পীর ও মুরিদের উপর আদেশ উপদেশ
📚রাহাতুল ক্বুলুব ✍🏻নিজামুদ্দীন আউলিয়া (রহ.)
বৃহস্পতিবার, ১০ ই শাবান, ৬৫৫ হিজরী । কদমবুসি লাভের সৌভাগ্যে ভাগ্যবান হলাম । শায়খ জামালউদ্দিন হাছবী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত (শেখ ফরীদ) শায়খুল ইসলামের খেদমতে উপস্থিত ছিলেন । হযরত বললেন, ইসরারুল আরেফীন কিতাবে বর্ণিত আছে যে, যদি কোন ব্যক্তি মুরীদ হওয়ার জন্য ইচ্ছা প্রকাশ করে তা হলে তার উচিত প্রথমে গোসল করা, তারপর রাত্রে জাগ্রত থেকে আল্লাহ্তায়ালার দরবারে পীর, পীরভাই ও নিজের মঙ্গলের জন্য ও নিরাপত্তার জন্য দোয়া করা । যদি সারা রাত না জাগতে পারে তাহলে বৃহস্পতিবার বা সোমবার চাশ্তের সময় নিকটতম বন্ধুবান্ধবদেরকে একত্রিত করে অথবা পছন্দ মতো পবিত্র মুসলমানদেরকে একত্রিত করে দু'রাকাত নামাজ ইস্তেখারা পাঠ করবে এবং পীরের উচিত নিজের সমস্ত মুরীদ ডেকে সম্মুখে বসানো এবং মুরীদ হতে ইচ্ছুক ব্যক্তির মুখে (আয়াতুল কাওয়ারী) পাঠ করে ফুঁক দেয়া । এরপর গোসল করার নির্দেশ দিবে । যখন গোসল করে তার নিকট আসবে তখন পুনরায় উক্ত আয়াত পড়ে মুখে ফুঁক দেয়া এবং কেবলার দিকে মুখ করে নিজের হাতে কাঁচি নিবে এবং কাঁচি চালাবার সময় তিনবার উচ্চস্বরে তকবীর বলবে । আহলে সুলুকদের অনেকে বলে থাকে যে এ তকবীর বলার কারণ ও নিয়ত হচ্ছে নফসে আম্মারা ও নফ্সে মুতমারিদা (অবাধ্যআত্মা)-কে সম্বোধন করে জ্ঞাত করানো যে আমি সংগ্রাম করে যাব তোমাদের সঙ্গে ততক্ষণ পর্যন্ত যতক্ষণ না তোমরা পরাজয় বরণ করো । গাজীদের সুন্নত হলো যুদ্ধের সময় তকবীর বলা যাতে শয়তান বিতাড়িত হয় এবং কোন প্রকার কু-প্ররোচনা না দিতে পারে । যখন তকবীর বলা শেষ হবে তখন ২১ বার কলেমা তৌহিদ উচ্চস্বরে পাঠ করতে হবে ।
এরপর মুরীদের মাথার উপর কাঁচি চালাবার প্রক্রিয়া হচ্ছে প্রথমে সম্মুখের (পেশানীর) একটা চুল ধরে আল্লাহ্তায়ালাকে স্মরণ করে বলতে হবে, হে মালিক, হে বাদশাহের বাদশাহ, এ বান্দা তোমার দরবার হতে পালিয়ে গিয়েছিলো, এখন আবার ফিরে এসেছে । তার ইচ্ছা তোমার বন্দেগী (দাসত্ব) বন্দেগানদের (দাস বা পরিচারকদের) মতো করবে এবং তুমি ছাড়া অন্য কোন খেয়াল তার মনে প্রবেশ করলে তা বের করে দিবে । এরপর পেশানীর ডানদিকের একটা চুল ধরবে তারপর বাঁ দিকের একটা, সবশেষে মাঝেরটা সহ তিনটাকে একত্রে জড়িয়ে নিবে । কিছু সংখ্যক শায়েখ অবশ্য একটা চুল ধরার জন্য বলেছেন ।
বর্ণিত আছে যে , পূর্ববর্তী আরিফে কামেল হযরত খাজা হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন যে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু এরশাদ করেছেন কাঁচি মাথায় চালাতেই হবে তা যে প্রকারেই হোক আমরা হযরত আলী (কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু)- এর নিয়মকেই প্রকৃত ও প্রকৃষ্ট মনে করছি, কেননা আহ্লে সোফ্ফাদের তিনিই প্রথম ও প্রধান খলিফা । এ সম্বন্ধে রাসূলে মাকবুল (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর হাদীসে রয়েছে - “আনা মদিনাতুল ইল্ম ওয়া আলীউন বাবুহা ।” অর্থাৎ আমি ইলমের শহর ও আলী তার দরজা ।
এরপর আমি (নিজাম উদ্দীন আউলিয়া) জিজ্ঞেস করলাম, কাঁচি চালনাটা কিরূপ এবং এ সুন্নত কখন থেকে শুরু হয়েছে ?
