা করার ক্ষমতা কাহারও নাই। তিনি যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করার একমাত্র অধিকারী। যাহা ইচ্ছা তাহাই করেন। তিনি পরম শক্তিশালী, তাই তাঁহার কাজ তাঁহার ইচ্ছা মোতাবেকই হইয়া থাকে।


হে ভ্রাত! আমার কথা শোন! তথাকথিত এই দরবেশদের প্রতি কখনও দৃষ্টিপাত করিবে না, এই দোকানদারদের প্রতি কখনও ফিরিয়া চাহিবে না। কারণ, ইহারা পথপ্রদর্শক নহে; বরং ভ্রান্ত পথের নেতা।


তারপর বলিলেন, সকল বস্তুর মূল ঈমান। তারপর পীর হওয়া এবং সংসার- বিরাগী হওয়া। ঈমান পূর্ণতা লাভ করুক ইহা যেন কেহই চাহে না। ঈমানের পূর্ণতা কেহ কামনা করিলে অবশ্যই তাহার সেই প্রচেষ্টা ফলপ্রসূ হয় এবং তাহার আশা-আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়। কিন্তু সকলেই চায় পীর হইতে, সংসারবিরাগী এবং আবেদ হইতে'। আর এই সমস্ত বিষয়বস্তু আসল উদ্দেশ্য সাধনের পথে প্রধান অন্তরায়। অর্থাৎ আসল উদ্দেশ্য লাভ হইতে বঞ্চিত হওয়ার উপকরণ। এতদসত্ত্বেও তাহাদের দৃঢ় বিশ্বাস, তাহারা উদ্দেশ্য সাধনে কৃতকার্য হইয়াছে। মানিয়া লইলাম যে, তাহারা সব কিছুই পাইয়াছে। কিন্তু ঈমান পূর্ণতা লাভ না করা পর্যন্ত মারেফাতের দৃষ্টিতে তাহারা মুসলমানই নহে।


তুমি সূফী হইয়াছ। সবুজ পোশাক পরিধান করিয়া চিল্লায় বসিয়াছ। সবই হইল, কিন্তু মুসলমান হও নাই।

আল্লাহর নিকট লজ্জিত হওয়া মোমেন বান্দার কর্তব্য। কারণ, লজ্জা ঈমানেরই একটি অংশ; বরং লজ্জা ঈামানের আত্মা। মাথা যেমন দেহের অবিচ্ছেদ্য অংশ, লজ্জাও তেমনি ঈমানের অপরিহার্য অংশ। লজ্জাহীন ব্যক্তি বেঈমান।


হুযুর (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করিয়াছেন, "লজ্জা ঈমানের অংশ। যাহার লজ্জা নাই তাহার ঈমানও নাই।" ফলহীন বৃক্ষের যেমন কোন মূল্য নাই, তেমনি লজ্জাহীন ঈমানেরও কোন অস্তিত্ব নাই।

----------------

__