উত্তরে তিনি বললেন, হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস্ সালাম হতে এবং কারও কারও মতে হযরত জিব্রীল আলাইহিস্ সালাম হতে । কেননা তিনি ইব্রাহীম খলিলুল্লাহ্ আলাইহিস্ সালামকে শিক্ষা দিয়েছিলেন ।
এরপর এরশাদ করলেন, হযরত খাজা হাবীব আযমী রহমতুল্লাহি আলাইহি হযরত খাজা হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর সঙ্গে একত্র বসেছিলেন। এমন সময় একজন লোক এসে বললো আমি অমুক দরবেশের মুরীদ । হযরত খা’জা হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি বললেন এর নিকট হতে কিছু নির্দেশ চাওয়া দরকার । তিনি জিজ্ঞেস করলেন তোমার মুর্শেদ কি তোমায় কিছু তালকিন (শিক্ষা) দিয়েছেন ?
সে উত্তরে বললো, “না, তবে মাথায় কাঁচি চালিয়েছেন।” এ উত্তর শুনে চুপ হয়ে গেলেন এবং বললেন, “সে পথভ্রষ্টকারী ও পথভ্রষ্ট।” এ থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে শায়খের উচিত মুরীদদের পরিচয়কারী হওয়া।
এরপর হযরত শায়খুল ইসলাম মজলিসের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললেন যে, পীরকে এমন ক্ষমতাবান ও অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হওয়া দরকার, যখন কোন ব্যক্তি মুরীদ হওয়ার জন্য আসে তখন সে পীর একটি মাত্র দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে তার অন্তরের সমস্ত দুনিয়াবী প্রেম ও আবর্জনা এমনভাবে বের করে দিবে যেন তার অন্তর স্বচ্ছ আয়নার মতো হয়ে যায়। যদি তার মাঝে এমন ক্ষমতা না থাকে তাহলে তার মুরীদ করা উচিত নয়। যদি করে তাহলে অপরকে বিভ্রান্ত (গুমরাহ করার অপরাধে অপরাধী) হবে। যখন কোন ব্যক্তি কোন সাহেবে সেজদার (সেজদায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি) নিকট বয়েত হওয়ার জন্য আসে তখন ঐ বুজুর্গের উচিত তার গতি, অবস্থান ও তিন প্রকার নফসের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করা।
প্রথমে দেখতে হবে যে তার নফ্স্, নফ্সে আম্মারা তো নয়। দ্বিতীয়তঃ দেখতে হবে সে নফসে লাওওয়ামার মধ্যে কি না। তৃতীয়তঃ দেখার বিষয় হচ্ছে নফ্সে মোতমায়িন্না এবং তার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপের মাধ্যমে তাকে নফ্সে মুতমায়িন্নার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে ।
নফসে আম্মারা সম্বন্ধে আল্লাহ্ তা'আলা বলেছেন – “বাস্তবিক কোন নফ্সই মুক্ত নয়।” নফসে আম্মারা খারাপ শিক্ষাই প্রদান করে।
নফ্সে লাউওয়ামা সম্বন্ধে পবিত্র কোরানের বাণী হলো— “এবং কসম নফসে লাউওয়ামার।”
নফসে মুতমায়িন্না সম্বন্ধে আল্লাহ্তায়ালা বলেছেন— “হে নফ্সে মুতমায়িন্না তুমি ধাবিত হও তোমার প্রভুর প্রতি সন্তুষ্ট চিত্তে যেন তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট হন।”
এরপর শায়খুল ইসলাম বললেন, মুরীদ সগুণে গুণান্বিত কিনা তা তাকে দেখতে হবে। তারপর সমস্ত কিছু বিচার-বিবেচনার পর বয়াত করার জন্য তার প্রতি হাত বাড়িয়ে দিবে এবং বয়াতের মর্যাদা দানে সম্মানিত করবে এবং নিয়মানুযায়ী মাথায় কাঁচি চালাতে হবে।
যদি কোন পীর বা আহলে সুলুক মুরিদানের মাথায় কাঁচি চালাতে না জানে বা চুল ধরার কায়দা না জানে তাহলে বুঝবে সে পীর মরুভূমি সমতুল্য গোমরাহীতে (অজ্ঞতায়) আছে । আর তার মুরীদের কথা বলার প্রয়োজন তো মোটেই বাঞ্ছিত মনে করি না । কেননা যেখানে পীর নিজেই রাস্তা চিনে না, তখন সে মুরীদকে রাস্তা দেখাবে কি করে? চিরদিন পীর মুরীদ উভয়েই গোমরাহীতে থাকবে।
এরপর হযরত শায়খুল ইসলাম রহমতুল্লাহি আলাইহি এরশাদ করলেন, যে মুরীদ অথবা পীর মযহাব, সুন্নত ও তরীকা মানে না এবং তার চালচলন আল্লাহ্তায়ালার কিতাব ও রাসূলুল্লাহ্ (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর সুন্নত অনুযায়ী নয় সে একজন প্রতারকের চেয়ে অধিক সম্মানীত নয়। কেননা, ধুয়া আগুনের পরিচিতি এবং এ কারণেই প্রায় মুরীদ এ বিভ্রান্তিতে বসবাস করে।
এরপর বললেন, প্রত্যেক মু'মেনের অন্তরে ইলাহির আযমত (শ্রেষ্ঠত্ব) ও কারামত রাখা আছে এবং আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্য লাভের শক্তিও তার মাঝে মওজুত রয়েছে। কিন্তু আফ্সোস এই যে, মানুষ তার অন্তর সংশোধন করতে অমনোযোগী (গাফেল) হয়ে আছে । সে সংশোধন করে না। অভাগা সে, বিভ্রান্তিতে জড়িয়ে পড়ে ।
আহলে সুলুক হতে রাওয়ায়েত আছে - (কালবুল মু'মেনিনা আরশুল্লাহি তায়ালা) অর্থাৎ — মু’মেনের কল্ব আল্লাহ্তায়ালার আরশ ।
এরপর এরশাদ করলেন, যে দরবেশের সামনে লজ্জার ৭০ টি পর্দা উন্মোচিত হয়নি ও নূরের সামান্যতম পরশও যে পায়নি; কাঁচি চালনা ও খিরকা প্রদানের গুরুত্বও বুঝে না, তার তুলনা হবে প্রতারক ও ডাকাতদের সঙ্গে। কেননা সে নিজেও বিভ্রান্তিতে রয়েছে এবং মুরীদকেও বিভ্রান্ত করেছে ।
কিন্তু যদি দরবেশ‘ ‘সাহেবে হাল’ হয় এবং কাঁচি চালনা ও খিরকা প্রদানের ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, পূর্ব পুরুষদের তরীকায় অধিষ্ঠিত থাকে, মযহাব ও সুন্নত জামাতে সুদৃঢ় থাকে তাহলে সে যদি কাউকে মুরীদ করে তাহলে তা সিদ্ধ হবে।
এরপর বললেন, খা’জা শকীক বল্খী রহমতুল্লাহি আলাইহি দলীলে ইনছানী কিতাবে বর্ণনা করেছেন,- যে সৃষ্টি হতে নির্জনতা না পেয়েছে তার সম্বন্ধে অবশ্যই বুঝতে হবে যে আল্লাহ্তায়ালা তাকে নিজ থেকে দূরে রেখেছে। কেননা, সৃষ্টির সাথে তারা বন্ধুত্ব ত্যাগ করতে পারেনি সেটাই বড় নয় বরং তারা মাওলার পথের সন্ধানী নয়।
সুলুকের কিতাবে উল্লেখ আছে যে, হযরত খাজা বায়েজীদ বোস্তামী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলতেন, বিনা প্রয়োজনে ঘর হতে পা বাইরে বের না করা এবং দুনিয়াদারদের সঙ্গে না মেশা । কিন্তু জ্ঞানীদের মজলিসে বসা দূষণীয় নয় । বিনা প্রয়োজনে বাক্যালাপ করা হতে বিরত থাকা । কেননা বেহুদা কথায় অন্তর নিস্তেজ হয়ে পড়ে।
তিনি পুনরায় ‘বয়াত গ্রহণ’ প্রসঙ্গে ফিরে এলেন। বললেন, যখন মুরীদের মাথায় কাঁচি চালাবে তখন গোসল কর্ম সেরে নেয়ার পর অল্প শিরনী তার মুখে দিবে এবং ৩ বার বলবে “হে প্রভু তোমার বান্দাকে তোমায় পাওয়ার জন্য তোমার পথে বধূর মতো বরণ করে নাও।” এরপর বিধান অনুযায়ী তার ব্যবস্থা নিবে। যদি নির্জনতা পালনের উপযুক্ত হয় তাহলে নির্জনতা অবলম্বনের হুকুম দিবে। যদি ঘরে থাকার উপযুক্ত হয় তাহলে ঘরে থাকার আদেশ দিবে।
এরপর বললেন, ইসরারুল আরেফীন কিতাবে বর্ণিত আছে যে, নির্জনতার মেয়াদ ৪০ দিন, সুফী-সঙ্গবাস ৭০ দিন এবং পীরের নিকট ৯৯ দিন ৷
খাঁ’জা সোহেল তসতরী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর ‘ইসরুল আউলিয়া’ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ আছে, হযরত জোনায়েদ বোগদাদী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর তরীকা (তবকা) অনুযায়ী নির্জনতা বাসের মেয়াদ ১২ বছর এবং বসরীয়া তরীকানুযায়ী ৮ বছর । আসলে নির্জনবাসের কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই ।
নির্জনবাসের উদ্দেশ্য হচ্ছে বক্র নফ্সকে বা নফ্সে আম্মারাকে সোজা করে নফ্সে মুতমায়িন্না করা এবং রিয়াজতের (উপাসনার) পদ্ধতিকে গতিশীল ও ধারালো করা, যাতে কর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত হয় । এ ধরনের নির্জনতা অবলম্বনকে পীরের প্রদর্শিত পথে মুরাকাবা বুঝায় ।
অবশ্য প্রথম যখন মুরিদ বিজন স্থানে রিয়াজতের জন্য পদার্পণ করবে তখন পীরের উচিত মুরিদকে নিজ হাতে জামা পরিয়ে দেয়া, যাতে ঐ জামার বরকতে তার রৌশনী (উজ্জ্বলতা) হাসেল হয় । পীরের খিরকা মুরিদানকে দেওয়ার অর্থও একই ।
খা’জা হাসান বসরী রহমতুল্লাহি আলাইহি ও খাজা ফুজায়েল বিন আয়াজ রহমতুল্লাহি আলাইহি হতে উল্লেখ আছে যে নিজের মুরিদকে নিজ হাতে টুপি পরিয়ে দেয়া বাঞ্ছনীয় এবং পরে জেকেরের তালকীন দিবে । প্রাথমিক অবস্থায় জেকের তিন প্রকারঃ
১। লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ -৯ বার
২। মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ্ -১০ বার ।
৩। সুহবানাল্লাহে ওয়াল হামদু লিল্লাহে লা-ই-লাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার -৬১ বার ।
৪ । ইয়া হায়্যু ইয়া কাইয়্যুমু লা-ই-লাহা ইল্লাল্লাহু —৩০ বার ।
প্রত্যেক জেকের উচ্চস্বরে করবে যাতে পরশীও শুনতে পায় ।
এরপর এরশাদ করলেন, জোনায়েদ তরীকায় এটা ১২ বার করা হয় । কিন্তু আমাদের মাশায়েখ বা পীরগণের নির্দেশ হলো জেকের ততক্ষণ পর্যন্ত করতে থাকবে যতক্ষণ না প্রতিটি লোমের মূল থেকে জেকের বের হয় । হযরত এহ্ইয়া আলাইহিস্ সালাম জেকের করতে করতে জঙ্গলে চলে যেতেন এবং বেহুশ হয়ে যেতেন । জঙ্গলে প্রবেশ করে তিনি আনন্দে আত্মহারা হয়ে উচ্চস্বরে বলতেন, ঘর হতে এ স্থান পবিত্র এবং তুমিই করেছো তা শ্রেষ্ঠ । অন্তর আমার তোমার বিরহে ভরে গেছে । যদি তোমার জেকের আমার সাথী না হতো তাহলে অবশ্য আমার দেহ মাটির সাথে মিশে যেতো ।
হযরত শায়খুল ইসলাম (খাজা গন্জশেখর) রহমতুল্লাহি আলাইহি এরপর বললেন, হযরত খাজা নাছিরউদ্দিন আবু ইউসুফ চিশ্তী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, “আমি সিরাজুল ইসরারে লেখা দেখেছি হযরত জুন্নুন মিস্রী রহমতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, পীর মুরীদের সম্পর্ক একটা ধাত্রী মায়ের মতো । যেমন, নবজাতক শিশু যখন প্রসূতির যোনীপথে আটকে যায় তখন ধাত্রী তাকে অন্যমনস্ক করার জন্য নানান প্রক্রিয়া অবলম্বন করে যাতে সে ব্যথা ভুলে যায় । পীরগণ ঠিক তেমনি মুরিদের অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয় । মুরীদের অবস্থানুযায়ী কখনও তাকে দিয়ে জেকের করান । আবার কখনও কোরান শরীফ তেলওয়াত করান । কিন্তু একটা আদেশ সর্বদাই বহাল রাখবে, যেটা হচ্ছে, “দুনিয়া ও দুনিয়াদারদের নিকট হতে দূরে থাকা ।”
এরপর বললেন, পীর ও মুরিদের উপর যে সব আদেশ উপদেশ আলোচনা হলো তা পালন করা দরকার ।
এ কথাও অবশ্য উল্লেখ করার প্রয়োজন রয়েছে যে, যদি কোন ব্যক্তি কামেল মুর্শেদ না পায় তাহলে সে কি করবে ? সে ব্যক্তির এ অবস্থায় উচিত হলো আহলে সুলুকদের কিতাব পাঠ করে সেই অনুসারে চলা যাতে ইচ্ছা পূরণ হয় ।
এরপর এরশাদ করলেন যে, পীরদের উচিত মুরিদানদেরকে উপদেশ দেয়া যাতে তারা বাদশাহ্, ধনী বা দুনিয়াদারের সঙ্গ না করে এবং দূরে থাকে । শিক্ষার্থী যেন খ্যাতি ও প্রাচুর্য কামনা না করে সে বিষয়েও উপদেশ দিতে হবে । মুরিদের প্রতি পীর লক্ষ্য রাখবে যাতে সে বিনা প্রয়োজনে কথা না বলে, খানকা বা ইবাদত খানা হতে বাহিরে না যায় । আসলে এটা হচ্ছে দুনিয়া ত্যাগের পথ ।
হযরত রাসূলে মাকবুল (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম) এরশাদ করেছেন (হুব্বুদ্দুন্ইয়া রা’সু কুল্লু খাতিয়াতিন।) অর্থাৎ - দুনিয়া প্রেম সমস্ত অন্যায়ের মূল ।
এরপর এরশাদ করলেন যে 'সাহেবে সেজদা' (সেজদায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি) বিনা প্রয়োজনে মস্তক সেজদার স্থান হতে সেজদা হতে উত্তোলন করেন না । আসহাবে তরীকত ও জ্ঞানীদের বাণী হচ্ছে, আলেম যদি দুনিয়া চায় তাহলে হারাম হালাল কে বয়ান করবে ? আর সূফি যদি সেজদায় অনুপস্থিত থেকে অলিগলি ও বাজারে বেড়ায় তাহলে তরীকত কে শেখাবে ? কেননা আসল কাজ হচ্ছে সম্মুখে উপস্থিত থাকা ।
এরপর হযরত শায়খ শিবলী রহমতুল্লাহি আলাইহি-এর বাণী হতে উদ্ধৃতি দিয়ে বললেন, আল্লাহ্,র পথের পথিকদের আলামত হচ্ছে, সে যে কোন প্রকারেই হোক জুমআর রাতে জেগে থাকবে এবং জেকের তেলাওয়াত বা নামাজের মাধ্যমে রাতটি অতিবাহিত করবে । এ রাতের ফজিলত হচ্ছে এ রাতে নামাজ পড়লে নামাজে মিরাজ হয় । নামাজ সম্বন্ধে রাওয়ায়েত আছে “আছছালাতু মে’রাজুল মু'মেনীন ।” অর্থাৎ — মোমেনের সালাতে অর্থাৎ নামাজে মি'রাজ হয় ।
এরপর বললেন, সালেক শুধু এভাবেই কায়েম থাকতে পারে যদি সে নিজের দেহ-মনকে দুনিয়া ও দুনিয়াদারদের সংস্রব হতে দূরে রাখে ও নফসের প্ররোচণা হতে বেঁচে থাকে এবং নেক বান্দাদের সঙ্গ করে ।
হযরত রাসূলে মাকবুল (সল্লল্লাহু আলাইহে ওয়াআলিহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশ হচ্ছে “সালেহীনদের সঙ্গ করা রহমতের নূর স্বরূপ এবং জগতের জন্য রহমত স্বরূপ ।” এখানেই হযরত শায়খুল ইসলাম তাঁর বক্তব্য শেষ করে ধ্যানমগ্ন হলেন । মজলিস শেষ হলো । -আল্হামদু লিল্লাহি আলা জালিক ।
পরবর্তী পর্ব —
দরবেশগণ নফল নামাজও গুরুত্ব সহকারে পালন করেন—